Thursday, September 9, 2021

‘প্রথম প্রবাহ’: একজন নারীর হাতে নির্ণীত ভরতবংশের প্রাগেতিহাস

  লিখেছেন

সু ম ন   ব্যা না র্জি

ছবিঃ- ইন্টারনেট

মহাভারতের সত্যবতী চরিত্রটি পরিচিত হলেও অকর্ষিত। বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যে মহাভারত নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে অদ্যাবধি। কিন্তু মহাভারতের আদিপর্বের সত্যবতী চরিত্রটি নিয়ে এমন গভীর অন্বেষণ একালের বিশিষ্ট কথাকার সৌরভ মুখোপাধ্যায় বিরচিত 'প্রথম প্রবাহ' উপন্যাসের আগে বাংলা সাহিত্যে কখন দেখা যায়নি। 

মহাভারত মানেই শুধু কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে অভূতপূর্ব ও রোমাঞ্চকর যুদ্ধ , শ্রী কৃষ্ণের রণনীতি নয়। মহাভারতের মত, যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য, এত জটিল, গহন একটি কাব্যের মহিমা ও গতিপথকে অনুধাবন করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহাকাব্যের উৎসে। মহাভারত হল মহাকাব্য -- এই 'মহা' উপসর্গটি বিশেষ ব্যঞ্জনাবহ। বলা বাহুল্য যে, এটি ব্যক্তিক সুখ দুঃখের অনুভূতি বিজড়িত কাব্যকথা নয়, স্রষ্টার (স্রষ্টাদের) অনন্য নৈর্ব্যক্তিকতার গুণে এখানে সমাজ, ধর্ম, নীতি, নৈতিকতা, দর্শন সর্বোপরি রাজনীতির নানা পরত রয়েছে। সনাতন ভারতীয় পরম্পরার সমস্ত পদচিহ্নই মহাভারতে পাওয়া যায়।   

মহাভারতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক গ্রন্থ বললেও তা অমূলক বা অনৈতিহাসিক হয় না। কেন হয় না? বস্তুত সেই উত্তরকে অনুসন্ধান করাই এই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট। মহাভারতীয় রাজনীতির একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব হলেন সত্যবতী। এই চরিত্রটির গুরুত্বকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে সে নারী বলেই। ভারতীয় রাজনীতিতে যে নারীর ভূমিকা কতখানি সক্রিয় ছিল তা এই উপন্যাসটি (যার কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যবতী) পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

উপন্যাসটি মোট ষোলোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম দুই অংশে চেদিরাজ উপরিচয় বসু ও স্বর্গ গণিকা অদ্রিকার কথা রয়েছে। কিন্তু এখানেই রয়েছে তথ্যগত বিরাট ভ্রান্তি। মহাভারতের কাহিনি অনুসারে চেদি রাজের বীর্য শ্যেন পক্ষী নিয়ে যাবার সময় তা নদীতে পতিত হয় এবং তা পান করেই গর্ভবতী হন মৎস্যরূপা অদ্রিকা। অদ্রিকাকে গর্ভবতী অবস্থায় ধীবররাজ দাশরাজ পেয়েছিলেন।

বাস্তবিক পালিত পিতা হলেন ধীবররাজই। কিন্তু উপন্যাসে পাচ্ছি যে - মৃগয়া কালে রাজা বসু প্রেমাসক্ত ও কামমোহিত হয়ে পড়েন। এবং অদ্রিকারই গর্ভজাত সন্তান হল সত্যবতী। উপন্যাসকার কল্পনার আশ্রয়েই তাঁর মূল উপজীব্য বিষয়কে প্রকাশ করবেন এটাই খুব দস্তুর কিন্তু তথ্যগত এমন বিভ্রান্তি থাকাটা কাম্য নয়। 

এই উপন্যাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও কৌতুকপূর্ণ দিক হল গণেশ ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মধ্যেকার কথোপকথন। মহাভারত রচনাকালে অনুলেখক গণেশ ও কথক বেদব্যাসের পারস্পরিক শর্তের কথা মহাভারতের সব পাঠকরাই অবগত। বেদব্যাস যখন চেদিরাজ ও অদ্রিকার (উপন্যাস অনুযায়ী) কামকেলির বর্ণনা দিচ্ছেন তখন কিছুটা বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েই গণেশ জিজ্ঞাসা করছেন ব্যাসদেবকে যে - 

“এই আপনার মহান ভারতবৃত্তান্ত, কবীশ! ধর্মপরায়ণ নরপতি ইন্দ্রিয়ের ফাঁদে পড়ে বেশ্যাগমন করছেন - শ্লোকের পর শ্লোক জুড়ে এই কামতাড়িত অধঃপতনের কাহিনি শোনাচ্ছেন, হায়! ... কামই যে ধর্ম- অর্থ- মোক্ষ সব আচ্ছন্ন করে ফেলল দেখতে পাই।”

 প্রত্যুত্তরে বেদব্যাস বললেন যে - 

“এই ভরতবৃত্তান্ত বাস্তবিকই ব্যাপ্ত হয়ে থাকবে নরনারীর বহুস্তরীয় সম্পর্কে - দেহসঙ্গম তাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে - ... এই সঙ্গম থেকেই ভরতকথার জন্য হল...।” 

কামই যে কীভাবে মানবজীবনের আরও বৃহত্তর অর্থে রাজনীতি ও সমাজের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে তারই এক-টুকরো কাহিনি আকারে বিধৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। রাজক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই কাম ও যৌনতা ঘুরেফিরে আসছে নানান মাত্রায়। 

আবাল্য ধীবর গৃহে প্রতিপালিতা হবার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সত্যবতীর শরীর হয়ে উঠেছিল শক্ত ও কর্মক্ষম। যা ঠিক কমনীয় 'লবঙ্গলতিকাতুল্য' সৌন্দর্য নয়, এক রকমের দৃপ্ত ‘ক্ষত্রাণীসুলভ’ মহিমা ছিল শ্যামলী সত্যবতীর। বলাই বাহুল্য যে, সে বহন করছে রাজরক্ত। ঠিক এই কারণেই তাঁর মানসিক গড়নটি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা।  তাঁর গভীর বেদনা নিয়তির অদ্ভুত নিয়ম নিয়ে যে তাঁর সহোদর ভ্রাতা রাজপরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছে। সে পরে যুবরাজ ও রাজা হবে।  কিন্তু তাঁকে প্রতিপালিত হতে হচ্ছে দরিদ্র ধীবর পরিবারে নির্মম কষ্ট ও দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে ! অপ্সরার কন্যা বলেই কি সে ব্রাত্য? সমাজের অদ্ভুত অনুশাসন যে একজন অপ্সরাকে ভোগ করা যায় কিন্তু তাঁর গর্ভজাত সন্তানকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।  ঔপন্যাসিক এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই শকুন্তলার প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন দাসরাজের বয়ানে যে - শকুন্তলাও বিশ্বামিত্রের সন্তান কিন্তু অপ্সরার গর্ভজাত বলেই তিনি স্বীকার করেননি। এমনকি সেই শকুন্তলাকে গোপনে দুষ্মন্ত বিবাহ করল অথচ অনেক কষ্ট করে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হল। ধীদীপ্ত সত্যবতী সঙ্গে সঙ্গে বলে যে - শকুন্তলার পুত্র ভরতই আর্যাবর্তের রাজবংশের জনক ছিল।  বর্তমান উত্তরপুরুষ মহারাজ শান্তনুর মধ্যেও সেই অপ্সরাজাত শকুন্তলারই রক্ত বইছে। 

দাসরাজ অনুমান করে সত্যবতীকে বলেন যে - তুই কি চাস না কোন ধীবর-পরিবারে বিবাহিত হতে? আনমনা সত্যবতী বলে যে - 

“আমার কানের মধ্যে কে যেন বারবার বলে, এ জীবন তোমার জন্য নয়...এই যে-জীবন তুমি কাটাচ্ছ ...! তোমার ভাগ্য লেখা আছে অন্যত্র, হয়তো বিশাল বিপুল কোনও রাজপুরীর ছায়াময় অলিন্দে ... জটিল ও মহান কোনও ঘটনার আবর্ত তোমাকে বন্দি করার অপেক্ষায় রয়েছে ... এক আশ্চর্য অবিস্মরণীয় নাটক বহু দূরে স্থির হয়ে আছে, শুধু তুমি গিয়ে পর্দাটুকু ওঠাও!”  

হয়তো এই কারণেই বলা হয় রক্ত কথা বলে। ধীবররাজের অনুমান অমূলক ছিল না। যুবরাজ দেবব্রত'র প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন সত্যবতী। সে তাঁর নিজের জন্ম বৃত্তান্ত অনাবৃত করে দেবব্রতের কাছে।  কিন্তু সে যেহেতু অপ্সরার গর্ভজাত তাই দেবব্রত দ্বিধান্বিত ছিলেন। সে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে আর্য বংশের রীতি নয় ধীবরপল্লি থেকে রাজবধূ সংগ্রহ করা। তৎক্ষণাৎ সত্যবতীও শকুন্তলার দৃষ্টান্ত আনয়ন করেছিল। যদিও দেবব্রতের একথা অজানা ছিল না যে ‘নিম্নবংশজাত’ সুকন্যাকে বধূ করে আনতে শাস্ত্রমতে কোন বাধা নেই। আর গান্ধর্ব বিবাহ তো শাস্ত্রসম্মত। উল্টোদিক থেকে একথাও সত্য যে সত্যবতীর রূপ,গুণ, মর্যাদা, ব্যক্তিত্বের অনন্য গুণে দেবব্রত নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট হয়েছে হয়েছিল। সে প্রকৃতই রাজবধূ হবারই যোগ্য।  কিন্তু দেবব্রতের কাছে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাশীরাজের জ্যেষ্ঠ দুহিতা অম্বার প্রতি তাঁর প্রণয়।  অর্থাৎ সে বাগবদ্ধ। সত্যবতী যখন তাঁর রূপের বর্ণনা চান তখন তা দেয় দেবব্রত। আসলে প্রেমে ব্যর্থ অভিমানিনী ক্রুদ্ধ সত্যবতী তাঁর মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিল।  তাঁর মনে হয়েছিল দেবব্রত তাকে বারবার বিদ্রুপ করছে; প্রথমে বংশ মর্যাদা নিয়ে দ্বিতীয়বার তার শরীরের মৎস্যগন্ধ নিয়ে। 

কিন্তু বাস্তবিক তো দেবব্রতের সেরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যা সত্য সে সেটাই অকপটে ব্যক্ত করেছিল সত্যবতীর কাছে। কোন ছল চাতুরি বা কামমোহিত হয়ে সে সত্যবতীকে গ্রহণ করেনি। এতে তার প্রেমাস্পদ অম্বার বিশ্বাস ও ভালোবাসার চূড়ান্ত অবমাননা হত। সে তো অন্যান্য রাজাদের মত ছিলেন না। এমনকি তার পিতা শান্তনুর মতোও নন। ঠিক এখানেই দেবব্রত অনন্য-সাধারণ।  কিন্তু মহাভারতের সবচেয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত পুরুষ কর্ণ। ভরতবংশের প্রাক্-ইতিহাসে সত্যবতীর সঙ্গে বাধা পড়ে গেলেন তিনিও। এরপর সত্যবতী একের পর এক লোভ ও স্বার্থের নীরব দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন তাঁর সঙ্গে। যার কারণ সেই সময় জেনেছিল শুধু তাঁরা দু'জনেই কিন্তু ছিল অপ্রকাশিত। এখান থেকেই কাহিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিল। 

রপরের ঘটনা প্রবাহকে আমরা মোটের ওপর সংক্ষেপে আলোচনা করব, 

। ক।   পরাশর মুনি ও সত্যবতীর মিলনে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম।  দীর্ঘদিন নারী সঙ্গ বিবর্জিত মুনি সত্যবতীর রূপ দেখে চূড়ান্তভাবে কামমোহিত হয়ে পড়েন। সত্যবতীও নিজেকে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন তাঁর কাছে। এটাই সত্যবতীর প্রথম যৌন ও শারীরিক সংসর্গ হলেও উদ্দেশ্য নিছকই যৌনতৃপ্তি ছিল না।  তিনি একরকম পরাশর মুনিকে ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন। মুনির আশীর্বাদেই তাঁর শরীর থেকে মৎস্যগন্ধ দূরীভূত হয় এবং সুগন্ধের অধিকারীণী হন। বহু দূর থেকে যে গন্ধ পাওয়া যেত।  পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ যৌবনেরও অধিকারী হন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় যে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছিল মুনির আশীর্বাদে বা যোগবলে তা হল ভরতবংশে প্রবেশের অধিকার -

 

“এত শতবার এই যমুনা নদীতে যাত্রীদের পারাপার করিয়েছিল সে -- কিন্তু তার অঙ্গযমুনাতে একটি যাত্রীকে একবার খেয়া পার করিয়েই তো সারা জীবনের পারানি মিলে গেল তার!”  

 সত্যবতীর জীবনতরী এবার এক অভূতপূর্ব বাঁক নেবার মুখে।

 । খ।   সত্যবতীকে দেখে শান্তনুর কামাসক্ত হয়ে পড়া, দাসরাজের অঙ্গীকার যে সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান ভিন্ন কেউ সিংহাসনের অধিকারী হবে না, পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য দেবব্রতের সিংহাসন ত্যাগ, সত্যবতীর কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়ে (কারণ সে আশঙ্কা করেছিল যে ভবিষ্যতে যদি জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রতের পুত্রেরা সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি করে !) দেবব্রতের আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার সংকল্প।

 প্রাথমিকভাবে সত্যবতীর সমস্ত ইচ্ছার বৃত্তই পরিপূর্ণ হল। এখন প্রশ্ন হল এত কিছু করে সত্যবতীর লাভ কী হল? তাঁর তো রাজবধূ হবার পথে তো ভীষ্ম কোন বাধাই দেননি! আসলে এখানে তীব্রভাবে কাজ করেছে সত্যবতীর প্রবল যৌন ঈর্ষা। আসলে মহারাজ শান্তনুকে সে বিবাহ করলেও তিনি তাঁর প্রণয়ীনি নন। তাঁদের বয়সের ফারাক ছিল অনেক। এই বিবাহ ছিল সত্যবতীর কাছে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার একটা হাতিয়ার। ভীষ্ম যখন আমাত্যের মুখে শুনেছিলেন যে তাঁর পিতা কোন এক ধীবর কন্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং বিবাহেচ্ছু তখনই বিচক্ষণ ভীষ্মের সত্যবতীর ভবিষ্যতের রূপরেখা বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

 আসলে সত্যবতী ভালোবেসেছিল (এবং আমৃত্যুই ভালোবেসেছিল) দেবব্রতকেই।  কিন্তু একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি তাঁদের প্রণয়ের সমস্ত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেয়। সত্যবতীর অন্ধত্ব ও একরোখা মনোভাবই এই ঘটনার জন্য ঐকান্তিকভাবে দায়ী। সে তখন থেকেই মনে মনে এই প্রতীজ্ঞায় অবিচল ছিল যে - আমি যেমন আমার প্রেমাস্পদকে পাইনি তেমনই আমিও ভীষ্মের প্রেমকে পরিণত হতে দেবো না।  এবং সে তাইই করে দেখাল। এই ছিল সত্যবতীর নীরব প্রতিশোধ। নিয়তির কী অদ্ভুত লিখন - যার হবার কথা ছিল পুত্রবধূ সে হল রাজবধূ ও ‘রাজমাতা’, প্রেমাস্পদ হল পুত্রতুল্য ! সত্যবতীর রাজবধূ হওয়া ইস্তক ভীষ্ম ‘রাজমাতা’ বলেই দস্তুর মাফিক সম্বোধন করত। আসলে এই ‘রাজমাতা’ শব্দবন্ধটির মধ্যে যে প্রচণ্ড মর্মঘাতী ব্যঙ্গের তীরটি আছে তা আঘাত করত সত্যবতীকে। ভীষ্মের অন্তরে যে পর্বতপ্রমাণ যন্ত্রণা ও বেদনা পুঞ্জীভূত হয়েছিল এবং তাঁর সমগ্র ভবিষ্যতের সমুজ্জ্বল সম্ভাবনা বিনষ্টীভূত হয়েছিল  শুধু এই সত্যবতীর জন্য তার অভিপ্রেত প্রতিশোধটুকু ভীষ্ম এইভাবেই তুলত। আর তা নীরবে সহ্য করতে হত সত্যবতীকে।  শুধু দু'জন নর-নারীর মধ্যে ক্ষমতার এই অসম ও অদৃষ্টপূর্ব প্রতিযোগিতা গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকে এক ক্রান্তিলগ্নে এনে দাঁড় করায়।

 । গ।  কিন্তু এও বাহ্য।  সত্যবতীর লক্ষ্য ছিল যত শীঘ্র সম্ভব পুত্রোৎপাদন।  কিন্তু বয়স্ক রাজার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছিল না।  তাই কবিরাজি গুপ্তৌষধি প্রয়োগ করে দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম দেন সত্যবতী।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু'জনেই ছিল যৌনক্ষমতা রহিত। কবিরাজ বলেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রের যৌনক্ষমতা কুড়ি বছরের পর থেকে কমতে থাকবে।  কবিরাজকে এই কথা গোপন রাখতে বলা হলেও তাকে পরে গুম খুন করা হয়।  কিন্তু সে ভীষ্মকে এইসব কথা বলে গেছিলেন। নিয়ম (অস্যার্থ হিসাব) অনুযায়ী রাজা হন অপরিণত মনস্ক দুর্বিনীত চিত্রাঙ্গদ। হঠাৎ একজন গন্ধর্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।  এই মৃত্যু কি ছিল কিছুটা কাঙ্ক্ষিত এবং একই সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পিত? মূল উদ্দেশ্য কি ছিল রাতারাতি যৌন অক্ষম চিত্রাঙ্গদকে সরিয়ে বিচিত্রবীর্যকে রাজা করে উত্তরাধিকার আনা? কারণ সত্যবতী দ্বিধান্বিত ও শঙ্কান্বিত ছিলেন যে বিচিত্রবীর্য যদি উত্তরাধিকার দিতে না পারে তাহলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এত দিনের লালিত ইচ্ছা সব বিফলে যাবে। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রহস্য ভীষ্মের মনে প্রশ্ন তুলে ছিল। কিন্তু এর উত্তর মহাভারতে পাওয়া যায় না। উপন্যাসকার খুব সুন্দরভাবে এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করে পাঠকের আগ্রহকে উস্কে দিয়েছেন।

 । ঘ।  প্রায় বাল্যাবস্থাতেই বিচিত্রবীর্যের (ইতিমধ্যেই সে সিংসাসনে আরূঢ়। এবং বলাই বাহুল্য সে অযোগ্য ও নামমাত্র শাসক) বিবাহ দেওয়া হল। কাশীরাজের স্বয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে আনা হল তাঁর তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে।  তাঁর ক্ষাত্রোচিত পরাক্রমে মনে মনে তিন কন্যাই অভিভূত হয়েছিলেন।  স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভেবেছিলেন যে ভীষ্ম তাঁদের বিবাহ করবে।  কিন্তু বাস্তবটা তাঁরা তখনও জানতেন না। অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হল।  কিন্তু সন্তান সে দিতে পারল না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত যৌন সংসর্গের ফলে (কিছুটা বিকৃতকামও বটে। তাঁর নাম থেকেই তির্যক ইশারা পাওয়া যায়) তাঁরও অকালপ্রয়াণ ঘটল। গোটা ভারতবংশ এক অভূতপূর্ব ও বিচিত্র সঙ্কটের মুখে পড়ল।  এবার সিংহাসন সামলাবে কে ?

 সত্যবতী যে স্বপ্নের সৌধটি নির্মাণ করেছিল নিয়তি যেন বারবার তা চুরমার করে দিচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা (বস্তুত লোভ), স্বার্থমগ্নতা শুধু তাঁকে নয়, গোটা রাজবংশকে এই বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি করেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের তৈরি করা সমাধি ক্ষেত্রেই। এবার কী হবে? কারণ তখন উপায় একটাই ভীষ্মকে রাজা করে দেওয়া। এক্ষেত্রে সত্যবতী যদি তাঁর শর্ত তুলে নেয় তবেই তা সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি তা হতে দেবে সত্যবতী? কারণ তাহলে তো তাঁর এতদিনকার সমস্ত শ্রমই বিফলে যাবে! সে তা হতে দিল না কারণ --

 

“যে-দেবব্রতর বংশগৌরবে কালিমালেপন করার মানসে সত্যবতী ভরতজাঙ্গালে অনার্য রক্তধারা প্রবাহিত করলেন, সেই দেবব্রতর বীর্যই আবার ফিরিয়ে আনবে আর্য গরিমা? তার আত্মজদের হাত ধরেই আবার স্বপথে প্রত্যাবর্তন করবে বিপথগামী গৌরবমহিমার উত্তরাধিকার?”

 হ্যাঁ ঠিক এটাই ছিল তাঁর অন্তর্নিহিত অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য। তিনি অনার্য রক্ত আরো নির্দিষ্ট করে বললে দাসরক্তকে অনুপ্রবিষ্ট করাতে চেয়েছিলেন ভরতবংশে।

 ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়ানমিক ক্যারেক্টার সত্যবতী ছিল বস্তত তাই।  ভাগ্য বা নিয়তি তাঁকে যতবার কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে সে ততবারই অভিনব এক একটি অভাবনীয় পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেছে। সে যেন কিছুতেই ভাগ্যের কাছে হার মানবে না। সে অংশত হলেও সফল হয়েছে।

 কেন বলছি এ কথা? কেননা এরপর তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন তাঁর কুমারীবস্থায় গর্ভবতী হবার কথা।  তাঁর পুত্র বেদব্যাসের কথা তিনি বললেন।  স্বীয় পুত্রকে প্রতিপালন না করলেও তাঁর অলৌকিক যোগশক্তি ও অতুলনীয় মেধার কথা শুনেছিলেন।  তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর এই কানীন পুত্রই পারে এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ দিতে। এটাই ছিল তাঁর শেষ তূণ, শেষ অস্ত্র।  বেদব্যাসের ঔরসেই গর্ভবতী হয়েছিল অম্বিকা ও অম্বালিকা।  এবং একজন দাসী।  এঁদেরই পুত্র যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর।  এঁদের জন্ম নিয়ে বিস্তারে আমরা যাব না।  শুধু এটুকু স্মরণযোগ্য যে বিদুর বাদে বাকি দু'জনেই ছিলেন শারীরিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। সবচেয়ে লক্ষণীয় শূদ্র দাসীর গর্ভেই জন্ম নিলেন সবচেয়ে প্রাজ্ঞ,ধীমান, দীর্ঘায়ু ও ধার্মিক বিদুর। একথা ঠিক যে সত্যবতী পূর্ণ সফল হলেন না কিন্তু দাসরক্তকে ঘুরে পথে আর্য বংশে প্রবাহিত করিয়েই ক্ষান্ত হলেন। মহাভারতের স্রষ্টা বেদব্যাসের ধমনীতেও তো সেই দাসরক্ত বইছে।  কাজেই এই চরিত্রটি মহাভারতের এক অনস্বীকার্য স্তম্ভ।  একজন নারীর অস্খলিত ধৈর্য নাছোড়বান্দা মনোভাব গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকেই ওলটপালট করে দিল। সরলরৈখিক গতিকে জটিল করে দিল।  প্রস্তুত হল ভবিষ্যৎ কুরু ও পাণ্ডবের দীর্ঘ কুটিল সংগ্রামের ক্ষেত্র।  যার যবনিকাপতন ঘটবে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে।  কিন্তু সে অন্য ইতিহাস !

 শেষ করা যাক উপন্যাসকারের উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও একটি দৃশ্যকল্প দিয়ে,

 । এক। ধীদীপ্ত গণেশ প্রশ্ন করছেন বেদব্যাসকে অম্বিকা ও অম্বালিকা গর্ভবতী হলেন কিন্তু সাধারণ নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছা আবেগকে বলি দেওয়া হল রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে; কার্যত বলাৎকার করাই হল তাঁদের। বেদব্যাস কি নিযুক্ত হলেন না সেই ধর্ষণকারী পীড়কের ভূমিকায়? এর কোন উত্তর তিনি দিলেন না। মহাভারতে এই কূট প্রশ্নের কোন উত্তর নেইও। আরো একটি বিব্রতকারী প্রশ্ন করলেন আপনি জিতেন্দ্রিয় ও কখনো রমণী সংসর্গ না করেই এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে প্রথম সঙ্গমেই গর্ভাধান! বেদব্যাস বললেন অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে রতি শাস্ত্রও আমাকে পড়তে হয়েছে। ঔপন্যাসিক কৌতুককে আর একটু বাড়ানোর লক্ষ্যে গণেশের বয়ানে বললেন যে - নিশ্চয়ই দ্বীপের অধিবাসী কোন রমণী আপনার কাছে এই শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে ‘কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে আর যে-কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য আসুক, শয্যায় তা সম্ভব নয়।’

 । দুই।  উপন্যাসের শেষে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চুরমার হয়ে যাওয়া সত্যবতীকে পাই। একজন নারী নিজের হাতে গড়ে তোলা পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় যেন নিজেই বন্দি হলেন।  সমাজে এক শ্রেণির নারীর স্বাধীনতা, সম্মান এবং এমনকি ক্ষমতাও যে কতখানি ছিল তাঁর স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে সত্যবতীর মধ্যে।  এ যেন এক অন্য সত্যবতীর ছবিকে অনবদ্যভাবে প্রতিকায়িত করেছেন লেখক।  যাঁর হাত ধরে গোটা ভারতবংশের ইতিহাসের এক অপ্রত্যাশিত মোড় ঘুরে গেল।  নির্মিত হবে কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের পটভূমি। যার যবনিকা উত্তোলিত হবে কুরুক্ষেত্রে কিন্তু সে তো অন্য ইতিহাস।

সুমন ব্যানার্জি



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.