লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী
[চিন সমুদ্রে মধ্যরাতের ভয়ঙ্কর
ঝড়ে টলমল জাহাজে, যখন ক্যাপ্টেন থেকে আরম্ভ করে কনিষ্ঠতম নাবিক পর্যন্ত সকলেই দাঁতে
দাঁত চেপে মরিয়া হয়ে লড়ছে, সেই মুহূর্তে একজন কবি, তাঁর বয়স ছাপ্পান্ন, সেই মহাদুর্যোগ
দেখতে দেখতে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে কথা ও সুর একসঙ্গে রচনা করে গাইছেন, "তোমার
ভুবনজোড়া আসনখানি - আমার হৃদয়মাঝে বিছাও আনি--" তখন, গানটি শতবার শোনা থাকলেও
আমাদের বুকের ভিতর দুরুদুরু করে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গান রচনার পিছনে নানা রকম
কাহিনী আছে, সেই কাহিনীগুলি তাঁর গানকে ভালো করে বুঝতে নানা দিক থেকে আমাদের সাহায্য
করে। এই অভিপ্রায় থেকেই সদ্য প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়, তাঁর রবীন্দ্র গানের অভিমুখের
চর্চার সূত্রপাত করেছিলেন, বাকিটা আজ ইতিহাস।]
তাঁর গানের সন্ধানের সঙ্গী তাঁরই
অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠক। তাঁর বিষয় ভাবনার বিন্যাস এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে প্রমথ
চৌধুরী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অমিয়নাথ সান্যাল, দিলীপকুমার রায়দের যোগ্য উত্তরসূরি
হয়ে তাঁকে বাংলা গানের আদি যুগ থেকে বর্তমান কাল অবধি তার ক্রমবিবর্তন এবং পরিণতির
ছবি পাঠকদের সামনে সহজ ভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। বাংলা গানের বিরাট ও বিস্তৃত
ভুবনে তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। আবার এ-ও ঠিক যে, বাঙালি সমাজের
একেবারে নিচুতলা থেকে শুরু করে শিক্ষিত, রুচিশীলবর্গের গান ছুঁয়ে বর্তমানের 'বিভ্রান্ত,
বিচলিত সময়ের বাঙালির গানের ভুবনকে' বুঝে নিতে গেলে একজন সার্থক গবেষকের বারবার ফিরে
আসা দরকার। ছুঁয়ে যাওয়া দরকার তাঁরই গবেষণার পূর্ব বিন্দুগুলিকে। তবেই চিত্রকরের হাতে
ধরা চঞ্চল পেন্সিলের মুখ যেমন ওঠানামা করতে করতে একটা স্পষ্ট অবয়ব ক্যানভাসে ফুটিয়ে
তোলে, তেমনভাবেই বাংলা গানের ছবিটিও তালফেরতার বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে পাঠকের সামনে মূর্ত
হয়ে উঠতে পারে। সুধীর চক্রবর্তীর গবেষণার পদ্ধতির মধ্যে এই সাংগীতিক অনুষঙ্গটুকু তাঁর
মনোযোগী পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। যেহেতু সুধীরবাবু নিছক একজন গবেষক ছিলেন
না, তাঁর গবেষণার সঙ্গে জুড়ে ছিল বাঙালি সমাজের কান্না হাসির দোল দোলানোর পালার কথাও,
তাই আমাদের কাছে আছেন 'অবক্ষয়ের কালে বাস করা' নিধুবাবু, কালী মির্জা, মহেশ মুখুজ্জে
বা দাশরথি রায়, গোপাল উড়ে, রূপচাঁদ পক্ষী বা গোলমনি, দয়ামনি, রত্নমনি অথবা 'গান জাগানিয়া'র
কালের কুশীলবরা। আর এঁদের জন্যই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদদের
পক্ষে সম্ভব হয়েছিল পিপাসিত চিত্তের বাঙালির হৃদয়ে সুরের অমৃত ঢেলে দেওয়া। এমনই দাবি
সুধীরবাবুর।তেমনই নজরুল পরবর্তী পেশাদার কন্ঠশিল্পীদের আবির্ভাব আর 'নেই গানে'র সময়ের
সুমন পর্যন্ত সকলেই কেবলমাত্র গায়ক, গীতিকার, সুরকার না হয়ে, হয়ে ওঠেন এক একজন সামাজিক
চরিত্র। যাঁদের সকলের উদ্যোগেই আজকের 'বঙ্গ ঐকতান' গড়ে উঠেছে। বাংলা গানের নানা দিগন্তের
সন্ধান করতে বেরিয়ে সুধীরবাবু আমাদের সুধীরবাবু আমাদের জানিয়েছেন, 'চর্যাগান থেকে রবীন্দ্রনাথ
পর্যন্ত উৎসারে' এক নিভৃত গানের ধারা, যা 'গোপন শীর্ণতায়' নিজেকে ব্যক্ত করে আসছে,
তাকে সেভাবে সংগীত রসিকরা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চাননি। আবার তাঁর সন্ধানী চোখ লক্ষ করেছে,
'লোকায়ত গুহ্য ধর্ম সাধনার প্রয়োজনে বানীর আড়ালে তত্বকে লুকিয়ে' রাখার প্রবণতা যেমন
সহজিয়া, বাউল, শাক্তদের ছুঁয়েছে, তেমনই তা রবীন্দ্রনাথকেও স্পর্শ করেছে। আর বাংলা প্রধানত
গানের দেশ বলেই 'লক্ষ্য করা যায় সবরকম সাহিত্যধারার চর্চা করেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে
গানেই লাভ করলেন সিদ্ধি'।
সুধীরবাবুর লেখা পড়তে পড়তে মনে
হয়, বাংলা গানের দিগন্তগুলি আসলে শেষ পর্যন্ত যেন একই প্রান্তরে এসে মিলে যাচ্ছে। বাংলা
গানের প্রান্তর। এমন সর্বব্যাপী দৃষ্টিতে বাংলা গানকে বুঝতে চেষ্টা করার মধ্যে এমন
চমৎকারিত্ব আছে, যা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। বিদগ্ধ সংগীতবোদ্ধার মেকি গাম্ভীর্য দিয়ে
সুধীরবাবু নিজেকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেননি বলেই দেহতত্ত্বের গানে শব্দের গূঢ় অর্থ
বুঝতে যেমন তিনি পথ হাঁটেন, তেমনই মার্কিন মুলুকের পপ সংগীত জগতের জনপ্রিয় গায়িকা
'মেটিরিয়াল গার্ল' ম্যাডোনাকেও বুঝতে চান। আমাদের সামনে আন্তর্জাতিক আঙিনায় গান নিয়ে
যে ভাঙাগড়ার যজ্ঞ চলছে, তাতে বাংলা গানকে শামিল হওয়ারও আহ্বান জানান। বাস্তবিক,১৯৯১
সালে তাঁর 'যে গান আমাদের নেই' প্রকাশিত হওয়ার পরের বছরেই সুমন চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের
সমাপতনকে উল্লেখ করেছেন নিজেই। এখানেই এক বিতর্কভূমিতে এসে দাঁড়াতে হয় আমাদের। তা হল,
সংগীতস্রষ্টাদের পাশাপাশি সংগীতবোদ্ধা ও তাত্ত্বিকদের মধ্যেকার টানাপড়েন। লিও টলস্টয়
শিল্পের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে বসে সাহিত্য সমালোচকদের একহাত নিয়েছিলেন। সাহিত্যিক
ও তার পাঠকের মধ্যে আর কারও অবস্থানের প্রয়োজনকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি।সুধীরবাবু
নিজের অবস্থান বোঝাতে প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্প সমালোচক ক্লাইভ হেওয়ার্ড বেল-এর উক্তির
শরণাপন্ন হয়েছেন। 'গান জাগানিয়া' রচনার শেষে তিনি লিখেছেন, 'কোনও দেশের মৌলিক গীতিধারায়
বিবর্তন ও অগ্রগতিতে খুব বড়ো ভূমিকা থাকে স্রষ্টাদের পাশাপাশি সমকালীন সংগীত তাত্ত্বিকদের
মৌলিক ও বিতর্কিত চিন্তাধারায়'। এ কথা হয়ত বব ডিলন মেনে নেবেন, কিন্তু আমাদের গানস্রষ্টাদের
দল সহজে মেনে নেবেন বলে মনে হয়না। কিন্তু এ কথা ঠিক, ' রবীন্দ্রনাথ থেকে অতুলপ্রসাদ
পর্যন্ত বাংলা গানের যে সবচেয়ে ফলবান ঐতিহ্য এদেশে গড়ে উঠেছিল, তার ভিত্তিমূলে ছিল
একটা জাতিগত আকাঙ্ক্ষা ও প্রস্তুতি। তৎকালীন সংগীত সমালোচকদের রচনায় রয়ে গেছে তার নিগূঢ়
ইতিহাস এবং অন্তঃশীল নানা সমস্যা ও সমাধানের ইঙ্গিত'। সুধীরবাবুর এই বিশ্বাসের কথা
যদি মেনে নেওয়া যায়, তবে আজ 'নেই গানের' কাল পার হয়ে সুমন পরবর্তী বাংলা গান, আধুনিক
সফটওয়্যার নির্ভর রেকর্ডিং প্রযুক্তির ঘাড়ে চেপে বর্তমানকালে শহরে ও মফস্বলের পাড়ায়
পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ডিজিটাল রেকর্ডিং স্টুডিওগুলিতে বাংলা গান সৃষ্টির যে-ইতিহাস স্রষ্টারা
রচনা করে চলেছেন, তার বিচার বিশ্লেষণ এবার জরুরি হয়ে পড়েছে। এর বিপুলতা অবাক করার মতো।সুধীরবাবু
বেঁচে থাকলে নিশ্চয় এ বিষয়ে তাঁর মত দিতেন। সুধীরবাবুর মৃত্যুর পর যে সব লেখা চোখে
পড়েছে, তাতে সকলেই তাঁর প্রথম বইটির, 'গভীর নির্জন পথে'র সবিশেষ উল্লেখ করেছেন। ওই
বিশেষ বইটি সম্পর্কে সুধীরবাবু নিজেই বলতেন, যেটা ওটা আসলে সহজভাবে সাধারণ মানুষকে
নিজের কাজের একটা ধারণা দেওয়ার প্রয়াস। যেটিকে তিনি নিজে একাডেমিক ডিসিপ্লিনের গবেষণা
বলতেন সেটি তাঁর দ্বিতীয় বইটি 'ব্রাত্য লোকায়ত লালন'। তিনি যখন একাত্তর সালে কুষ্টিয়ার
ছেউরিয়াতে গিয়ে লালন নিয়ে গবেষণা করছেন, তখনও লালন আজকের মত আইকনে পরিণত হননি। লালনের
জীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য সমাপতন ছিল।লালনের জন্মস্থান আর ক্রিয়াকর্মের জায়গা, দুটোই
ছিল ঠাকুরবাড়ির জমিদারির মধ্যে। সেইজন্যই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্কেচ আঁকেন, রবীন্দ্রনাথ
তাঁর গানের খাতা সংগ্রহ করে ছেপেছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়।সুধীরবাবুর মতে লালন কলকাতার
বাইরে বাংলার নবজাগরণের একজন প্রধান হোতা। তিনি একজন কবি এবং একজন আচরণবাদী মারফতি
ফকির, যিনি মৃত্যর পর তাঁকে কবর দিতে বা দাহ করতে বারণ করে ছিলেন। একজন প্রকৃত নিরপেক্ষ
মানুষ ছিলেন লালন। সুধীরবাবু দুঃখের সঙ্গে আমাদের জানিয়ে গেছেন এই লালনকে আমরা বাউল-এ
পরিণত করেছি, তাঁর গানে অন্য লোকে খবরদারি করেছেন, এবং যেটা ভয়ঙ্কর সেটা এই যে লালনের
নাম করে যে সব বাজারচলতি গান গাওয়া হয়, তার বেশিরভাগই আদৌ লালনের গান নয়। সুধীরবাবুর
লেখা থেকে আমরা জানতে পারি বাউল ও ফকির এই দুই শ্রেণীকে একই ব্র্যাকেটের মধ্যে আনা
সম্ভব নয়। কারণ বাউলদের মধ্যে যে রোমান্টিক ব্যাপারটা আছে, সেটা ফকিরদের নেই।এই দুই
সম্প্রদায় সম্পর্কে সুধীরবাবুর দৃষ্টি মরমি, কিন্তু তা আবেগবর্জিত ও বস্তুনিষ্ঠ। বাউল
ফকিরদের নিয়ে শহুরে মানুষের দু'দিনের বৈরাগীপনা, ক্যামেরা হাতে পনিটেলধারী যুবক-যুবতীদের
ক্ষণস্থায়ী অতিউৎসাহকে তিনি চিরকাল কৌতুক করে গেছেন। বারবার বলেছেন, যদি জানতেই হয়
তবে পুরোটা জানা উচিত। শুধু মিথ আঁকড়ে থাকলে কিছুই পাওয়া যাবে না। বাউলদের নিয়ে এসে
প্রসেনিয়াম মঞ্চে হাজির করেছেন নাগরিক সমাজ। একে গর্হিত অপরাধ বলে গেছেন সুধীরবাবু।
কারণ এই ভাবে একসময় বাউলরা হয়ে উঠবেন পারফর্মার, বাউল তত্ত্বটাই হয়ত লোপ পাবে, শহুরে
দেখনদারির চোটে। এই মরমি মানুষটি চলে গেলেন , বাংলা গানের গুরুদশা শুরু করে দিয়ে। তাঁর
সম্পাদনায় 'ধ্রুবপদ' যখন বন্ধ হয়ে গেল, পাঠকদের হাহুতাশের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ঠিক সময়ে থামতে জানাটাও একটা আর্ট।
থেমে যাওয়ার ঠিক সময়টা কি এবার জানতে পেরেছিলেন তিনি?