লিখেছেন
সু ম না সা হা
ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে রাজত্ব করেছেন বহু রাজারাজরা। কেউ কল্যাণ-কর্ম দ্বারা
প্রজারঞ্জক রূপে মানুষের হৃদয়-সিংহাসনে স্থান পেয়েছেন, কেউ বা বেহিসেবী ভোগে জীবন অতিবাহিত
করেছেন, কেউ বা অত্যাচারী-প্রজাপীড়ক রূপে কালের কষ্টিপাথরে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তবে অধিকাংশ
রাজা ও সম্রাটরা ছিলেন গুণগ্রাহী, নৃত্যগীতাদি কলার পৃষ্ঠপোষক। বহু প্রসিদ্ধ গায়ক-গায়িকা,
নর্তকী ও কলাকারের জীবন ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না। কিন্তু জীবনে যখন ঘটে মহাজীবনের
সংযোগ, তখন সে-জীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। এমনই এক রাজনর্তকীর জীবন ধন্য হয়েছিল পরশমণির
ছোঁয়ায়, শিবাবতার স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং যাঁকে ‘মা’-এর আসন দিয়েছিলেন।
খেতরিরাজের ওয়াকত রেজিস্টার মতে, মহারাজা অজিত সিংহ ১৮৯১ সালের ৪ জুন থেকে ২৩ শে জুলাই পর্যন্ত প্রায় দু’মাস আবুপাহাড়ের খেতরি হাউসে অবস্থান করছিলেন। তারপর স্বামীজীকে সঙ্গে নিয়ে মহারাজা খেতরিতে উপস্থিত হন ৭ই আগস্ট ১৮৯১। পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা জানিয়েছেন (মুনসি জগমোহনলালের কাছ থেকে তিনি যেমন শুনেছেন)—
“৯ই আগস্ট ১৮৯১, রবিবার রাজকর্মচারীরা মহারাজাকে সেলাম আলম (অভিবাদন) জানাতে জমায়েত হয়। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে রাজাসাহেব এলে রাজস্থানী নিয়মানুসারে রাজকর্মচারীগণ তাঁকে নজরানা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হয়। স্বামীজী মহারাজার সঙ্গে বেলা ২ টা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। মহারাজা বিকালে টেনিস খেলতে যান। সন্ধ্যার সময় তিনি পার্ষদসহ ফিরে দোতলার দেওয়ানখানার ছাদে বিশ্রাম নিতে আসেন। এই দোতলা সংলগ্ন তিনতলার কুটিরটি নির্ধারিত ছিল স্বামীজীর জন্য। তখন সন্ধ্যা সাতটা। মহারাজা স্বামীজীকে আহবান জানালেন। স্বামীজী দোতলার বারান্দায় উপস্থিত হলে উভয়ে শাস্ত্র-আলোচনায় মগ্ন হন। এমতাবস্থায় একদল নর্তকী মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। (ওয়াকতনামা থেকে আরও জানা যায় যে, একদল নর্তকী তথা সঙ্গীতজ্ঞা রাজদরবার কর্তৃক প্রতিপালিত হতো। সকলের নাম পাওয়া না গেলেও রাজবাড়ির নর্তকীগোষ্ঠীর তিনজনের নাম পাওয়া গেছে—ময়নাবাঈ, ভামরিবাঈ ও জানকিবাঈ)। ঐ দলের নেত্রী মহারাজাকে বলেন, তিনি কি মহারাজার কাছে একটি ভজন গান গাইতে পারেন? (পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন, ‘সমাগত নর্তকীয়োঁ কে দল কী এক সুগায়িকা নে জিসকা যৌবন সুলভ চাপল্য প্রৌঢ়তা কী গম্ভীরতা কে রূপ মে বদল চুকা থা, গানা সুনানে কী আজ্ঞা মাগী’, পৃষ্ঠা-৫৮) মহারাজা নর্তকীকে সম্মতি জানালে ময়নাবাঈ বীণা হাতে সুরদাসের ‘হমারে প্রভু অবগুণ চিত ন ধরো’ ভজনটি গাইতে আরম্ভ করেন। স্বামীজী তখন সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। কিন্তু ময়নাবাঈ-এর গানের কলি তাঁর গতি শিথিল করে। তিনি ফিরে আসেন এবং আসর বসে গায়িকার ভজন শোনেন।”
সন্ন্যাসীর পক্ষে ঐরকম নাচগানের আসরে উপস্থিত থাকা অনুচিত, এই যুক্তিতে স্বামীজী গানের আসর থেকে উঠে যাচ্ছিলেন, মর্মাহত হয়ে গায়িকা যেন স্বামীজীর কথার নীরব প্রতিবাদস্বরূপ সুকণ্ঠে গান ধরলেন—‘প্রভু, হমারে অবগুণ চিত না ধরো/সমদরশী হ্যায় নাম তিহারো, অব মোহে পার করো।’ গানের ভাষা রাজস্থানী হিন্দি হলেও স্বামীজী তা ভালোই বুঝতেন, আর সঙ্গীতের তিনি আজীবন রসগ্রাহী। গানের মধ্যে দিয়ে গায়িকা এই কথাই বললেন,
‘তুমি যে সন্ন্যাসী, সমদর্শীত্ব সাধুর ধর্ম। লোহার বঁটি—তা দিয়ে ঠাকুরঘরে পূজার নৈবেদ্যর ফল কাটা হয়, আবার ব্যাধের ঘরে ঐ বঁটি মাংস কাটার কাজে ব্যবহার হয়—এতে বঁটির কি দোষ? পরশমণি ছুঁয়ে দিলে উভয়ই সোনা হতে পারে। অতএব, হে প্রভু, তুমি আমার দোষ দেখো না!’
সঙ্গীতের এই হৃদয় মন্থনকারী অপূর্ব মর্মার্থ স্বামীজীকে আকুল করে তুলল। তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ নারী মাত্রই জগন্মাতার প্রকাশ দর্শন করতেন, এমনকি পতিতা ও কুচরিত্রা রমণীর মধ্যেও তিনি জগজ্জননীকেই দর্শন করেছিলেন। স্বামীজীর এক সত্য উপলব্ধি হল—‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—এই হল অদ্বৈত অনুভূতির চরম লক্ষ্য। এক ব্রহ্ম বিরাজিত সর্বত্র—ভেদবুদ্ধি কল্পনা মাত্র। অতএব তিনি সঙ্গীতের আসরে উপস্থিত হলেন। গান সমাপ্ত হলে তিনি ঐ বাঈজীকে ‘মা’ সম্বোধন করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন,
‘মা, আমি অপরাধ করেছি, আপনাকে ঘৃণা করে উঠে যাচ্ছিলাম। আপনার গানে আমার চৈতন্য হল।’
পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন,
‘গানা সমাপ্ত হুয়া, স্বামীজী গদ্গদ হো গয়ে। উনকে নেত্র সে অশ্রুধারা বহ্ চলী। স্বামীজী কে মুঁহ্ সে তৎকাল নিকল পঢ়া—ওহ, ইস পতিতা স্ত্রী নে এক ভক্ত কা পদ গাকর ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—কে তত্ত্ব কো হৃদয়ঙ্গম করা দিয়া হ্যায়। ... উসকে বাদ উস গায়িকা কো স্বামীজী নে ‘জ্ঞানদায়িনী মা’ কহকর সম্বোধন কিয়া, বেশ্যা কা হৃদয় সে নিকলা ভাবগর্ভিত আশীর্বাদ ‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল’।
‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের বিবরণ অনুসারে, পরে এই ঘটনার উল্লেখ করে স্বামীজী বলেছিলেন,
‘গানটি শুনে আমার মনে হল, এই কি আমার সন্ন্যাস? আমি সন্ন্যাসী, অথচ আমার ও এই নারীর মধ্যে আমার ভেদজ্ঞান রয়ে গেছে, সে ঘটনাতে আমার চোখ খুলে গেল। সর্ব বস্তু সেই এক সত্তার অভিব্যক্তি জেনে আমার আর কাউকে নিন্দা করার জো ছিল না।’
ঘটনাটি সামান্যই, কিন্তু রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা ও ভারতীয় সনাতন ধর্মে সন্ন্যাসীর উচ্চ আদর্শ বুঝবার পক্ষে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বামীজী পেলেন সকল নারীতে মাতৃদর্শনের বাস্তব পাঠ। আর ময়নাবাঈ কী পেলেন? তিনি স্বামীজীর মধ্যে পেলেন তাঁর ‘নন্দলালা’-কে। সেদিনই গান সমাপ্ত হলে স্বামীজী যখন তাঁকে ‘মা’ সম্বোধন করেছিলেন, ময়নার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত আশীর্বাণী ঝরে পড়ে—‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল!’ (ঐ, পৃষ্ঠা-৬০)। স্বামীজীর অন্তরের শ্রদ্ধাসঞ্জাত সেই ‘মা’ ডাক নারীর চিরন্তন মাতৃত্ববোধের মর্মমূল স্পর্শ করেছিল, আর সেই মায়ের আশীর্বাদ যে কতদূর সত্য হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বামীজী লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন ও থাকবেন যুগ যুগ ধরে। আর নন্দলালার সঙ্গে বেঁচে থাকবেন তাঁর যশোদামাঈ। ময়নার জীবনের পরবর্তী পর্ব খুব লোকই জানে। পরশমণির ছোঁয়ায় লোহা সোনা হয়ে যায়। আর ময়না ছিলেন ভক্তিমতী এক সুরসাধিকা। তাই অতি অনায়াসে তাঁর জীবনে প্রবেশ করেছিল বিবেকানন্দ নামক সেই উজ্জ্বল-ভাস্করের জ্যোতিকিরণ। যে গবাক্ষ-পথে এল সেই কোটি-ভানু-কিরণ, কৃপা-দাক্ষিণ্যের দক্ষিণাপবনবাহী সেই বাতায়নটি উন্মোচন করেছিলেন অবশ্যই খেতরি-রাজ অজিত সিংহজী।
আমরা চলে যাই ময়নাবাঈ-এর জীবনের ফ্ল্যাশ-ব্যাকে। জয়পুরের মেয়ে সরমা কাংক্ষানিয়া
ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে ভাগ্যের ফেরে পৌঁছে যায় চাঁদপোল বাজারে কেরামতি বাঈজীর
কাছে। বাঈজী তাকে সস্নেহে লালন-পালন করে নাচ-গানে তালিম দিতে থাকেন। যৌবনে সঙ্গীতে
ও নৃত্যে অসামান্যা পারদর্শিনী সরমা ‘ময়নাবাঈ’ নামে হয়ে ওঠেন বাঈজী সমাজে ‘আনমোল-হীরা’।
কোনও রাজাই এমন গুণী শিল্পীর কদর করতে পারবেন জেনেই কেরামতিবাঈ তাকে পাঠালেন যোধপুর
রাজদরবারে। ময়নাবাঈ যোধপুর রাজপ্রাসাদে ঠাঁই পেলেন। যোধপুর রাজ-পরিবারের গুরু ছিলেন
আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী। এই সংবাদ পেয়ে রাজগুরু দয়ানন্দজী ময়নাবাঈ-এর
যোধপুরে অবস্থান না-মঞ্জুর করে দিলেন। যোধপুররাজ এমন গুণী শিল্পীকে হারাতে চাননি, কিন্তু
রাজগুরুর নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধাও দেখাতে পারেননি। তাই পাশের রাজ্যের প্রিয় বন্ধু
খেতরির রাজা অজিত সিংহজীকে অনুরোধ করেন ময়নাবাঈ-এর দায়িত্ব নিতে। অজিত সিংহ ছিলেন দক্ষ
বীণাবাদক ও প্রকৃত সঙ্গীত-রসজ্ঞ। তিনি ময়নাবাঈ-এর প্রতিভাকে সম্মান জানালেন এবং রাজ্যে
নবাগতা এই শিল্পীর বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। খেতরি রাজ্যে শুরু হল ময়নাবাঈ-এর নতুন
জীবন—রাজার খাস গায়িকা রূপে উৎসবে অনুষ্ঠানে বিশেষ পালাপার্বণে তার ডাক পড়ে রাজদরবারে,
সঙ্গীতলহরী পরিবেশন দ্বারা রাজা, রাজ-অতিথি ও অমাত্যবর্গের মনোরঞ্জনের ফরমায়েস হয়।
অন্যান্য সময়ে শহরের নির্দিষ্ট বাসগৃহে ফরমায়েসী সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। দিনগুলো
এমনি করেই কাটছিল। গজল-ঠুমরী রেওয়াজের সুরে মুখরিত, আতর-গুলাব সুবাসিত ময়নাবাঈ-এর বাড়ি
খেতরি রাজ্যের জোয়ান-মদ্দ সকলেরই পরিচিত।
কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে ময়নার জীবনের বাঁক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রচনা করছিলেন।
ময়নার গান শুনে, বেদান্তের ‘প্র্যাকটিকাল’ পাঠ হৃদয়ঙ্গম করে সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষির চোখ
ভরে এল জলে, তিনি ময়নাকে ডাকলেন ‘মা’ বলে—সন্ন্যাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত সে সম্বোধন কেবল
কথার কথা নয়, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত সত্য, তা যেন ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’
আসার মতোই ময়নার অন্তরের সুপ্ত মাতৃত্বের রুদ্ধ দুয়ারে হানলো আঘাত! তার মনোরাজ্যে জলপ্রপাতের
অঝোর ধারার মতো আরম্ভ হল বিপুল আন্দোলন।
এরপর দ্বিতীয়বার স্বামীজীর খেতরিতে আগমন বিশেষ উপলক্ষে। তখন বিশ্ব-ধর্মমহাসম্মেলনে
যোগদান করতে স্বামীজীর পাশ্চাত্য যাত্রার আর খুব বেশী দিন বাকি নেই। কিন্তু যাত্রার
আগে একবার তাঁকে খেতরিতে পদার্পণ করতেই হবে—শিষ্য, পরম হিতৈষী, অনুরাগী সুহৃদ রাজা
অজিত সিংহ-এর এই অনুরোধ তিনি কি করে ফেলবেন? স্বামীজীর আশীর্বাদে অপুত্রক রাজা ও রানীর
পুত্রসন্তান লাভের দীর্ঘকালের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, ছেলে জয়সিংহ-এর জন্মোৎসবে যোগদান
করে স্বামীজী শিশুপুত্রকে আশীর্বাদ করবেন—খেতরি রাজের একান্ত বাসনা। সেই উপলক্ষ্যে
অল্পসময়ের জন্য স্বামীজীকে খেতরিতে ধরে এনেছেন অজিত সিংহ-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মুন্সি
জগমোহন। সেইবার ১৯ দিন খেতরিতে ছিলেন স্বামীজী—২১ এপ্রিল থেকে ১০ই মে, ১৮৯৩। সেই জন্মোৎসব
উপলক্ষে সুসজ্জিত পান্নাতালাব সরোবরে একটি সুশোভিত নৌকার উপরে নিমন্ত্রিত রাজন্যবর্গসহ
উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মহারাজা এবং ভজন পরিবেশনকারী নর্তকীদের দল। সেখানেই জগমোহনলাল
স্বামীজীকে নিয়ে রাজসকাশে উপস্থিত হলেন, রাত্রি দশটা পর্যন্ত নৌকায় অবস্থান করে মহারাজা
ও স্বামীজী পান্নাতালাব ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। সেদিনও স্বামীজী
প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন ময়নাবাঈ-এর সুরেলা কণ্ঠের গীতসুধা। সব কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার
পরে স্বামীজী জয়পুর হয়ে বোম্বাই রওনা হলেন।
ময়নাবাঈ-এর কণ্ঠে গীত সুরদাস রচিত একটি ভজন স্বামীজীর খুবই প্রিয় ছিল, ‘দয়ানিধে তেরি গতি লখি ন পরে/ধর্ম অধর্ম, অধর্ম ধর্ম করি,/অকরণ করণ করৈ’। এই গানটি ও ময়নাবাই-এর কণ্ঠে তাঁর প্রথম শ্রুত ভজনটি, ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত না ধরো’, যেটি তাঁর সকল নারীতে মাতৃদর্শনের পাঠ সম্পূর্ণ করেছিল—দুটিই তিনি নিজের নোটবই-এ টুকে রাখেন ও পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিব্রজনকালে অনুরুদ্ধ হয়ে গেয়ে শোনাতেন। ‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’ নিবন্ধে স্বামী বিদেহাত্মানন্দ লিখেছেন, ‘স্বামী অখণ্ডানন্দজী বলেন, স্বামীজী যখন জুনাগড়ে ছিলেন, তখন ঝান্ডুভটজী স্বামীজীর কণ্ঠে ‘দয়ানিধে তোরি গতি...’ ভজনটি শুনে কেঁদেছিলেন। জামনগরে শংকর শেঠ প্রতিদিন ভজন শোনার জন্য মূলজী নামে জনৈক ব্রাহ্মণ গায়ককে বহাল রেখেছিলেন। মূলজী স্বামীজীর স্নেহধন্য এবং স্বামীজীর কাছ থেকে বহু ভজন রপ্ত করেছিলেন। কাথিওয়াড় ভ্রমণকালে অখণ্ডানন্দজী এক সম্পন্ন গ্রামে হাজির হলে তিনি মূলজীর কণ্ঠে ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’, ‘দয়ানিধে তোরি গতি’ এবং ‘শশধর তিলক ভাল গঙ্গা জটাপর’ গান তিনটি শুনেছিলেন। বলা বাহুল্য এই গানগুলি স্বামীজীর কাছ থেকেই মূলজীর শেখা। ১৮৯৩ সালে মাদ্রাজে মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে স্বামীজী ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’ ভজনটি গেয়েছিলেন। ডঃ এম সি নাজুন্ডা রাও তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘সাগরতটে চাঁদিনী রাতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল থেকে এক অপরূপ জ্যোতি বিকীর্ণ হতো। সেই সময় তিনি হৃদয়স্পর্শী ভজন গাইতেন। সেই ভজনগুলির মধ্যে ‘দয়ানিধে তেরী গতি লখি ন পড়ো’ বিশেষ স্মরণীয়।’
১৮৯৭ সাল, ডিসেম্বর মাসে স্বামীজী খেতরি এলেন তৃতীয় বার। সেবার মহারাজাও
ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ও তাঁর গুরু বিবেকানন্দও পাশ্চাত্যবিজয় সম্পন্ন করে স্বদেশে
ফিরেছেন। খেতরিবাসী মহারাজাসহ রাজগুরু স্বামীজীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পান্নাতালাব
সংলগ্ন ময়দানে ১২ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। স্বামীজী ও অন্যান্য
কেউ কেউ সেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপরে রাজনর্তকীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানের
মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ময়নাবাঈ। স্বামীজী আগাগোড়া রাজাজীর সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ময়না স্বামীজীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের আবেদন জানালো রাজাজীর কাছে। স্বামীজীর
সম্মতি পেয়ে ময়না এল, দর্শন ও প্রণামান্তর প্রকাশ করল তার অন্তরের আকুল প্রশ্ন—‘স্বামীজী,
মেরে লালা, আমাদের কি মুক্তি হবে না?’ এর ঠিক কয়েক দশক আগে ‘চৈতন্যলীলা’ পালা দর্শনে
চৈতন্যের সাজে বিনোদিনী-কে দেখে যখন আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—‘আসল-নকল একাকার
দেখলাম!’ এই একই আকুল প্রশ্ন ধ্বনিত হয়েছিল নটী বিনোদিনীর কণ্ঠে। পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ
নটী বিনোদিনীকে দিয়েছিলেন উদ্ধারের মন্ত্র—‘বল্ মা, গুরু হরি হরি গুরু!’ স্বামীজী ময়নার
সংশয় দূর করে উত্তর দিলেন, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে সকলের মুক্তির
পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কেবল তাঁর স্মরণ-মনন কর!’ ময়না আরও জানতে চায়—‘মনের সংশয় অশান্তি
কিভাবে দূর হবে লালা?’ স্বামীজী নিদান দিলেন, ‘তীর্থভ্রমণ কর এবং সাধ্যমত অনাথদের সেবা
কর। তাহলেই অফুরন্ত আনন্দ ও শান্তির সন্ধান পাবে।’
স্বামীজীর আশ্বাস পেয়ে ঘুচে গেল ময়নার মনের সংশয়ের আঁধার-মেঘ। তীর্থভ্রমণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তাঁর মন। মহারাজা অজিত সিংহ তাকে অনুমতি দিলেন, পাথেয়ও জোগালেন। ময়নাবাঈ তার বান্ধবী ভামরিবাঈকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তীর্থদর্শনে। গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে তাঁরা পৌঁছালেন নৈনিতাল। সেখানেই তখন অবস্থান করছিলেন ময়নার জীবন-দেবতা। এক মন্দিরে সে সংবাদ তাঁরা পেলেন। অনেক সন্ধান করে অবশেষে স্বামীজীর সাক্ষাৎ মিলল। সিস্টার নিবেদিতা তাঁর The Master As I Saw Him গ্রন্থে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন—
‘আমরা নৈনি সরোবরের উপর অবস্থিত একটি মন্দিরে দুই বাঈজীকে পূজায় রত দেখিলাম। পূজান্তে তাহারা আমাদের নিকট আসিল এবং আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় তাহাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিলাম। স্বামীজী তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে অস্বীকার করায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মনোমধ্যে একটা আন্দোলন চলিয়াছিল, কিন্তু স্বামীজী গ্রাহ্য করেন নাই।’
ভামরিবাঈ জানিয়েছেন, তাঁরা তীর্থদর্শনকালে
স্বামীজীকে দর্শন ও প্রণাম করেছিলেন এবং স্বামীজী তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন। তীর্থ
পর্যটন সেরে ময়নাবাঈ ও ভামরিবাঈ আবার গতানুগতিক জীবনস্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন।
এরপর তাদের জীবনে পরপর ঘটে গেল দুটি হৃদয়বিদারী দুর্ঘটনা। ১৯০১ সালে একটি দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত হলেন তাদের পরম শুভাকাংক্ষী অভিভাবক রাজা অজিত সিংহজী। পরের বছর আরাধ্য দেবতা স্বামীজীও পরমধামে যাত্রা করলেন। শোক-বিহ্বল ময়নাবাঈ কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন খেতরি ছেড়ে পা বাড়ালেন অনির্দিষ্টের পথে। খেতরির প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা গেছে যে তাঁরা ময়নাবাঈকে বৃন্দাবনে ভিখারিনীর বেশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। সেখানে তিনি ভজন ও কীর্তন গেয়ে ভিক্ষা করতেন, ভিক্ষালব্ধ অর্থে কয়েকটি অনাথ বালককে পালন করতেন। স্বামীজীকে জীবনের ধ্রুবতারা করে তিনি তাঁর নির্দেশেই পথ চলছিলেন। ঐ অনাথ বালকরা ময়নাকে ডাকত ‘দেবী মা!’ ময়নার জীবন মাতৃত্বের সুধায় ভরে উঠেছিল। বালকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে খেতরি থেকে তিনি ভামরিকেও নিজের কাছে আনিয়ে নিয়েছিলেন। দুই সখী মিলে বহু পরিশ্রমে সেই অনাথ-আশ্রমটি চালাতে থাকেন। এর অনেক পরে বৃদ্ধাবস্থায় ময়না অসুস্থ হয়ে পড়লে ময়নার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ভামরি তাঁকে খেতরির পুরনো আস্তানায় রেখে আসেন।
স্বামীজীর সঙ্গে যখন ময়নার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তখন সে ২১ বছরের পূর্ণ যুবতী।
খেতরি রাজের বদান্যতায় খেতরি সবজিমাণ্ডির পাশে কানুরিয়া হাভেলি-তে বাঈজীদের বসবাসের
ব্যবস্থা হয়েছিল। ঐ এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা যায়—‘এই বাঈজী কুটিরটি কোন
অজানা যাদুস্পর্শে পালটে গিয়েছিল, সেখানে মুজরোর ঘুঙ্গুর-ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে বেজে উঠেছিল
শংখঘণ্টা। সন্ধ্যায় আতরগন্ধের বদলে ছড়িয়ে পড়েছিল ধূপের গন্ধ। সুরেলা চটুল সঙ্গীত হারিয়ে
গিয়েছিল ভক্তিরসাশ্রিত কৃষ্ণ-আরাধনার ভজনে। শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রীমা-স্বামীজীর পট স্থাপন
করে তাঁদের সাধনভজনেই শেষের দিনগুলো যাপন করেছিলেন বৃদ্ধা সাধিকা ময়না।
১৯৬২ সালে ৯২ বছর বয়সে স্বামীজীকে, তাঁর ‘নন্দলালা’-কে স্মরণ করতে করতে
ময়নাবাঈ থেকে যশোদামাঈ-এ উত্তীর্ণা এই সাধিকা রামকৃষ্ণলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ কথা—‘আমার কোন ভয় নেই, আমার কোন আকাংক্ষা নেই, আমার কোন দুঃখ
নেই—স্বামীজী যে মেরা নন্দলালা।’ শাস্ত্রবাণীর চিরন্তন সত্য মূর্ত হয়েছিল তাঁর জীবনে—‘অভী’-তে
প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন তিনি, নির্বাসনা হয়েছিলেন, তিনি দুঃখের তিমির-রাত্রি পেরিয়ে অনন্ত
আনন্দলোকের ভূমিতে বসতি গড়েছিলেন—কারণ অবতীর্ণ ঈশ্বর স্বামী বিবেকানন্দকে তিনি পুত্র
জ্ঞান করেছিলেন।
এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে একটি জীবন ‘বিবেকানন্দ সূর্য’-এর কিরণে স্নাত হয়ে
মানবজীবনের পরম সার্থকতা লাভ করেছিল।
সুমনা সাহা |
তথ্যসূত্র—
- Swami Vivekananda: A forgotten Chapter of His Life—Beni Shankar Sharma; Sharman Publishers, 1963
- ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’, স্বামী গম্ভীরানন্দ, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠা-৩৩৯-৪০); উদ্বোধন কার্যালয়, মে ১৯৮৪।
- উদ্বোধন পত্রিকা, আশ্বিন-১৪২০, নবম সংখ্যা (সেপ্টেম্বর-২০১৩); ‘স্বামীজী-সান্নিধ্যে রাজপুতানার তিন কন্যা’—তড়িৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
- ‘বিবেক জ্যোতি’ পত্রিকা; নিবন্ধ—‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’—স্বামী বিদেহাত্মানন্দ; জুলাই-সংখ্যা, ২০০৬।
- রাজস্থান মে স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা, মিলাওয়াড়া সংস্কৃতি প্রকাশন, নিউ দিল্লী, (প্রথম প্রকাশ-১৯৮৯)
এমন মহান জীবন এর পায়ে অনন্ত প্রনাম । খুব ভালো লাগলো পড়ে, কদিন আগেই খেত্রীর মহারাজ এর সাথে গুগল মিট এ ক্লাস করার সময় বলছিলেন, আর আজ এই লেখাটি যেন ঈশ্বর ঠেলে দিলেন । অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। জয় ঠাকুর।
ReplyDeleteখুব তথ্য বহুল লেখা।ভীষণ ভালো লাগলো
ReplyDelete