লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
Source - Internet |
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ
শুরুর আগে বহু দেশি বিদেশি যুদ্ধ-বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছিলেন যে যুদ্ধ যদি আদৌ শুরু হয় তবে
তা খুব বেশিদিন হলে তিন-চার দিন গড়াবে। রুশ আক্রমণে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে ইউক্রেন,
এই ছিল তাঁদের মত। আরও এক দল বিশেষজ্ঞ স্থির প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে, রুশ-ইউক্রেন সীমান্তে যদি একটি গুলিও চলে, তবে তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, কেউ আটকাতে পারবে না। বিশেষজ্ঞদের মুখে ছাই দিয়ে রুশ-ইউক্রেন
যুদ্ধ বিগত দু'মাস ধরে চলছে এবং তার থেকেও বড় কথা যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ আপাতত দেখা
যাচ্ছে না।
এদিকে যুদ্ধের খবর
খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে তৃতীয় পাতা ও পাঁচের পাতা হয়ে দশের পাতা ছাড়িয়ে এখন অতীত।
যুদ্ধ কিন্তু হয়েই চলেছে। সম্প্রতি একদল মার্কিন পররাষ্ট্র-বিশারদ এই যুদ্ধ নিয়ে তাঁদের
খোলামেলা মত দিয়েছেন। তাতে তিনটি বিষয় তাঁরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন,
- এই যুদ্ধে আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির মুখ পুড়েছে। গোটা দুনিয়ার সামনে এই মুখ পোড়া শুরু হয়েছিল মার্কিন সেনার আফগানিস্তান থেকে প্রায় বিনা নোটিশে চলে আসার সময় থেকে।
- মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনকে তাঁদের বৈশ্বিক ক্ষমতার দাবার ছকে নেহাতই একটি বোরের মত ব্যবহার করেছে।
- এই যুদ্ধ এড়ানো যেত যদি ন্যাটো এবং ইউরোপ তাঁদের জেদ দমন করতে পারত, যদি রাশিয়া ঘরের দরজায় ন্যাটোর উপস্থিতিতে বিচলিত না হত, যদি ইউক্রেন ন্যাটো এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে একটা মধ্যপন্থা বজায় রাখতে পারত।
তবে এসবই সম্ভবনার
প্রশ্ন। অনেক মার্কিন পররাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ এমনও বলেছেন যে, যদি কিউবায় রাশিয়ান অস্ত্রের
সম্ভার অথবা মেক্সিকোয় চিনা অস্ত্র কারবার আমেরিকা অতীতে সহ্য না করতে পেরে থাকে, তবে
রাশিয়াইবা নাকের ডগায় আমেরিকার অস্ত্রের সম্ভার সহ্য করবে কেন?
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ
চলাকালীন কয়েকটি ঘটনার দিকে যদি আমরা চোখ রাখি, তবে দেখতে পাবো এই যুদ্ধ থেকে ধীরে
ধীরে উঠে আসছে এক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা। যুদ্ধ শুরুর পরে পরেই আমেরিকা বেশ কয়েকটা নিষেধাজ্ঞা
আরোপ করে রাশিয়ার উপর। সেই নিষেধাজ্ঞায় হাত মেলায় পশ্চিম ইউরোপের অনেকগুলো দেশ। এর
পাল্টা চাল হিসেবে রাশিয়া ওই সমস্ত দেশে তেল আর গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে চুক্তিতে এক নতুন শর্ত আরোপ করে। ওই শর্ত অনুযায়ী
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়া তেল ও গ্যাস সরবরাহ করবে যদি ঐ তেল ও গ্যাসের দাম
ইউরো বা মার্কিন ডলারে নয় রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে মেটানো হয়। শুরুতে জার্মানি সহ অনেকগুলো
দেশ একসঙ্গে রাশিয়ার এই নতুন শর্তের প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু রাশিয়া তাদের শর্ত থেকে
সরে তো আসেইনি উল্টে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়াতে তেল, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার
যুক্তি হল ন্যাটো এবং আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে এক রকমের ছায়া যুদ্ধ লড়ছে
রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
Source - Internet |
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো
এবং অবশ্যই আমেরিকা তাদের অতিবড় স্বপ্নেও ভাবেনি যে রাশিয়া সত্যি সত্যি তেল ও গ্যাস
সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। তাই রাশিয়ার এই পদক্ষেপ এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে। আপাতদৃষ্টিতে
মনে হতে পারে যে রাশিয়া ভদ্রলোকের চুক্তি ভঙ্গ করেছে, অন্তত আন্তর্জাতিক পশ্চিম গণমাধ্যম
তেমনটাই বলছে। কিন্তু বাস্তব হল, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যখন আমেরিকা রাশিয়ার
সমস্ত ডলার অকেজো করে দিয়েছে তখন রাশিয়া বাধ্য হয়েই তাদের নিজেদের মুদ্রা রুবেল-এ বাণিজ্য
করতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল বিক্রির ক্ষেত্রে। বিশ্ব রাজনীতিতে
আমেরিকার যে একক ক্ষমতা ছিল তা আজ স্পষ্টভাবে কিছুটা হলেও দুর্বল। আজ যদি চিন-রাশিয়া
এবং তাদের লেজুর হিসেবে ভারত নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে
দেয় তা হলে বিশ্বে এক নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হবে। এর প্রধান কারণ এটা আজ গোটা
দুনিয়ার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমেরিকার সামরিক সক্ষমতার চাইতে আমেরিকার অর্থনৈতিক
অবরোধ সৃষ্টির সক্ষমতা অনেক গুণ বেশি। সেই জোরেই তারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।
ডলারের শক্তিতেই তারা গোটা বিশ্বের উপর একধরনের কর্তৃত্ববাদ চালাচ্ছে।
বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির
নয়া অক্ষ এখন চিন-রাশিয়া ও লেজুর ভারত। চিন এবং রাশিয়া এখন এটা টের পেয়ে গেছে যে যদি
তারা মিলিত ভাবে একটা নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে তাহলে অনেকটা ধাক্কা খাবে
ডলার, আর সেই ডলারের কলার খোসায় পা পিছলে একবার পড়লে আমেরিকার দাদাগিরি আর চলবে না।
'ব্রিকস' গঠন করার শুরুর সময় থেকেই এই নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ
আলোচনা হয়েছে চিন, রাশিয়া ও ভারত সহ অন্যান্য 'ব্রিকস' সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে।
কিন্তু ভারত ও চিনের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ। প্রায়শই, সীমান্তে যুদ্ধে লিপ্ত
হয় এই দুই দেশ। ফলে, যৌথ মুদ্রা ব্যবস্থার ধারণাটা পিছিয়ে গিয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ
সামনে নিয়ে এসেছে এক নতুন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষমতার অক্ষ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে। ভারতের
সামনেও নতুন করে বর্তমান বৈদেশিক নীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। বিশ্ব বাণিজ্যে
নিজেদের স্থানকে উন্নীত করার সুযোগ করে দিয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। ওদিকে পোল্যান্ড
আর বুলগেরিয়াতে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে
দেখা দিয়েছে ঐক্যের ফাটল। অনেক দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গ্যাস কেনা শুরু করেছে রাশিয়ান
মুদ্রা রুবেলের বিনিময়ে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ
তাই আজ কোনও আর পাঁচটা যুদ্ধের জায়গায় নেই। এই যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারকেন্দ্রের একটা পরিবর্তন ঘটছে। আমেরিকা-ইউরোপের
দিক থেকে সেটা ক্রমেই সরে আসছে চিন-রাশিয়ার দিকে। এই বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন যত দিন
না সম্পূর্ণ হবে, ততদিন চলবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পট পরিবর্তন চলাকালীন বিশ্ব বাণিজ্যের
উপর খারাপ প্রভাব পড়বে, সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয়না।একই সঙ্গে
এটাও পরিষ্কার যে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মার খাবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল
দেশগুলো। সার্ক দেশগুলির মধ্যে চিনের প্রভাব শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশেও
প্রবল। ভারত চিন এবং রাশিয়া এই দুটি দেশের সঙ্গে যদি সঠিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে
চলতে পারে, তবে তা দেশের জন্য লাভজনক হবে, নচেৎ ভারত পরে থাকবে এক বাজার হয়েই। সেখান
থেকে লাভের গুড় খেয়ে যাবে পিঁপড়ে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থায়
ভারত একটি সহকারী দেশ হবে নাকি লেজুড়বৃত্তি করে চলবে তার উত্তর একমাত্র সময় দিতে পারবে।
তবে ভারতের বৈদেশিক নীতির আমূল সংস্কার ছাড়া ভারতের পক্ষে এই নতুন ব্যবস্থায় সহকারী
হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর এতটাই অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যে তাঁদের
উপর বেশি আশা না করাই শ্রেয়। তবে আমি আপনি চাই বা না চাই, নতুন বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত
একটি স্পষ্ট অবয়ব নিতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির কানে কি
সেই পদধ্বনি পৌঁছেছে?