Monday, March 14, 2022

ফিনফ্লুয়েন্সর ও একুশ শতকের নয়া-অর্থনীতির দিকচিহ্ন

   লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

FINFLUENCER BENGALI

সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ও তাদের বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবের। সেখানে দাবি করা হয়েছে যে ইউটিউবের সাহায্যে এক বিশেষজ্ঞ উদ্যোগীর দল ভারতে রোজগারের এমন সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যা প্রায় সাত-লক্ষ পূর্ণ-সময়ের কাজের সমতুল্য। করোনাকালে চাকরির আকালের বাজারে যা প্রায় অসাধারণ এক দাবি। এইসব উদ্যোগপতিরা ভারতের অর্থনীতিতে গড় জাতীয় উৎপাদনে ৬,৮০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছেন। এই রিপোর্ট অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স-এর দ্বারা প্রদত্ত। ইউটিউবের তরফে হ্যাশট্যাগ ক্রিয়েটিং ফর ইন্ডিয়া-কে প্রায় একটি জন-আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।



আজকের দিনে, কোনো ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি বা কোনো অনুপ্রেরণা নিয়ে যে-কেউই ইউটিউবের বিশ্বজোড়া দর্শকের দরবারে পৌঁছে যেতে পারেন। সেখানে উপভোক্তা বা দর্শকের সংখ্যা কত? নয়-নয় করে প্রায় ২০০ কোটি। কিন্তু দর্শকের কাছে পৌঁছে হবেটা কী? দেখা যাচ্ছে অতিমারির প্রকোপে ভারতীয় অর্থনীতির বেহাল দশা ধীরে-ধীরে ছন্দে ফিরে আসার পেছনে কোনও টাটা, গোদরেজ, আম্বানি বা উঠতি আদানিদের মত বড় বিনিয়োগকারীদের হাতযশ নেই। যাঁদের আছে তাঁরা হলেন ফিনফ্লুয়েন্সর- শব্দটা কি অচেনা ঠেকছে? তাহলে একবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক।

সালটা ২০২০, ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে যাকে বলে মুখ থুবড়ে মাটিতে, মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া সব বেবাক ফেল। এমন একটা সময় হঠাৎ দেখা গেল ভারতের অর্থনীতির রাজধানী মুম্বাইয়ের ব্যাংকে হু-হু করে বাড়ছে ডিম্যাট একাউন্টের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়ে দেখল যারা এই আকাউন্ট খুলেছে তাদের সবার বয়স ২৬-২৭-এর বেশি নয়। এরা কোথায়  বিনিয়োগ করছে দেখে আরও আশ্চর্য হল সংস্থাগুলো। দেখা যাচ্ছে যে, শেয়ার বাজারের(বাঙালির কাছে আজও শেয়ার বাজার এক ম্লেচ্ছ শব্দ!) প্রথাগত বিনিয়োগ এখানে হচ্ছে না। খুব অল্প পরিমাণ টাকা খুব ছোটখাট কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন লগ্নিকারী এবং সেই টাকা গড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তুলে নেওয়াও হচ্ছে।

কোভিড-এর সময়ে বহু মানুষের চাকরি চলে যায়, বা বেতন কমে যায়। তখন রোজগারের বিকল্প হিসাবে তৈরি হয়েছিল আরেকটি পথ, তা হল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখা। কিন্তু বিনিয়োগ করলে যে টাকা জলে যাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? এইখানেই মস্ত বড় ভূমিকা পালন করছেন ফিনফ্লুয়েন্সরা। তাঁরা মানুষকে কোন্‌ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হবে, এ-কথা না বলে শেয়ার বাজার বস্তুটা আসলে কী - সেটা সম্পর্কে অবগত করছেন। শেয়ার বাজারে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বিনিয়োগ করা শুরু করবেন সেই সম্পর্কে ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করছেন। খুব অল্প পরিমাণ টাকা নিয়ে কিভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বলছেন। সোজা কথায় ফিনান্সিয়াল মার্কেট নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে।



এতে দু'তরফেই লাভ হচ্ছে। প্রথমত, যাঁরা অল্প টাকা বিনিয়োগ করে কিছু টাকা বেশি ফেরৎ পাচ্ছেন, এই আকালের দিনে সেটাই তাঁদের কাছে লাভ। এমন বহু উদাহরণ আর্থিক সংস্থার সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, যেখানে কাজ হারানো শ্রমিক বউয়ের গয়না বেচে সেই টাকাকে লগ্নি করে মাস চালিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, যে-শেয়ার বাজারকে আমরা ফাটকা, জুয়া, ইত্যাদি তকমা দিতাম, সেই বাজার করোনার কালবেলায় বহু মানুষের সংসার বাঁচিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের (তার মধ্যে অবশ্যই ভারত অন্তর্ভুক্ত) জিডিপির পতনের পরেও শেয়ার বাজার কেন চাঙ্গা থাকছে এই নিয়ে প্রথম সমীক্ষায় নামে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স। সেখান থেকেই প্রথম প্রকাশ্যে আসে ফিনফ্লুয়েন্সরদের ভূমিকা ও শেয়ার বাজারের এই নয়া দৌড়।

এরপর আলাদা করে ভারতবর্ষের শেয়ার বাজারের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, ২০২০-২১ পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষের আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষ কাজ হারানো সত্ত্বেও, না খেতে পাওয়া মানুষের মিছিল, বা তাদের আর্তনাদ যে আমরা শুনতে পেলাম না তার একটা বড় কারণ ফিনফ্লুয়েন্সরা, যাঁরা প্রথা ভেঙে সাধারণ মানুষকে শেয়ার বাজারমুখী করেছেন, সাধারণ মানুষ কিছু বাড়তি টাকার মুখ দেখেছেন, যেটা এই কালবেলায় একটা বড় খবর। এ তো গেল প্রথম লাভের কথা ,দ্বিতীয় যেটা হয়েছে সেটাও একটা নীরব বিপ্লব।

অক্সফোর্ডের সমীক্ষা বলছে ফিনফ্লুয়েন্সরা শুধু নন, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে, যাঁদের বলা হয় ক্রিয়েটর, ১ লক্ষ বা তার বেশি টাকা রোজগার করেন এমন মানুষের সংখ্যা ভারতে প্রতি বছর ৬০% হারে বাড়ছে। যে-পরিসংখ্যান সঠিকভাবে না জানলেও তা আন্দাজ করে, অনেকেই ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বপ্ন আর বিপুল খরচের পেছনে না ছুটে এখন ইউটিউবকেই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। সমীক্ষা বলছে ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক উপায় রয়েছে ভিডিও প্রোমোশন ও মানিটাইজেশনের, যার একটা দুটো কাজে লাগলেই ডাল-ভাতের সংস্থান আটকানো শক্ত। এই সব নতুন পথের সন্ধানে বাঙালি যে নেই তা নয়, তবে যা আছে তা হাতে গোনা। শেয়ার বাজার সম্পর্কে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথম অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তোপসে-খ্যাত সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সেখানে মূলত বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হত। পরে তিনি একক উদ্যোগে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, শেয়ার বাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবগত করার জন্য। কিন্তু বাঙালির কাছে বিনিয়োগ মানেই ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্ট অফিসে রাখা টাকা, আর জীবন বীমা।

বাঙালির মতোই বাঙালির প্রত্যেকটি বিনিয়োগের জায়গা এখন শুকিয়ে মজে গেছে। তাই নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেকেই অল্প অল্প করে শেয়ার বাজারে আসছেন পা টিপে-টিপে। অনেকে বাড়িতে লুকিয়ে, কারণ বাড়ির বাবা-জ্যাঠাদের কাছে শেয়ার বাজার জুয়া হয়েই রয়ে গেছে। যে-বাঙালি প্রতি সন্ধ্যায় টেলিভিশনের সামনে বসে শেয়াল কুকুরের যুদ্ধ দেখেন, তাঁরা কি এবার একটু নজর ফেরাবেন? দুনিয়াটা শুধু বদলাচ্ছে তাই নয়, বদলাচ্ছে একবারে লাফিয়ে লাফিয়ে। একুশ শতকে অর্থনীতি থেকে শুরু করে আগামী দিনে কাজকর্মের ক্ষেত্রেও আসবে নতুন নতুন ধারণা, যা ধুলোয় লুটিয়ে দেবে পুরানো ধারণাকে। বাঙালি কি সেই ধাক্কা সামলাবার জন্য ভাবা শুরু করেছে, চিনতে পারছে নতুন দিকচিহ্নের সংকেত ? ভাবলে, চিনলে  ভালো।  তা না হলে বাড়ির চেয়ারে বা খাটের খুঁটির সঙ্গে অচিরেই বাঙালিকে সিট বেল্ট বাঁধতে হবে, নইলে ছিটকে পড়ে যাওয়া অনিবার্য।



Wednesday, February 2, 2022

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র' - সংখ্যাতত্ত্ব পেরিয়ে এগোচ্ছে পাঠক

 লিখেছেন

ড. অ মৃ তা  ঘো ষা ল 



কিছু কিছু বইয়ের বেশ ধারালো আওয়াজ থাকে। ফ্যাতাড়ুরা সেই আওয়াজ শুনতে পায়। আমরা মধ্যবিত্ত পাঠক। এক লাইন পড়ি, আত্মতুষ্টিতে ডগমগ হই। সেই মধ্যবিত্তকে বেশ জোরে একটা ধাক্কা মারলো অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র : পাঠকের রুচি-অরুচি নির্মাণ -বিনির্মাণ ও অন্যান্য' বইটি। বইটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, শব্দের ঘনত্ব বাড়ায় রক্তের ঘনত্ব। মানুষ অবসন্ন হয়, নতুন নন্দনতত্ত্বের সন্ধান করে। কখনও পায় অবয়বহীন অত্যাচার, কখনও দ্যাখে  '-ইজম'-এর উল্লাস! গ্রাফিতি, রাজনীতি, প্রতাপের ফিসফিসানির মধ্যেই জেগে থাকে শব্দের জটিল মনস্তত্ত্ব। অর্ধেন্দু বোধহয় সেখানেই খুঁজে পেলেন লেখকের অ-তৃপ্তি। প্রাচ্যের উত্তরাধিকার - এই ব্যাপারটার একটা নিজস্ব আধিপত্য আছে। কিন্তু কালাতিক্রমী তত্ত্বরা আবার সেই উত্তরাধিকারকে উল্টে দিতে পারে। যেমন গ্রিক সাহিত্যে স্মৃতিবিদ্যারও একটা ভিত্তি ছিলো। আসলে পাঠক বোধহয় শুধুই স্মৃতির ঈশ্বর-কণা আঁকড়ে বাঁচে ! এই আঁকড়ানোর সূত্রেই লিপি বিবর্তনের ধারাবাহিকতাও  খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক। এখন প্রশ্ন হলো, যত লিখছি, ততই  কী স্মৃতি কমছে ! কই আদিরস তো কমে না, তাহলে কৌতুক কমে কেন! পাঠক সমাজ তাহলে নিপাট সুশীল?

       আচ্ছা, চুম্বনের পরেও সম্পর্ক কিভাবে লুপ্ত হয়? ঠিক সেভাবেই হয়, যেভাবে মহানগর রূপকথা ধুয়ে দেয়। সাদামাটা, অ-বুদ্ধিজীবী, মাথামোটা প্রেমিকা যেমন ভাবে, 'কে আমার প্রেমিক?'; তেমনই লেখক ভাবেন -'Who is my reader?' সহোদর শব্দগুলোকে যেন আলাদা আলাদা নক্ষত্রের মর্যাদা দিলেন প্রাবন্ধিক। 'পাঠ' আর 'পাঠকৃতি' কিংবা 'পাঠ-প্রতিক্রিয়া' আর 'পাঠ-নির্মাণ'-- এদের ব্যঞ্জনা কিন্তু পৃথক! আসলে 'পাঠ' শব্দটাই মধ্যবিত্তের কাছে যেন সর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের মতোই গোলমেলে। ওদিকে রোলাঁ বার্থও কী খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন 'সহৃদয়-হৃদয় সংবেদী'-কে! অর্ধেন্দুর গদ্যে এলো প্রাকরণিক বিচিত্র কৌশল তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা অনেকটাই জুড়ে , তবু যেন এতে চাকুরিজীবীর একঘেয়েমি নেই। তত্ত্ব-সন্ধান ক্লান্তির পরিবর্তে চাপল্যও আনতে পারে। কখনও বা প্রাবন্ধিক  দেখিয়েছেন পাঠবিশ্লেষণে  ইকো-ক্রিটিসিজমেরও তীব্র ভূমিকা থাকে।

    আচ্ছা, বাঙালি-মানসে কী অনেকার্থবোধক বক্তব্য বেশি দাগ কাটে? ঊনবিংশ- বিংশ  শতাব্দীতে থাকা স্মৃতির উপকারী ভূতদের (ত্রিকালজ্ঞ অর্থে ) জাগিয়ে তুললেন প্রাবন্ধিক। শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু থেকে সুকুমার সেন অবধি একটা অক্লান্ত স্বপ্নের প্রবাহ তুলে ধরলেন। একটু বেশি অনুসন্ধিৎসু পাঠক অবশ্য এখানে উত্তরটীকা-পাদটীকা আস্বাদনের আবদার জুড়তে পারেন। তাদেরকে একটু  নিরাশ করলেও, 'সহৃদয় সামাজিক' কিন্তু এই বই থেকে তৃপ্তি পাবেন। আসলে এই বইয়ের শব্দবিশ্ব বেশ আত্মমগ্ন আর সহজসঞ্চারী। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাঠতন্ত্র ব্যাপারটা যেন 'অতি অল্প হইল'। অবশ্য সে ক্যারিশমা এতটাই অনন্ত যে স্বল্প পরিসরে তাকে বিম্বিত করা অসম্ভব।

      স্ট্যাটিসটিক্স ছাড়া কি আর কোনও সিদ্ধান্তকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়! রাশিবিজ্ঞানের গবেষক-অধ্যাপক অর্ধেন্দু পাঠকের সমস্যা প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন বেশ কিছু রাশিভিত্তিক সংকলন। এখন প্রশ্ন - সেগুলো কী অ-স্থানিক আর অ-কালিক বিমূর্তন? একেবারেই না। স্থান ও কাল সেখানে সমাজের অনুষঙ্গী বলেই বিষয়টা হয়ে উঠেছে শাশ্বত। কখনও গদ্যভঙ্গিতে 'wit' এসেছে বেশ রূপকধর্মিতায়। যেমন - 'পাঠক বড্ড ঢ্যাঁটা'--এই কথার সমালোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক বেশ স্পর্ধিত উচ্চারণে। মোদ্দা কথা হলো, 'পাঠ' কিংবা জীবন -- এই দুটোরই একটা সন্দর্ভবাচী রূপ গড়ে তুলতে হবে, যথেষ্ট অধ্যবসায়ের সঙ্গে।

      তাই বিশ্ব জুড়ে দাবি হোক একটাই -- সকলেরই  ভাবনার অধিকার জুটুক। কোনও একটা নির্দিষ্ট তত্ত্ব-প্রসূত ভাবনার ধুয়ো ধরে কিন্তু প্রাবন্ধিক হাঁটেননি, যদিও 'পাঠতন্ত্র'কে রীতিমতো ইতিহাসের আয়না ধরে সাজিয়েছেন। 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স'কে কী আমরা শুধুই তথ্য দলাইমলাই করার জন্যে আশ্রয় করি -- সেই মোক্ষম প্রশ্নও উসকে দিয়েছেন অর্ধেন্দু। আসলে পাঠক কখনও হয়তো টানা-পোড়েনের মধ্যে ফেঁসে যাওয়া টিকটিকির মতো ! আর তখনই পাঠক আত্মকে খুঁজতে গিয়ে আত্মহত্যা করে বসে । অর্ধেন্দু এই বইয়ের আগাগোড়া পাঠকের 'আত্ম'-এর অমরাবতী খুঁজেছেন। পাঠক বোকা পাঁঠা নয়। একবিংশ শতাব্দীর খাটো গণতন্ত্র কিংবা বাথরুমের বিষন্নতা সমস্তটাকেই নগ্ন করলেন অর্ধেন্দু। প্রবন্ধে  কিছুটা অংশ জুড়ে বড়ো বড়ো কবি-প্রাবন্ধিকের নামের ঝড়কে অবশ্য এক ঝলকে বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইনের মতো লাগে। তবু শেষ অবধি লোক দেখানো নয়, আসলে কিছু নামের নিজস্ব অহং আর আদর দুটোই থাকে। পাঠকেরাও তো অপরাধ করে, তারাই তো লেখকের সৃষ্টির ওপর সিগারেটের ছাই ঝেড়ে দেয়। এবার লড়াইটা অর্ধেন্দু জমালেন সংখ্যাতত্ত্ব আর রাজনীতির মধ্যে। ক্ষমতার  আস্ফালনকে অ্যানিমেটেড করে দেওয়া হোক। আর যৌবনের স্মৃতিচারণের মতো পাঠতন্ত্রের চোরা গলিঘুঁজিতে  প্রবেশ করা হোক। আসলে অর্ধেন্দুর বক্তব্যের ভরকেন্দ্রে রয়েছে স্বপ্নের বাস্তবতা। তাই পশ্চিমের স্ট্রাগলগুলো আদৌ কতটা অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছে তাকেও বিচার করেছেন প্রাবন্ধিক। গোঁড়া দুষ্টুরা মনে রাখবেন 'পাঠকৃতি'-র কোনও সতীচ্ছদ হয়না।

         এবারের দ্বন্দ্বটা আরও অদ্ভুত! বুদ্ধিজীবীর সংগ্রহ আর বোধি-সত্তার দ্বন্দ্ব। বেশ কিছু বিখ্যাত বইয়ের তালিকা সংযোজন করেছেন অর্ধেন্দু। তবু মিটিল না আশ ! এ তালিকা কোথাও যেন মনে হয় অসম্পূর্ণ কিংবা বড্ড কেন্দ্রীভূত। পরিশিষ্ট দুই -এই অংশে তো স্পষ্টতই ঘটে গ্যাছে সংরূপের মিশ্রণ। এসেছে চলচ্চিত্রের স্পর্শকাতরতা। কিন্তু এই সিনেম্যাটিক বেনোজলে উদ্ধার পেয়েছে সংবেদনশীল পাঠক। বুকের ওপর পাঠতন্ত্রের রসায়ন গাঁথা পাঠক যেন এক বৌদ্ধিক পরিসরকে বিনির্মিত করার তাগিদ পায়। পরিশেষে গ্রন্থে ব্যবহৃত ব্যক্তিনামের একটা তালিকা লেখক সংযোজিত করলে হয়তো আরেকটু সম্পূর্ণতা আসতো। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পাঠতন্ত্রের যে বুদ্ধিগ্রাহ্য বিবরণ অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এই বইতে এঁকেছেন, তা ভাবীকালের গবেষকদের সহায়ক স্বরলিপি হয়ে উঠতেই পারে।


Tuesday, October 5, 2021

জাল ‘বর্ণপরিচয়’: বিদ্যাসাগরকে বাঙালির শ্রদ্ধার্ঘ্য

  লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


বর্ণপরিচয়কার লেখা? উত্তর আমাদের সকলের জানা, কিন্তু বইবাজারে বা বইয়ের ছোট দোকানে চোখ রাখলে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার উপক্রম ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’, বাংলা প্রাইমারের এক মাইলফলক এই বইকে সঙ্গী করে আজ দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে চলছে বাঙালির বর্ণশিক্ষা এই দেড়শো বছরে বর্ণপরিচয়’-এর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য প্রাইমার লেখক শুরুতে বর্ণপরিচয়নামে বই লিখলেও তার আগে জুড়ে দিতেন - সহজ, সরল, সুবোধ, সচিত্র, নব, নতুন, প্রথম প্রভৃতি বিশেষণ কিন্তু বর্ণপরিচয়’ -এর প্রভাব বা তার অনুকরণে প্রকাশিত প্রাইমারের মাঝে ঘটল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা, প্রকাশিত হল নকল বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থের হুবহু কপি বেরিয়ে পড়ল এই নকলনবিশির সূচনা বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই 

তৎকালীন অনুসন্ধানপত্রিকার বিশেষ সন্ধানে ধরা পড়েছিল এক জুয়াচোর গ্রন্থকারের ১৮৮৯ সালে এই জুয়াচুরি প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোনো অভিমত পাওয়া যায় না বিদ্যাসাগর প্রয়াত হলেন ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায় বর্ণপরিচয়’ -এর প্রথম ভাগের ৬০তম সংস্করণে এবং তাঁর দ্বিতীয় ভাগের ৬২তম সংস্করণের বিন্যাসে শেষবারের মত সংস্কার করেছিলেন বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নারায়ণ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বর্ণপরিচয়গ্রন্থের স্বত্বাধিকার  দখল করেন সেই স্বেচ্ছাচারী বিপথগামীনারায়ণ, বিদ্যাসাগর যাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন, ১৮৯৫-৯৬ সালে তিনি বিদ্যারত্নউপাধি নিয়ে বর্ণপরিচয়’- হস্তক্ষেপ ঘটালেন 

খানিকটা সময়ের দাবি মেনেই তিনি অক্ষর বিন্যাসে, সংশ্লিষ্ট অক্ষর যোগে ছবি অন্য শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটালেন বিদ্যাসাগর কৃত সারিবদ্ধ আ ক খ নবপরিচয়ে হল -অজগর, -আনারস, -কোকিল, -খরগোস - প্রতিটি শব্দের সাদাকালো সচিত্র পরিচয় বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে অন্যান্য সচিত্র প্রাইমার গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বর্ণপরিচয়-কে চিত্রভূষিত করেননি সেটা করলেন নারায়ণ শুধু তাই নয়, বর্ণযোজনার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয়’- যেসব বানান নির্দিষ্ট করেছিলেন, নারায়ণ বানান তালিকা থেকে সেগুলি যথেচ্ছ খারিজ করলেন, নতুন বানানের অনুপ্রবেশ ঘটালেন, বদল আনলেন বাক্যবন্ধেও নমুনা হিসেবে সবচেয়ে যেটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল গোপাল-রাখালপাঠ বদল খুব বেশিদিন অবশ্য নারায়ণ তাঁর দখলে বর্ণপরিচয়’-এর স্বত্বাধিকার রাখতে পারলেন না কারণ বিদ্যাসাগরের উইল অনুযায়ী বহু ব্যক্তি বৃত্তি পেতেন নারায়ণ তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই বৃত্তিভোগীরা এবার আদালতের দ্বারস্থ হলেন 

ঋণ - সংবর্তক বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা


আদালতের নির্দেশ এল, বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি বন্ধক রেখে, বৃত্তির টাকা মিটিয়ে দিতে হবে বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি হিসাবে বন্ধক রাখা হল তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িটি এবং তাঁর রচিত বর্ণপরিচয়সহ অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকগুলি এইভাবে কিছুদিন বৃত্তিভোগীরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায় এরপর একদিন যখন বন্ধক রাখা সম্পত্তি ছাড়ানোর মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেল, তখন পাঠ্যপুস্তকগুলির স্বত্ব বিক্রির জন্য ডাকা হল নিলাম সেখানে সর্বোচ্চ দর দিয়ে বইগুলির স্বত্ব অধিকার করেন আশুতোষ দেব, যিনি টি দেব নামে অধিক পরিচিত ততদিনে বিদ্যাসাগর পুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্ন-কৃত বর্ণপরিচয়সর্বসাধারণের মান্যতা লাভ করেছে, ফলে বর্ণপরিচয়’-এর রিসিভার সংস্করণ এবং পরবর্তীকালে টি দেবের তত্ত্বাবধানে, দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বর্ণপরিচয়আসলে যতখানি না বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’, তার চেয়ে বেশি নারায়ণ বিদ্যারত্নের বর্ণপরিচয় 

মনে রাখতে হবে, ওই পরিবর্তিত বর্ণপরিচয়-ই আজকের প্রচলিত বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় অন্যদিকে গ্রন্থস্বত্বের নিয়ম অনুযায়ী টি দেবের স্বত্বাধিকারের মেয়াদ ফুরোলে যে কোনো প্রকাশন সংস্থাই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়প্রকাশের যথেচ্ছ স্বাধীনতা পেয়ে যান প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়’-এর নির্মল সংস্করণ, নন্দন সংস্করণ, সংসদ সংস্করণ এছাড়াও নানা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে বর্ণপরিচয় প্রকাশনা সংস্থার রুচি অনুযায়ী সেগুলি সেজে উঠছে, আধুনিক বানান-বিধির দোহাই দিয়ে পুরনো বানানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে আমদানি করা হচ্ছে নতুন বানান পাঠ শেষে সংযোজিত হয়েছে প্রশ্ন অনুশীলনী নারায়ণ বিদ্যারত্নের সময়ের সাদা কালো ছবির বদলে এখন রঙিন ছবির ছড়াছড়ি -অজগর থেকে শুরু করে গোপাল-রাখালএবং দ্বিতীয় ভাগের ভুবন তার কুখ্যাত মাসি -সবই এখন রঙিন, চটকদার 

পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় জাল বর্ণপরিচয়’-এর সন্ধান দিয়েছিল যে অনুসন্ধানপত্রিকা, সেই জাল এখন আরও বিস্তৃত সুদূরপ্রসারী। বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকাকালীন যদি জুয়াচোরেরা তাঁর গ্রন্থের হুবহু কপি করে, তাঁর নাম ছবি ব্যবহার করে লোক ঠকাতে পারে, তাহলে আজকের দিনে সেই চৌর্যবৃত্তির রমরমা হওয়াই স্বাভাবিক বর্ণপরিচয়আজ অভিভাবকহীন, স্বত্বহীন তাই জাল গ্রন্থের অসাধু ব্যবসায়ীরা দিব্য বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’-কে অবিকল নিজের নামে বা একটু-আধটু নিয়মরক্ষার হেরফের ঘটিয়ে ঢালাও ব্যবসা করে চলেছেন বাংলা বই বাজারের নিয়মকানুন তাঁদের ছোঁয় না বা ছুঁতে পারে না গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ শেষ হলে কোনো লেখকের লেখা যে-কোনো প্রকাশক ছাপাতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কি কেউ সে লেখা নিজের নামে ছাপাতে পারেন? ছাপাখানার নিয়ম যাই হোক, এটি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা বোধ করি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না এই জাল বর্ণপরিচয়লেখকরা মদনমোহন তর্কলঙ্কারের শিশুশিক্ষাগ্রন্থের প্রথম ভাগের প্রভাত বর্ণনকবিতাটি (পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল) দিব্য বর্ণপরিচয়গ্রন্থে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এছাড়াও শিশুশিক্ষাগ্রন্থের অসংখ্য বাক্য বর্ণপরিচয়গ্রন্থে ঢুকে আছে আজ গ্রামেগঞ্জে-মফঃস্বলে এই জাল বর্ণপরিচয়’-এর রমরমা 

বিশেষত গ্রামেগঞ্জে মুদির দোকানে যে বর্ণপরিচয়মেলে, সে-সবের প্রায় সম্পূর্ণটাই জাল বর্ণপরিচয় এই জাল বইগুলিতে যথারীতি বড় হরফে লেখা থাকে, ‘বর্ণপরিচয় - প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় ভাগ’, তলায় বড় হরফে লেখা থাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এরপর ছোট হরফে লেখা থাকে মহাশয়ের পন্থানুসারে  শেষে লেখকের নাম, সেই নাম আজ আর অনুসন্ধানপত্রিকা যেমনটা লিখেছিল, ‘জুয়াচোর লেখকদের নাম অণুবীক্ষণের তলায় ফেলিয়া দেখিতে হয়’, তেমনটা নয়, যথেষ্ট বড় হরফে লেখা আজকের জুয়াচোরেরা অকুতোভয়, বিদ্যাসাগরের নামের সমান মাপের হরফে তাঁদের নাম মলাটপাতায় ছাপাখানার ঠিকানা, দাম দশ টাকা আর অতি অবশ্যই গোলাপি মলাটের মাঝখানে বিদ্যাসাগরের সাবেকি ছবিটি শুধু বর্ণপরিচয়নয়, ‘বর্ণবোধ’, ‘ধারাপাত-সহ বাংলা বানানের নানা বই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’-এর মুখোশে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সেই সব বইও গোলাপি মলাটের, বিদ্যাসাগরের ছবিযুক্ত 

বিদ্যাসাগরের নাম ভাঁড়িয়ে, ‘বর্ণপরিচয়জালগ্রন্থে আজ শিশুপাঠ্যের বাজার ছেয়ে গেছে কালোত্তীর্ণ একটি শিশুশিক্ষার গ্রন্থ , যার রচয়িতা বাংলা ভাষা শিক্ষার বিস্তারে তথা বাঙালির শিক্ষারম্ভের এক মহান ব্যক্তিত্ব, তাঁর নিকৃষ্ট নকল বা তাঁর চিত্র স্বাক্ষর দেখিয়ে লোক ঠকানোর এই অসাধু ব্যবসা কি চলতেই থাকবে? যে-বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের মৃত্যু জন্মবার্ষিকীতে নিয়ম করে সংবাদপত্রে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শ্রদ্ধার্ঘ্য উগরে দিয়ে থাকে, তাঁরা কী এ-ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন? জবাব মেলে না।


শোভনলাল চক্রবর্তী