Monday, February 8, 2021

নষ্ট সময়ের পদাবলি

লিখেছেন পুরুষোত্তম সিংহ

 

সব বানানো গল্প
(বই-সম্বন্ধীয় অন্যান্য তথ্য লেখার শেষে)


[আমাদের সময়টা নানাভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এক আগ্রাসী ভোগবাদী মানসিকতা বাঙালির সমস্ত কিছু গ্রাস করেছে। সামাজিক অবস্থান নানাভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শ্রেণি বারবার শ্রেণিচ্যুত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রাজনীতির কোন্দলে সাধারণ মানুষের ত্রাহি-ত্রাহি রব চারিদিকে। ধর্ষণ, খুন, জখমে দিন আনা দিন খাটা মানুষের জীবন অতিষ্ঠমিথ্যাকথার ফুলঝুড়ি নিয়ে মিডিয়া উচ্চস্বরে প্রচার চালাচ্ছে। একটি সত্যকে চাপা দিতে একাধিক মিথ্যার মিশ্রিমালা বুনেছে। ভদ্র বাঙালি সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে এক দূষিত অপসংস্কৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমারা, আমাদের প্রজন্ম। এইসব দেখে একজন সচেতন লেখক কি চুপ করে থাকতে পারেন?]


না, পুষ্পল মুখোপাধ্যায় পারেনি। এইখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন বাংলা বাজারে সচেতন অসচেতন দুইপ্রকার লেখকই আছে। সচেতন অপেক্ষা অসচেতন লেখকেরই বাজার রমরমা। যিনি সেক্সের কেচ্ছা ফেঁদে বসেছেন, কাহিনির স্বর্গ নিয়ে প্রেমের রোমান্সজালে বাঙালি পাঠককে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছেন তার বাজার চরম শীর্ষে। মাঝে থেকে বাঙালির সব হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের দায়বদ্ধতা। বিগত পঁচিশ বছরের যাপনের ফসল ‘সব বানানো গল্প’। আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে যে গোলকধাঁধা, নানা রহস্য, শাসকের দুর্নীতি, অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা, চোরবালি ও ভণ্ডামির মুখোশ তা উন্মোচিত হয়েছে এই গ্রন্থের বারোটি আখ্যানে।

 

পুষ্পল মুখোপধ্যায়ের ‘লাটাই’ (যুবমানস, ১৯৯৩) গল্পে দুই শ্রেণির দ্বন্দ্বের চিত্র চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে নিম্নবিত্ত শ্রেণির। উচ্চবিত্ত শ্রেণি এখানে লড়াইয়ে নামেনি। নামার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু শ্রেণিশত্রুদের বিরুদ্ধে যেন এক ক্রোধের জন্ম হয়েছিল ন্যাড়ার মনে। নিম্নবিত্তের ন্যাড়া বস্তির ছেলে। বস্তির ওপারে গড়ে উঠেছে সম্রাট অ্যাপার্টমেন্ট। কোনদিন ন্যাড়াদের বস্তিও উঠিয়ে দেওয়া হবে। ন্যাড়া কাজ করে কানাইয়ের সাইকেলের দোকানে। সম্রাট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ঘুড়ি ওড়ায় উচ্চবিত্তের সন্তান বাবলু। বাবলুর প্রতি এক জাত ক্রোধ রয়েছে ন্যাড়ার। কেন এই ক্রোধ তা সে নিজেই জানে না। দুজনই প্রায় সমান বয়সের। কিন্তু পৃথক অবস্থানের চিত্রই যেন এক ক্রোধের জন্ম দিয়েছেবাবলুর ঘুড়ি থাকলেও তার নেই। ঘুড়ি না থাকার জন্যই কি ক্রোধ? তবে তো বস্তির কেষ্ট, কানুর ওপরও হত। কেননা তাদের ঘুড়ি আছে। এমনকি বাবলুকেই সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। বাবলুকে সে বলে কেবলু। সে জানে এই বাবলুরাই তাদের সমস্ত ছিনিয়ে নেয় বা নেবে। এই বাবলুদের পরাজিত করতে হবেই। বিশ্বকর্মা পূজার দিন অন্যের ঘুড়ি চুরি করে ঘুড়ি যুদ্ধে নেমেছে ন্যাড়া। এমনকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়ীও হয়েছে। শুনে নেওয়া যাক লেখকের বর্ণনা—

 

"অনেক উঁচুতে, ছোট্ট একটু পা রাখার জায়গায় দাঁড়িয়ে ন্যাড়া ঘুড়ি ওড়ায়, প্যাঁচ খেলে, যুদ্ধ করে ন্যাড়া। টানি থেকে ঢিলিতে চলে যায়। ঠিক তখনই ন্যাড়ার ভারসাম্য বলে আর কিছুই থাকল না, ওর পা পিছলে গেল। ভীষণ টানে লাটাই হাতে নিচে নেমে আসছিল ন্যাড়া, সেই টানেই বুঝি কেটে গেল বাবলুর ঘুড়ি, ভোকাট্টা। কিন্তু ন্যাড়া সেটা দেখতে পেল না, ন্যাড়াকেই দেখা গেল না আর। খালে জলের থেকে পাঁকই ছিল বেশি, সেই পাঁকেই তলিয়ে গেছে ন্যাড়া। শুধু ওর বাঁ হাতটা দেখা যাচ্ছিল। হাতের মুঠোয় তখনও ধরা ছিল সুতো শেষ না হওয়া লাটাই। আপন মনে উড়ছিল খবরের কাগজে তৈরি বেঢপ ঘুড়িটা। যুদ্ধ তখন আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল। ন্যাড়াকে বাঁচাতে ঠিক সৈনিকের মতো খালে ঝাঁপিয়ে পড়ল খালপাড়।"

(লাটাই, সব বানানো গল্প, বিবক্ষিত, প্রথম প্রকাশ ২০১৮, পৃ. ১২, ১৩)

উচ্চবিত্তের ওপরে থাকার আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি ন্যাড়া। বস্তি থেকেই সে লড়াই দিতে চেয়েছিল। এমনকি জয়ীও হয়েছে। ইচ্ছে ছিল বাবলুর ঘুড়িকে দুমরে মুচড়ে দেবে। পেরেওছে। গল্পের শেষ দৃশ্যে মুষ্টিবদ্ধ বাঁ হাতই যেন সে সত্যের জানান দিয়ে যাচ্ছে। নিম্নবিত্তের লড়াই, শ্রেণি সংগ্রামের চিত্র শেষ হতে পারে না, তারা জয়ী হবেই— এই সত্যই যেন লেখক জানান দিয়ে যান। তাই গল্প শেষে দেখি বস্তিবাসী খাল পাড়ে এসে বাঁচাতে উদ্যত হয়েছে ন্যাড়াকে। গল্প হিসেবে ‘লাটাই’ বেশ উচ্চমানের। বিধ্বস্ত সময়ে, অধঃপতিত সমাজ ব্যবস্থায় ন্যাড়ারা কীভাবে হারিয়ে যায় এবং জেদের বশবর্তী হয়ে সংগ্রামে ফিরে আসে সেই চিত্রই লেখক প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। জীবনের ছেদ-বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্নতা সব অতিক্রম করেও মানুষ বাঁচে, বাঁচার স্বপ্ন দেখে। জীবনের পথে বহু ঘটনা ঘটে যায়, কিছু স্মৃতিরেখায় আঁকা থাকে, কিছু মুছে যায়। কিছু কিছু স্মৃতি মানুষকে প্রবলভাবে নস্ট্যালজিক করে তোলে, আবার কিছু ঘটনা নিছকই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। এ সমস্ত নিয়েই গড়ে উঠেছে পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের ‘ফল্গু’ (রবিবারের প্রতিদিন, ১৯৯৬) গল্প। গল্প আখ্যানে রয়েছে দুই নারীর জীবনের ভাঙা-গড়া, প্রেম-প্রেমহীনতা, ভালোবাসা ও সংসারের গল্প। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বহু চরিত্র। তবুও হাসনুদি, বিদিশা বিবাহ করেছে, সংসার গড়েছে। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় গল্প আখ্যানে বহু বিমূর্ত চিত্র, সংকেত রেখে যান। কখনও সেতারের তার ছিঁড়ে গেছে বা শাড়ি উড়ে গেছে। রাহুল, বিদ্যুৎরা হারিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা সময় চিত্রই যেন বড় হয়ে ওঠে। বিদিশাদের কলেজবেলা, সারজা কাপ, রাহুলের আত্মহত্যা, বিদ্যুতের প্রমোটারি ব্যবসায় এগিয়ে যাওয়া সময়ের যাপনচিত্রকেই যেন বড় করে তোলে।

 

‘পরির কার্টুন’ অসাধারণ গল্প। কোথা থেকে গল্প শুরু হল আর কোথায় গিয়ে পাঠক হিসেবে থামতে হল ভাবতে গিয়ে বারবার মুগ্ধ হই। মোদ্দা কথা তিনি গল্প নির্মাণ করতে জানেন। এমনকি গল্প নির্মাণে যে সিদ্ধহস্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গল্পটি শুরু হয়েছে আপাতত লঘু ভাবে। এরপরেই লেখক ডুব দিয়েছেন যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ কবলিত সময়ে। লাদেনের সন্ত্রাসবাদে আমেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। বাসুদেব মনে মনে যুদ্ধকে সমর্থন করে, সে আমেরিকার পক্ষে। একদিকে যুদ্ধে অন্যদিকে কন্যা পরির অ্যাডমিশন টেস্ট। স্ত্রী ঝর্ণার ইচ্ছা কন্যাকে মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি করার। বাসুদেব ধরেছে কালোদাকে। কালোদা বলেছে পরিকে যেনতেন প্রকারে মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি করে দেব। বাসুদেবের অফিসে বোমের ভুল খবরে গতকালই কিছু মানুষ আহত হয়েছে। সে যুদ্ধ দেখার জন্য রঙিন টিভি এনেছে ঘরে। একজন সার্থক গল্পকার আখ্যানের মধ্যে বহু স্তর আবিষ্কার করেন। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় এই গল্পে বহুমাত্রিক স্তরে পাঠককে নিয়ে গেছেন। বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন ভাবনা। আছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। বাসুদেবের যুদ্ধ সমর্থন, বাচ্চা পরিও জেনে গেছে মেধা ছাড়াই মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে। স্ত্রী ঝর্ণার রয়েছে দেবদেবী বিশ্বাস, সিরিয়াল বা বচ্চনের ক্রড়পতির প্রতি ঝোঁক। পরির ঝোঁক কার্টুন দেখার প্রতি, বাসুদেব মত্ত যুদ্ধে। আসলে ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতি মধ্যবিত্তের প্রবল আগ্রহ। ব্যতিক্রম নয় বাসুদেবও—

 

"যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বোমার সঙ্গে সঙ্গে খাবারও ফেলেছে আমেরিকা। খাবারের রঙ বোমার রঙের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে, বোম নয়, আমেরিকা রঙ বদলে দিচ্ছে খাবারের। বুশ সারা বিশ্বকে বলছে, হয় তুমি আমাদের দলে, তা না হলে সন্ত্রাসবাদী, এ যুদ্ধে নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই।

 

না, বাসুদেব একটুও নিরপেক্ষ নয়, বাসুদেব মনে মনে আমেরিকার দলে। আক্রমণের পক্ষে বাসুদেব, যুদ্ধের পক্ষে, ওয়্যার এগেনস্ট টেরোরিজম। সন্ত্রাসের ভয়ে অমরনাথ যায়নি বাসুদেব, কাশ্মীর যেতে পারেনি, শালা দিকে দিকে শুধু সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদী, আমেরিকা পারে যদি সব ধ্বংস করে দিক।"

(পরির কার্টুন, তদেব, পৃ. ২৫)

 

পরের দিন পরির অ্যাডমিশন টেস্ট। পিতা-মাতা, কন্যা চলেছে স্কুলের পথে। পথে আজ চলছে যুদ্ধ বিরোধী মিছিল। যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বরং মিছিলে হেঁটেই যেতে হবে স্টেশনের পথে। লেখক অনবদ্য কৌশলে যুদ্ধ সমর্থনকারী ব্যক্তিকে নামিয়ে দিলেন যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে। গলা না ফাঁটালেও, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে না ছুড়ে দিলেও পা মেলাতে হয়েছে। গল্পের পরিণতি আরও বিস্ময়কর। মিছিলে নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছে বাচ্চা পরি। অ্যাডমিশন টেস্ট অপেক্ষা মিছিলের প্রতিই তার লক্ষ্য বেশি। সে কিছুতেই যুদ্ধ বিরোধী মিছিল থেকে আসতে চায় না। শেষে জানা যায় যুদ্ধ থেমে গেলে টিভিতে পিতা আর যুদ্ধ দেখবে না ফলে কার্টুন দেখতে পাবে। শুনে নেওয়া যাক গল্পকারের বয়ান—


"মেয়ে বলল, ‘বুঝি তো, যুদ্ধ মানে তুমি যা দেখো রোজ টিভিতে অফিস থেকে ফিরে, আর বিরোধী মানে এই আঙ্কেল বলেছে আমায়।'

 

মিছিল থেকে বেরিয়ে আসছিল বাসুদেব পরিকে কোলে করে। পেছন থেকে লোকটা বলল, ‘যেতে যেতে একটা কথা বলে যাও তো মামনি, তুমি এত করে যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে হাঁটতে চাইছ কেন?’

কেঁদে ফেলল পরি। মিছিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল ‘আমার কার্টুন দেখতে ভাল্‌লাগে তাই।"

(তদেব, পৃ. ২৯)

 

পারিবারিক যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, যুদ্ধ-যুদ্ধ বিরোধীতা, ব্যক্তির অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের ভোগাকাঙ্ক্ষী জীবনের মধ্যেও নতুন স্বপ্নের বীজ কীভাবে গড়ে উঠতে পারে তা লেখক দেখিয়েছেন। পরির যুদ্ধ বিরোধীতার মধ্যে আপাত কার্টুন প্রিয়তা হয়ত আছে তবে যুদ্ধই যে শেষ সত্য নয় তা লেখক দেখিয়ে দেন। যুদ্ধ বিরোধী মানুষই যে জয়ী হবে তা ফুটে ওঠে। লেখক এক অনন্ত দক্ষতায় এই আখ্যান নির্মাণ করেছেন। ঘটনা অপেক্ষা বক্তব্য পরিস্ফুটনেই লেখকের লক্ষ্য বেশি। আর কাহিনির চোরাস্রোতে ভেসে যায় সময়ের একাধিক ক্ষত-বিক্ষত বিন্দু। সেই বিন্দুগুলির তিনি আভাস দিয়ে যান। পাঠক হিসেবে বুঝে নিতে হয় সময়ের চোরাস্রোত কীভাবে মানুষকে, মানুষের মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। সেই ধ্বংস মূল্যবোধের মধ্যে জাগ্রত বিবেককে জাগিয়ে তুলতে চান পুষ্পল মুখোপাধ্যায়। ‘চন্দ্রাবতী’ ( অথ ধরিত্রীকথা ২০০৫) প্রেমের গল্প। সমষ্টির ঘাত-প্রতিঘাতে ব্যক্তি প্রেমের জয়ের গল্প। ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’ শব্দবন্ধটাই মনে এল গল্পের চরিত্রগুলির কথা পড়তে গিয়ে। চার লাল (মতিলাল, হীরালাল, পান্নালাল, লালচাঁদ) মজেছিল চন্দ্রাবতীর প্রেমে। সবাই চন্দ্রাবতীকে পেতে চেয়েছিল। চন্দ্রাবতী নানা পরীক্ষা নিয়েছে, জয়ী হয়েছে মতিলাল। চন্দ্রাবতীর শেষ খেলার আহ্বানে মতিলাল অংশ নেয়নি। হীরালাল, পান্নালাল, লালচাঁদরা খেলায় অংশগ্রহণ করে কেউ মৃত হয়েছে, কেউ আহত। খেলায় অংশ না নেওয়া মতিলাল জয়ী হয়েছে চন্দ্রাবতীকে পেয়ে। ইতিমধ্যেই তাদের খেলায় মৃত হয়েছে বহু পাখি, বাসা ভেঙেছে, ব্যক্তিরও মৃত্যু হয়েছে, কিছু পাখি ঘর ছেড়েছে, কেউ প্রেম জিতে নিয়েছে।

 

‘হিটকা’ (জলার্ক, ১৯৯৯) অনবদ্য গল্প। যে ক্যানভাসে ও বয়ানে তিনি গল্পটি নির্মাণ করেছেন তা মুন্সিয়ানার দাবি করে। একাধিক ঘটনা, রাজনৈতিক প্রসঙ্গক্রম, সময়ের গোলকধাঁধা, পার্টি রাজনীতি ও ব্যক্তির উত্থান-পতনকে একটা চরিত্রের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। শ্রীপতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুমুখে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রেমিকাকে হারিয়ে, সম্পত্তি থেকে বিচ্যুত হয়ে ফাঁসি নিতে চেয়েছিল। সেই ফাঁসির রাতে শ্রীপতিকে বাঁচিয়েছিল হিটকা। মাত্র একশ টাকার বিনিময়ে। বলা ভালো হিটকার জন্যই সেদিন আত্মহত্যা করা হয়নি শ্রীপতির। হিটকাই শ্রীপতিকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সেখানে ছিল মিথ্যা বুজরুকি। তবে মিথ্যা বুজরুকিই শ্রীপতির জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল মূল স্রোতে। আসলে এক মিথ্যাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময়, রাজনীতি ও ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত। গল্পের ঘটনাক্রমে এসেছে বাম আমলের ক্ষমতার আধিপত্যের কথা। বিরোধীপক্ষকে কীভাবে দুমরে দেওয়া হচ্ছে সেইসব কার্যকম। পার্টি রাজনীতি, দলীয় রাজনীতি, লোকাল লিডার শ্রীপতিকে বারবার ব্যবহার করেছে। হিটকাই যেহেতু শ্রীপতিকে বাঁচিয়েছিল তাই অগাধ বিশ্বার হিটকার প্রতি। সেই সুযোগ নিয়েছে হিটকা। বারবার ঠকিয়েছে। নানা সময় গান্ধিজির চশমা, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, চন্দনকাঠের লেনিন, সূর্যসেনের পিস্তল, চারু মজুমদারের ডায়েরি বিক্রি করেছে। এমনকি প্রতি পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গান্ধিজির চমশা দিয়ে রাতে শ্রীপতি অরিজিনাল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার চেষ্টা করেছে। ভারতবর্ষ মহান ঐতিহ্যময় দেশ। নানা বিপ্লবী ও দেশনেতার নানা রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শ ছিল। স্বাধীনতার পর তাঁতে ফাঁক ধরেছে। তেমনি রয়েছে মূল্যবোধহীন এক সময়ের কথা। যে কালগ্রাসী সময়ে বাঙালির সমস্ত গৌরব হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। চুরি হয়ে গেছে গান্ধিজির চশমা থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল। চলছে প্রোমোটার রাজ। স্বপনের বারবার লক্ষ্য শ্রীপতির পুকুরের দিকে। আসলে বিধ্বস্ত সময় পর্বকেই লেখক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সেই বিধ্বস্ত সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করতে তিনি কাহিনির কোলাজ গড়ে তোলেন। শেষে শ্রীপতির বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকতরা দেখে পূর্বে যত বাড়িতেই ডাকাতি করেছে এই নকল নোবেল, লেনিন, সূর্যসেনের পিস্তল, ডায়েরি দেখেছে। ডাকাতদের লক্ষ্য সোনা, টাকার দিকে। আসলে হিটকা এইভাবে সবাইকে প্রতারিত করেছে। লেখকও তো হিটকা কাহিনিই গড়ে তুলতে চান। গল্পের প্রথমেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শুনে নেওয়া যাক লেখকের বয়ান থেকে গল্প সূচনার সামান্য অংশ—

 

"এ গল্পে হিটকা বলে একজন আছে, কিন্তু হিটকা কে, হিটকা কেন, এসব আমরা কিছু জানি না। হিটকাকে আমরা প্রথম দেখি মিত্তির বাগানে, মিত্তির বংশের শেষ সলতে শ্রীপত্তি মিত্তির সেদিন মাঝরাত্তিরে একগাছা দড়ি হাতে একা একা মিত্তিরবাগানে মরতে এসেছিল। ফাঁস তখন তৈরি হয়ে গেছে, ডালে দড়ি ঝোলানো শেষ, নিজেকে শুধু ঝুলিয়ে ফেলা বাকি। ঠিক এই রকম একটা সময়েই প্রথমবার আমরা হিটকাকে দেখি, দেখি মানে ভাঙা চাঁদের ছেঁড়া জ্যোৎস্নায় খানিকটা আন্দাজ করে নিতে হয় আমাদের, লম্বা রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, প্যান্ট শার্ট পরা একটা লোক।"

(হিটকা, তদেব, পৃ. ৩৫)

 

তবে শ্রীপতির মতো সবাইকে রক্ষা করেছিল কি না বা রক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিল কি না তা আমরা জানি না। তবে অনুমান করা যায় না বাঁচালে হিটকার এই মিথ্যা বুজরুকি কে বিশ্বাস করবে? তবে হিটকা জানে কেউ কেউ এই বুজরুকি বিশ্বাস করবে। তাই প্রতিবারেই সে বলেছে ‘আমার অন্য কাস্টমার আছে’। আসলে সময়টাই একটা প্রতারিত হবার ফাঁদ পেতে রেখেছে। সেখানে ব্যক্তি নানা ভাবে প্রতারিত, বঞ্চিত, শোষিত হবে। সেই শোষণের ধাপ ব্যক্তিভেদে পাল্টাবে। যুগে যুগে গান্ধিজি আসবেন, লেলিনের সাম্যবাদ আসবে, চারু মজুমদারের লড়াই সংগ্রামের ডাক আসবে। সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যেও থাকবে মানুষকে শোষণের, প্রতারিত করার ও হবার বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, চোরাবালি। আর যে সময়টা লেখকের যাপনচিত্র ও গল্পের পটভূমি সেই সময়টা নানাভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। সেই বিনাশবেলার যন্ত্রণা নানাভাবে উঁকি দেয় পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের কাহিনিবিশ্বে।

 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদের লোক’। বঙ্গীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শব্দটি কীভাবে ব্যবহার হয়েছে তা কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমাদের লোক’ (জলার্ক ২০০৫) গল্পটি। রবিদাস বারবার কুশল সম্পর্কে জানিয়েছে—‘স্যার আমাদের লোক’। গল্পের আখ্যানে রাজনীতির ছোঁয়া আছে। তখন বঙ্গে বাম রাজনীতির আধিপত্য। স্বভাবতই কলেজের কর্মচারী রবিদাস সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমনকি বিশ্বাস করে সেই রাজনীতির আদর্শ। ঘরে লেনিন, কাকাবাবুর ছবি সেই সত্যই জানান দেয়। লেখক এক বহুস্তরীয় বিন্যাসের মধ্য দিয়ে আখ্যান এগিয়ে নিয়ে যান। আছে প্রমোটার রাজ। জলা বুজে দিয়ে চলছে ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ। রবিদাস কুশলের কাছে জমি বিক্রি করে। কিন্তু একটি শর্ত ছিল বট গাছকে যেন না কাটা হয়। আসলে গাছে ছিল বহু পাখির আশ্রয়। কিন্তু স্থানীয় কাউন্সিলার সে কথা শোনেনি। রবিদাসের অনুপস্থিতে তা কাটা হয়ে গেছে। বহু পাখির বাসা ও ডিম ভেঙে পড়েছে। রবিদাস তখন চলেছে প্রেমিকা রেবাকে সুন্দরবনে পৌঁছে দিতে। কেননা সেখানে আজ উপনির্বাচন। রেবাও হয়ত তাদের লোক। রবিদাস জমি প্রমোটারদের হাতে তুলে দিতে চায়নি। কেননা প্রমোটাররা বট গাছটিকে রাখবে না তা সে জানতো। গাছকে কেন্দ্র করে এক ট্যাবু ছিল রবিদাসের। ছিল এক বিশ্বাস—“ওই গাছটাকে আমি মাছেমধ্যেই স্বপ্নে দেখি স্যার, বিশ্বাস করুন, স্বপ্নে ওই গাছ আমাকে নজরুল ইসলাম হয়ে গান শুনিয়ে যায় এক একদিন, এক-একদিন পরিস্কার কাকাবাবু হয়ে এসে বলে, রবিদাস তুই আমাকে বাঁচা। বলে, আমি বড় হব, আরও বড় হব—এখন আপনিই বলুন স্যার, বৌদি বলুন, ওই গাছ কি কেটে ফেলা যায়?” (আমাদের লোক, তদেব, পৃ. ৫২) একদিকে রাজনীতিক বিশ্বাস, সাম্যবাদী আদর্শ, পার্টির প্রসার অন্যদিকে পাখির আশ্রয়। পার্টি কীভাবে নিজেদের শেকড়-বাকড় জনমূল স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল, তেমনি আমাদের লোককে কীভাবে দলে টানা যায়, পার্টির প্রসার ঘটনা যায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে এইসব আখ্যানের মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশের এক বিশেষ সময় পর্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখক সচেতন ভাবেই তা লিপিবদ্ধ করেছেন। বট গাছের মতো পার্টিও যেন মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে—“শেকড়গুলো কিরকম আঁকড়ে আছে দেয়াল, স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স। বেশ আর্টিস্টিক।“ পার্টি নিজের আধিপত্য ছড়িয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু বটগাছ কাটা হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলার মারফত। বাম পার্টির পরিণতিও যেন সেখানেই চিহ্নিত হয়ে যায়।

 

জয়া মিত্র ও পুষ্পল মুখোপাধ্যায়

অসম্ভব ভালো গল্প ‘কবুতর কথা’ (ভাষাবন্ধন, ২০০৮)। রূপকের মধ্য দিয়ে শোষণ, রাজতন্ত্র, অত্যাচার, প্রজানাশ, ক্ষমতা ভোগ ও শেষে নিজেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়া বড় হয়ে ওঠে। রাজনীতির পাঠ হিসেবে আখ্যানটি পড়া যেতে পারে। সময় পরিসরের ব্যবধানে গল্পটি আরও সত্য হয়ে ওঠে। ক্ষমতা আছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে ক্ষমতার বদল ঘটে গেছে। মাননীয় পাঠক মহাশয় যেসময় (২০০৮) গল্পটি প্রকাশিত সেইসময়ের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চিত্র মনে মনে কল্পনা করুন। গল্পের বয়ানে পাই—“ক্ষমতা হাত বদল হয়ে গেছে তলে তলে”। আবার সেনাপতি বলে—“দেশের রাজা যখন বেপথু হয়ে যায়, পায়রারা এরকম মরে”। এইরকম নানা ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। ইতিহাসেও ক্ষমতাভোগী, অত্যাচারী রাজার পতনের জন্য সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, আজকের স্বাধীন দেশেও যেকোন অত্যাচারী রাজনৈতিক দলের পতনের জন্য প্রাণ দিতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত সাধারণ মানুষ যখন গর্জে ওঠে তখন দিন বদলের পালা শুরু হয়। রাজা আজ দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের মুখে। কবুতর খেকো রাজা আসলে ছিল প্রজা নাশক। মন্ত্রী সেনাপতিরাও সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ দেখে দেখে নিজের অবস্থান পাল্টে ফেলেছে। সবাই হয়ে উঠেছে রাজার বিরোধী। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় গল্প অপেক্ষা সময় যাপনের যে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা তাই চিত্রিত করে তোলেন। সামান্য কাহিনিকে সামনে রেখে কীভাবে শিল্পে উত্তীর্ণ হতে হয় তা তিনি জানেন। আমাদের সময়টা ধ্বংস হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। সময়ের বুকে অজস্র পলি জমা হচ্ছে। সেই ‘অজস্র’কেই একটা একটা আস্তরণ হিসেবে তিনি খুলে ফেলেন। এইসব গল্পে কাহিনি অপেক্ষা সামাজিক ইতিহাসটা বড় আকার নেয়। যেমন ধরা যাক ‘হেবি পালাচ্ছেন, না?’ (জলার্ক, ২০১১) গল্পের কথা। এই আখ্যানে গল্প আছে, কিন্তু গল্পের পরতে পরতে তিনি রাষ্ট্রের যাবতীয় ছলচাতুরির হিসাব নিকাশ যেমন ভেঙে দেন, তেমনি মানুষের রুচিবোধ, সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির পালাকীর্তন, ভণ্ডবাজ মধ্যবিত্ত চরিত্রের যাবতীয় ন্যাকামি স্পষ্ট করে তোলেনপৌলমী ও অর্জুন চলেছে পৌলমীদের গ্রামের বাড়ি পূজা উপলক্ষে। তাঁরা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ, বিবাহ বা রেজিস্ট্রারি হয়নি। আজকের বাঙালির পূজা মানেই মদ্যপান। এই রুচিহীন বাঙালিকে ব্যঙ্গ যেমন করেন তেমনি ধনঞ্জয়ের ফাঁসির প্রসঙ্গ এনে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক অবস্থান কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে নেমে গেছে তা স্পষ্ট করেন। ধনঞ্জয়ের ফাঁসি দ্বারাও ধর্ষণ রোধ করা যায়নি বা যাবে না। শিক্ষিত অর্জুনদের মধ্যে যৌনসর্বস্ব ভোগবাদ প্রবৃত্তি রয়ে গেছে। তেমনি কালিপূজা উপলক্ষে নন্দ লাইটিং এ দেখিয়েছে ধনঞ্জয়ের ফাঁসি। যা মেনে নিতে পারেনি ঝণ্টু। কেননা দৃশ্য যৌনতার বহু প্রসঙ্গ ছিল। ঝন্টু থানায় গিয়েছিল। ইতিমধ্যে থানায় মাওবাদী পোস্টার পড়েছে। ঝণ্টুকেও মাওবাদী ভেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। পুলিশ প্রশাসন এখন মাওবাদী নিধনে ব্যস্ত তাই অন্য কেস নেয়নি। ডাকা হয়েছে পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত নন্দের লাইটিংয়ের ওপর কিছু শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে। যেখানে রয়েছে রাজনীতির রঙের খেলা, তেমনি মানুষের রুচিবোধকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—

 

"শর্ত চাপিয়েছে, বলে লিঙ্গ দেখানো চলবেনি, কোমরদুলুনি বাদ, সবুজটুনির বিচারককে লাল কত্তে হবে, লালটুনির গান্ধিকে সবুজ। এ ছাড়াও ফাঁসির দড়ির রং, পুলিশের রং, পাটাতনের রং সব সবুজ পালটে লাল কত্তে হবে। সে-সব নয় করলাম লিঙ্গও নয় বাদ দিলাম কেটে, কিন্তু কোমরদুলুনি? তা আমি ছাঁটি কেমন করে! পঞ্চায়েত বললে পাঁচের জায়গায় একবার দেখাও, যে বোঝার সে ঠিক বুঝে নেবে।"

(হেবি পালাচ্ছেন, না?, তদেব, পৃ. ৮১)

 

এই ভণ্ড সভ্য সংস্কৃতির বার্তা যখন নির্দেশিত হচ্ছে ঠিক আগের রাতেই অধ্যাপক অর্জুন যৌন হেনস্তা করেছে শালিকা পূজাকে। পূজা যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছে তবে কৌশলে বাঁচিয়েছে অর্জুনকে। সে প্রতিবাদ করেছে ব্যক্তিগতভাবে, বাড়ি বা প্রতিবেশী কাউকে না জানিয়ে। ধনঞ্জয়দের ফাঁসি দিয়েও প্রবৃত্তি সর্বস্ব, কামুক সর্বস্ব মানুষের রুচিবোধ, অতৃপ্ত যৌনবাসনাকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় নিতেমনি নন্দের লাইটিংকে আমরা দেখতে পারি দৃশ্য দূষণের অংশ হিসেবে। যা অর্জুনের মধ্যে এক অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল। এইরকম দৃশ্যদৃষণ, বিজ্ঞাপনের আঁতলামি মানুষকে ক্রমেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। রুচিবোধ বিপন্ন বাঙালির মুখে ইংরেজি শব্দচয়ন, মদ্যপানের প্রবল আকর্ষণ ও হৃদয়ে যৌনবাসনা এই নিয়ে গোটা সমাজটাই আজ ভয়ংকর বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়ংকর পঙ্কিল স্রোতগুলিই পুষ্পল মুখোপাধ্যায় দেখতে পান ও তাঁর আখ্যানে ভেসে যায়।

 

রামকুমার মুখোপাধ্যায় ও পুষ্পল মুখোপাধ্যায়

একজন লেখক গল্পের মধ্যে বহুস্তরে ভেসে যাবেন সেটাই আমাদের প্রার্থিতসেই স্তরের মধ্যে সমসাময়িক সময়ের যন্ত্রণা, অত্যাচার, শোষণ, রাজনৈতিক চক্রান্ত, মানুষের অন্ধবিশ্বাস, ধূর্ততা সব সমান্তরাল স্রোতে ভেসে যাবে। মুখোশধারী মানুষের যে বিবিধ প্রবণতা, লোভ, নিজেকে সৎ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, অথচ সেই চেষ্টার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসৎ প্রবৃত্তি যা ব্যক্তি মানুষ মুছে দিতে চান কিন্তু সমষ্টি প্রত্যক্ষ করে। এইসব গোলকধাঁধাকে সামনে রেখেই মানুষ বাঁচে, বাঁচার স্বপ্ন দেখে। পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের ‘ভয় করে’ (চতুষ্কোণ, ২০১৩) গল্প পড়তে গিয়ে উপরিউক্ত কথাগুলি মনে এল। মধ্যবিত্ত মানুষ চায় আরও ক্ষমতা, ভোগবাদী জীবন, অর্থ। এই ভোগবাদী জীবন ও বড়লোক হবার বাসনা তাঁকে করে দেয় বিবেকশূন্য, মূল্যবোধহীন, চেতনাহীন। এই গল্পে বহুস্তর, বহু চরিত্রের নষ্টামি প্রাধান্য পায়। আসলে নষ্ট সময়টাকেই লেখক নানাভাবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। গল্পলেখক, অধ্যাপক মৃদুল মুখোপাধ্যায় যিনি ‘ভয় করে’ গল্প লিখেছেন তিনিও অর্থের জন্য সত্যকে চাপা দিতে চেয়েছেন। শ্রীলেখা স্বপ্ন দেখেছে অন্ধ ভিখিরিকে বহু অর্থ ও দান দিলে স্বামী সুস্থ হবে ও ভোটে অবশ্যই জয় লাভ করবে। গল্পে আছে ভিখিরি ভূতো ভট্টাচার্যের কথা। যিনি জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অন্ধ। মামা বলেছিল অন্ধ হবার ভান করলে ভিক্ষা ভালো জুটবে। কিন্তু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হয়? ভূতো দেখেছে শ্রীলেখাদের অবিশ্বাস, ভিখিরি অন্ধ কি না তা প্রমাণের চেষ্টা। সেখানেও সে জীবনকে বাজি রেখে অন্ধত্বের পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিন্তু লালমোহন কর্তৃক ধর্ষণে আর নিজেকে অন্ধ বলে গোপন রাখতে চায়নি। পুলিশ, মিডিয়াকে জানাতে চেয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত অধ্যাপক মৃদুল না করেছে। কেননা ভূতো সেসব ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়ে অন্ধ নয় প্রমাণিত হলে শ্রীলেখার দেওয়া টাকার অর্ধেক (দশ লক্ষ) হাতছাড়া হবে। ধর্ষণ দেখে যিনি ‘ভয় করে’ শব্দবন্ধে মিডিয়াকে স্টেটমেন্ট দেন, লিটল ম্যাগাজিনে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে ‘ভয় করে’ নামে গল্প লেখেন তিনিও একটি ধর্ষণের প্রকৃত আসামীদের আড়াল করে গেলেন শুধুমাত্র অর্থের জন্য। হয়ত এই মৃদুলরাই আবার মোমবাতি মিছিলে নামবেন, মোমবাতি শিল্পের প্রসার ঘটাবেন, গল্পে আবার লিখবেন—

 

"সব পুরুষই শালা প্রাক ধর্ষণ সংখ্যার সহ সম্পাদক, চান্স পেলেই সম্পাদক হয়ে যাবে ধর্ষণ সংখ্যার।"

(তদেব, পৃ. ১০১)

 

যে মানুষ জীবনে খেতে পারে না, বাঁচতে পারে না তাদের কতটুকু দোষ দেওয়া যায়? তাই ভূতো ভট্টাচার্যের দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। যে জীবনে কোনদিন অর্থের মুখ দেখেনি, একবার সুযোগ পেয়েছে তা কি আর হাতছাড়া করা যায়? তবুও সে ধর্ষণের সত্য প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিল অর্থের তোয়াক্কা না করেই। অথচ এই মৃদুলরা? এঁরাই সমাজের আজ বড় প্রতরাক। এই মিডল ক্লাসই সমাজকে বিরাটভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং যায়। অথচ দোষ চাপিয়ে দেয় অন্যের ঘাড়ে। সেই ভণ্ড মিডল ক্লাসকে লেখক তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন। শাণিত গদ্যে ভেকধারী মধ্যবিত্তের আপাত সুখী জীবনযাত্রা ও সভ্যবেশের মধ্যে কোথায় ভণ্ডামি, আঁতলামি লুকিয়ে আছে খুঁজে বের করেছেন। যা গল্পকে পৌঁছে দিয়েছে পৃথক মূল্যে। 

 

‘দ্বিচিত্র’ (জলার্ক, ২০১৫) জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প। এক নারী দুই পুরুষসময়ের জটিলতা যে নেই তা নয়। আছে সূক্ষ্মভাবে। পাপিয়ার জীবনে দুই পুরুষ, বন্ধু অরিত্র, প্রেমিক ইন্দ্র। নিম্নবিত্ত পাপিয়ার রাজরানি হবার স্বপ্নের গল্প। আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশার গল্প। আছে ঠাকুমা ক্যাতায়নীর জীবনস্বপ্নের কাহিনি। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের শ্রেণিচরিত্রের যে প্রভেদ তা স্পষ্ট হয়েছে। জীবনস্বপ্ন ও ভোগাকাঙ্ক্ষায়  দুই শ্রেণির চিত্র লেখক অত্যন্ত সচেতনভাবে বুনে চলেন। ইন্দ্র শুধু অর্থের প্রত্যাশী, অরিত্র শিল্পী মানুষ। ইন্দ্র পাপিয়াকেও রাজনীতিতে নামাতে চেয়েছিল কিন্তু শেষে সে পড়াশুনায় ফিরতে চেয়েছে। সময়ের মন্থনজাল থেকেই উঠে এসেছে লেখকের আখ্যান, আখ্যানে রূপায়িত চরিত্রগুলি। যে সময় বিভাজিকা মানুষকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকারবোধ কেড়ে নিচ্ছে তাই লেখককে ভাবিয়েছে। পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল সেটাই একজন লেখকের প্রকৃত কাজ। আর সে কাজটাই তিনি করেছেন সচেতনভাবে। ‘নাটকীয়’ (জলার্ক, ২০১৭) গল্পে পশ্চিমবঙ্গের একটা ভয়ংকর সময় প্রাধান্য পেয়েছে। মাওবাদী হামলা থেকে পাঠ্য তালিকায় গীতা মহাভারতের অন্তর্ভূক্ত ঘটনা পর্যন্ত আখ্যান এগিয়ে গেছে। সরকার গণতন্ত্রের নামে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ মুখে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, মানুষের সেবা সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষিত হচ্ছে। এই গণতান্ত্রিক ঢ্যামনামি প্রচারিত হচ্ছে দালাল মিডিয়ার দৌলতে। মানুষের নাটক করার অধিকার, সরকারের ভুল ধরার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আছে সুযোগ বুঝে বদলে যাওয়া মানুষ। যে মহাদেব কাকারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পথনাটক রচনা করেছিল সেই মহাদেবরাই সরকারের গুণকীর্তনে যাত্রা করে চলেছে। গল্পের বয়ানে এসে উপস্থিত হয় পল পট (যিনি কৃষি সংস্কারের নামে কম্বোডিয়ায় কুড়ি লক্ষ কৃষককে হত্যা করেছিলেন) থেকে হিটলার, মুসোলিনি। সেদিনের ‘রক্তকরবী’র রাজার অত্যাচার আজও চলছে। শুধু চরিত্রগুলি পাল্টে গেছে। তবে সব কিছু নষ্ট হয়ে যায়নি। শৈবাল ফ্যাসিজম নিয়ে লিখছে, রঞ্জনদারা ফ্যাসিজম নিয়ে সংখ্যা করছে। নবীন প্রজন্মের রামেশ্বর মহাতো, নিলেন রায়, তারক মণ্ডলরা এগিয়ে এসেছে। প্রত্যেকেই নিজেদের কাজ করেও শোষণ, দূর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছে। অথচ ফ্যাসিস্ট সরকার তো ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা বিরোধীতা করা লোক রাখতে চায় না। সে শুধু বলে আমার পাশে থাকো। কিন্তু সচেতন মানুষ তো ফ্যাসিবাদ বা দুর্নীতিকে আপস করে নিতে পারেনা। অবধারিত পরিণাম মৃত্যু। রামেশ্বর, নিলেন, তারকরা মৃত্যুর কবলে পড়ে। সরকারের দূর্নীতির পাশাপাশি প্রতিনয়ত চলছে ধর্ষণ, খুন, চিট ফান্ডে মন্ত্রীর কেলেঙ্কারি, চাকরিতে ঘুষ, বন্ধ, ধর্ণা, সাধারণ মানুষকে টুপি পড়ানো, জনহিতকর প্রকল্পের নামে জনতোষণ, জনশোষণের নানা ফাজলামি। সরকার ও রাষ্ট্রের কী করা উচিত ছিল আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই দুই বিন্দুর মধ্যবর্তী পরিসরকেই পুষ্পল মুখোপাধ্যায় অঙ্কন করেছেন নানা আখ্যানে, নানা মাত্রায়। কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নয়, সমর্থন-অসমর্থন নয়, রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত নয় নষ্ট সময়টাই লেখককে বারবার আঘাত করেছে। আসলে গোটা সমাজব্যবস্থাটাই কীভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা তিনি টের পেয়েছেন। সেই যন্ত্রণা থেকেই, যেই যাপনচিত্র থেকেই উঠে এসেছে এইসব আখ্যান।

  

নিজের পরিচয় কীভাবে দিতে হয় তা আমার জানা নেই। রবি ঠাকুরের মতো  তো আর বলতে পারি না আমি পৃথিবীর সন্তান। আমি মায়ের সন্তান। আত্মগত পরিচয়ের ঢাক-ঢোলের মধ্য দিয়ে লেখক(অলেখক) হয়ে ওঠার যে বাসনা তা আমার ধাতে নেই। তবুও যখন আপনার একটা পরিচয় চাই নইলে আপনি লেখা পড়বেন না, তবে বলা যেতে পারে এক বিধ্বস্ত সময়ের সন্তান আমি। বাঙালির যখন সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নিজের বলে আর কিছুই থাকছে না সেই ধ্বংসকালে বড় হওয়া অকালপক্ব যুবক আমি। এই পরিচয়ও শুনবেন না? তবে বাদ দিন। জরুরি সত্য +তথ্যের ভিত্তিতে জানানো যেতে পারে পাঁচটি গ্রন্থ (নিজের লেখা তিন+সম্পাদনা দুই) ও একশোরও অধিক প্রকাশিত প্রবন্ধের মালিক আমি।




সব বানানো গল্প

বিশ বছর ধরে প্রকাশিত দিনবদলের দলিলগাথা এই বই। সামাজিক পরিসরের অন্তরে থেকেও যেন এক স্বাধীনজীবীর বৈঠকখানা । পাঠকের জন্য অবশ্য সংগ্রহযোগ্য । 

  •  পৃষ্ঠাসংখ্যা - ১২৮ (বোর্ড বাঁধাই, বুকমার্কার সহ)
  • বিনিময় - ২২৫ টাকা (প্রিন্টেড)( নিজস্ব দপ্তর থেকে কিনলে ১৬০টাকা)

 ।। বইটি  সংগ্রহ করুন  ।। 

  • নিজস্ব পত্রিকা দপ্তর - বইবাসনা (বর্ধমান) (যোগাযোগ - ৮৯১০৩২৩৫৬২)
  • ইতিকথা বইঘর (কলেজ স্ট্রিট ও অনলাইন)
  • ধ্যানবিন্দু (কলেজ স্ট্রিট)
  • কল্যাণ ঘোষের স্টল (রাসবিহারি অ্যাভিনিউ)

Saturday, February 6, 2021

আঁদ্রে ব্রতোঁ ও স্যুররেয়ালিস্ট আন্দোলন

লিখেছেন সৈয়দ কওসর জামাল

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ




[১৯১৫ সাল—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। উনিশ বছরের এক তরুণ, বাধ্যত তখন ফরাসি গোলন্দাজবাহিনীর সদস্য হলেও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কবি আপলিনের-কে পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা দুটি কবিতাসহ একটি চিঠি। তরুণটির পিতা প্যারিসের উপকণ্ঠে এক গ্লাসোয়ার্ক ফ্যাকটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র ডাক্তারি পড়ে পরিবারটিকে সম্মানজনক বুর্জোয়া প্রেণিতে স্থাপন করবে। কিন্তু মেডিসিনের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি তরুণ, আসলে কোনো বস্তুগত বিষয়ের দিকেই আগ্রহ ছিল না তাঁর, উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষকের কাছে মালার্মের কবিতা শোনার পর থেকে তাঁর উচ্চাশা জেগেছিল তিনিও কবি হবেন। ]


আপলিনের ফেরাননি তাঁকে—চিঠির উত্তরে জানিয়েছেন, ‘তোমার লাইনগুলোতে আমি এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভার পরিচয় পাচ্ছি’। বরিষ্ঠ কবির সঙ্গে তরুণ কবির এই যোগাযোগ এভাবেই শুরু হয়েছে। ‘আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পেরে আনন্দিত’, কখনও লিখেছেন, ‘তোমার মনে যেসব প্রশ্ন আসবে আমাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য, আমার চিঠিতে সে সবের উত্তর পাবে’, আর তরুণ কবিকে সম্বোধন করেছেন, Mon cher poète, ‘আমার প্রিয় কবি’ বলে। আপলিনের-এর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে উৎসাহিত এই তরুণ কবি,  আঁদ্রে ব্রতোঁ, দুটি সনেট লিখে পাঠিয়েছেন আর এক কবি-ব্যক্তিত্ব পল ভালেরিকে। বস্তুত এই সনেটদুটি—Décembre (ডিসেম্বর)  ও  A vous seule (শুধু তোমাকে)—মালার্মে-প্রভাবিত হলেও কবিতা রচনায় ব্রতোঁ-র একটা নির্দিষ্ট ঝোঁক লক্ষ করা গেছে। ভালেরি দ্বিতীয় কবিতাটিতে অন্তর্জগতের দ্বন্দ্বের উল্লেখ করেছেন। ব্রতোঁকে চিঠি লিখে ভালেরি জানান—

 

তোমার পাঠানো শেষ কবিতা পড়েছি। আমার মনে হয়েছে তুমি এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছো চিকিৎসকরা যাকে বলবেন সঙ্কটজনক। কবিতাদুটির ছন্দময় প্রবাহ, নির্দিষ্ট ধাঁচের মধ্যে মানিয়ে-যাওয়া নৈপুণ্য, আকস্মিকতার যে ইচ্ছাকৃত ও প্রতিমুহূর্তেই গুটিয়ে-নেওয়া ব্যবহার—এ সব থেকে বোঝা যায় যে তুমি বুদ্ধিবৃত্তির এক মিশ্রণ বা স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছেছ, যে অবস্থাটি সম্পর্কে আমি সম্যক জানি এবং যেখানে র‍্যাঁবো ও মালার্মের মতো চির-অমিল দুজন এক কবির মধ্যে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করছে।

 

স্পষ্টতই ভালেরি ব্রতোঁর কবিতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিও ব্রতোঁর কবিতায় মালার্মের সঙ্গে র‍্যাঁবোরও প্রভাব লক্ষ করেছেন। এই সময়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছে Mont de piété (১৯১৯) কাব্যগ্রন্থে। ব্রতোঁ কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ১৯১৪ সাল থেকে। ১৮৯৬ সালে জন্ম, তাই তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিল তাঁর মন। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছিল প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র ও সমুদ্রতীরের বর্ণনা। আসলে আঁদ্রের জন্ম নরম্যান্ডির পুরোনো ফরাসি শহরে হলেও তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল ফ্রান্সের অ্যাটলান্টিক উপকূলে ব্রিটানির বন্দরশহর লরিয়া-তে। এ সবই তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যে জীবন ব্রতোঁ কাটিয়েছিলেন তার সঙ্গে প্যারিসের দুস্তর ফারাক। তাঁর পিতার কথা আমরা বলেছি। মা সম্পর্কে ব্রতোঁ নিজেই লিখেছেন যে তিনি ছিলেন স্পষ্ট বক্তা, প্রাচীনপন্থী, এবং কোনো কিছু মনোমতো না হলে খুব রূঢ় হয়ে উঠতেন। বাবা-মার শাসন ও পুরোনো পন্থা হয়তো আঁদ্রে ব্রতোঁকে কোনো বাধা ও প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মানসিকতা তৈরি করেছিল। প্যারিসের স্কুলে আঁদ্রে পড়েছেন ১৯০৭ সাল থেকে, স্নাতক হয়েছেন ১৯১২তে এবং ১৯১৩তে সরবনে মেডিশিন পড়তে গেছেন। এই ডাক্তারি পড়ার প্রভাব ব্রতোঁর কবিতায় এসেছে নানা শব্দের ব্যবহারে।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোলন্দাজ বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে হলেও পরে তাঁকে নঁত-এ হাসপাতালের নিউরোলজিক্যাল সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ করার পর তাঁকে আবার পাঠানো হয়েছে স্যাঁ-দিজিয়ের-এর সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে চিকিৎসা সহকারি হিসেবে। প্রথমে নঁত ও পরে স্যাঁ-দিজিয়ের এই দুই জায়গায় কাজের ফলে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি দেখেছেন কী ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভোগে সৈন্যরা; এছাড়া তাদের চিকিৎসার জন্য যে সব পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, যেমন জঁ-মার্ত্যা শারকো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও পিয়ের জানে-র প্রায়োগিক চিকিৎসা-পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ব্রতোঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মানুষের মনের চিন্তাপদ্ধতি, গঠন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। মনের অবচেতনের অস্তিত্ব ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা  জেনেছেন ফ্রয়েডের কাছ থেকে। সব কিছুই ব্রতোঁর স্যুররেয়ালিস্ত কবিজীবনকে প্রভাবিত করেছে। স্বপ্ন ও অবচেতনকেই কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। তাঁর অটোমেটিক রচনার উৎস এই মনোবিজ্ঞানের পাঠ। বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ফিলিপ সুপো-র সঙ্গে মিলিতভাবে রচিত কাব্য Les Champs magnétiques (১৯২১) ও তাঁর একক কাব্য Poisson soluble-এ। উপন্যাস ‘নাদজা’তেও দেখি এক রহস্যময় নারীকে যিনি সাইকোসিসের রোগী। এ ছাড়া পল এলুয়ার-এর সঙ্গে মিলিতভাবে ব্রতোঁ লিখেছেন L’Immaculée Conception; এই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কথার ভিতর দিয়ে কাউকে উজ্জীবিত করা, যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অপ্রকৃতিস্থতার চিন্তাক্রম।

 

১৯১৭ সালে যুদ্ধের মধ্যেই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বন্ধু জাক ভাশের সঙ্গে আপলিনের-এর লেখা ‘স্যুররেয়ালিস্ত’ নাটক ‘Les Mamelles de Tirésias’(তিরেসিয়াসের স্তন) দেখে কৌতূহলী হন ব্রতোঁ এবং তাঁর ধারণা হয়েছিল যে এই নাটকের ভাবনা শিল্পকলার জগতে এক গভীর পরিবর্তন আনতে চলেছে। আপলিনের তাঁর চিন্তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে –‘মানুষ যখন হেঁটে যাওয়াকে অনুকরণ করতে চেয়েছে, তখন সে চাকা আবিষ্কার করেছে, যা দেখতে পায়ের মতো নয়। এটা না জেনেই সে স্যুররেয়ালিস্ত হয়েছে’।

 

চিরকালের ‘মূর্তিভঙ্গকারী’ ভাবধারা ও নতুনত্বের পক্ষে থেকেছেন আঁদ্রে ব্রতোঁ। নতুন ধ্যানধারণাকে গ্রহণ করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুই ছিল তাঁর। নতুনের অন্বেষণেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন দাদাবাদীদের। ১৯১৭ সালেই তিনি দাদাবাদীদের মুখপত্রের দুটি সংখ্যা পড়েছিলেন। তৃতীয় সংখ্যা ‘দাদা’ পড়েছেন আরো দুবছর পরে। ১৯১৯-এই  পড়েছেন ত্রিস্তাঁ জারার ‘দাদা মানিফেস্ত ১৯১৮’। ইস্তেহার অনুযায়ী ‘শৃঙ্খলা=বিশৃঙ্খলা; অহং=আত্মহীনতা; নিশ্চিতি=অনিশ্চিতি’। তাঁদের নীতি – ‘প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ বলা মানে ভণ্ডামি, ‘নিজেকে জানো’ বলাটা ইউটোপীয়, তবু এর মধ্যে মালিন্য থাকায় কিছুটা গ্রহণীয়। আমরা ভীত নই, কারণ আমরা আবেগপ্রবণ নই। আমরা ঝোড়ো বাতাসের মতো মেঘ ও প্রার্থনার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে দিই; আমরা প্রবল বিপর্যয়, বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড ও পচন-দৃশ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছি... প্রতিটি মানুষের চিৎকার করা দরকার; খুবই ধ্বংসকারী, নঙর্থক চেষ্টায় সামিল হতে হবে।‘ কিংবা ইস্তাহারের ঘোষণা—‘ মুক্তি : দাদা দাদা দাদা, কুঁকড়ে যাওয়া রঙের আর্তনাদ, বৈপরীত্য ও যত রকমের বিরোধ, বীভৎসতা ও অপরিণামদর্শিতা : জীবন’।  ইস্তেহারের এই ভাষা ব্রতোঁ ও তাঁর দুই কবিবন্ধু সুপোল ও আরাগঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চিন্তা ও মূল্যবোধের জগতে যে আঘাত করেছিল তার সেই হতাশা ও মরিয়া অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দাদাবাদকে তাঁরা দেখেছেন।  

         

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদাবাদীদের বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল নৈরাজ্য ও প্রলাপসর্বস্ব হট্টগোলের আশ্রয়। ফলে নঙর্থক এই আন্দোলন থেকে তাঁরা সরে এসে বিদ্রোহকে নতুন রূপ দিতে চেয়েছেন ‘স্যুররেয়ালিসম’ (Surréalisme) -এর আশ্রয়ে। এক দিক থেকে, দাদাবাদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্যুররেয়ালিসমের বীজ। দাদাবাদ যদি নাস্তির আশ্রয়, স্যুররেয়ালিসম তবে ছিল নাস্তির নাস্তি। এ এক নতুন স্বীকৃতি যা পরিলক্ষিত হয়েছে সদর্থক সৃষ্টিশীলতায় ও আদর্শবাদী ভাবনায়। ১৯২৪ সালের ‘দ স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে লেখা হয়েছিল—‘মানুষের অধিকারের নতুন ঘোষণা হওয়া দরকার’। ১৯২০ থেকে ১৯২৪—দাদাবাদ থেকে স্যুররেয়ালিসম—বিবর্তনের এই কালকে বলা হয়েছে নিদ্রার কাল, ‘লা পেরিওদ দে সোমেই’।

 


এই ‘নিদ্রাকাল’-এর মধ্যেই ১৯২২ সালে প্রকাশ পেয়েছে ব্রতোঁর পত্রিকা Littérature-এর একটি সংখ্যা, যেখানে  ২৪ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছিল প্রতীকবাদীদের মধ্যে তখনও সক্রিয়—ভালেরি, আঁদ্রে জিদ ও লেয়ঁ-পল ফার্গ-এর কবিতা ও গদ্য। ছিল ব্রতোঁ-র ‘ক্লে দ সল’ ও আরাগঁ-র একটি ছোটো কবিতা। এই সংখ্যাতেই ব্রতোঁ জানিয়েছেন কীভাবে তাঁর Les Champs magnetiques কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর সঙ্গে মিশে ছিল স্বপ্ন এবং ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছিল কবিবন্ধুদের মধ্যে। এখানেই ব্রতোঁ ‘স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এইভাবে—

 

শব্দটি আমরা আবিষ্কার করিনি, কিন্তু নির্দিষ্ট অর্থে প্রয়োগ করেছি। আমরা সহমত হয়েছি এর মধ্য দিয়ে বোঝাব ‘সাইকিক অটোম্যাটিজম’ যা কমবেশি স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তবে এই স্বপ্নাবস্থার সীমা বেঁধে দেওয়া এখন খুবই কঠিন।

স্যুররেয়ালিসম তখনও আন্দোলনের রূপ পায়নি, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে ভেবেছেন ব্রতোঁ। তাঁর মনে হয়েছে ‘কবিতা হল আমাদের জীবনের সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান’। যে কবিতার প্রশংসা তিনি করেছেন, ভেবে দেখলেন, ‘তা এসেছে মানুষের জীবনের ভিতর থেকে’। মানুষের জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে হয়েছে ‘এ এক পথ যেখানে মেনে নেওয়া যায় না এমন মানবিক অবস্থাকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে’। তাঁর মতে, ‘শব্দ ও ভাষা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এবং মানুষের মনই যোগ্যতম বিপ্লবের স্থান’। অর্থাৎ, কবিতা কোনো পৃষ্ঠার ওপর শব্দ নয়, তা একটা মাধ্যম যা দিয়ে স্বপ্ন পূর্ণ করা এক পৃথিবীতে প্রবেশ করা যায়।

 

ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলন, যাকে বলা হয়েছিল ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’, স্পষ্টতা পেয়েছে ১৯২৪ সালে ‘মানিফেস্ত্ দ্যু স্যুররেয়ালিসম’ বা স্যুররেয়ালিস্ত ইস্তাহার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। এই ইস্তেহার রচনা করেছেন ব্রতোঁ। এবার তিনি স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দিলেন এইভাবে—

 

স্যুররেয়ালিসম, বিশেষ্য, পুংলিঙ্গ। বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা (automatisme psychique pur), যার          সাহায্যে মৌখিক বা লিখিতভাবে চিন্তার প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। এ হল নন্দনতাত্ত্বিক বা নৈতিক   বিষয়ের বাইরে, যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় চিন্তার কর্তৃত্ব (dictée de la pensée)।

 

দার্শনিক অর্থ : স্যুররেয়ালিসম বিশ্বাস করে নানা ধরনের অনুষঙ্গে প্রকাশিত, যা এতকাল অবহেলিত, এক উচ্চ বাস্তবে (réalité supérieure), স্বপ্নের সার্বভৌমত্বে এবং চিন্তার নিস্পৃহতায়। এর উদ্দেশ্য অন্য সমস্ত মানসিক কলকব্জাগুলোর চিরতরে বিনাশ (ruiner définitivement tous les autres          mécanismes  psychiques) এবং জীবনের প্রধান সমস্যাজাত সিদ্ধান্তের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন।

 

 অবচেতনকে তিনি করলেন কাব্যের উৎস—অবচেতনেই কাব্যের মুক্তি। ইস্তাহারে ব্রতোঁ বললেন—‘আমি বিশ্বাস করি যে আপাতবিরোধী দুই মানবিক অবস্থা অর্থাৎ স্বপ্ন ও বাস্তব অপসৃত হয়ে তাদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হবে এক নতুন বাস্তব, এক  surréalité’। এই অবস্থাকেই কি জঁ আর্ত্যুর র‍্যাঁবো বলেছিলেন dérelegment de tous les sens, সমস্ত চেতনার বিপর্যয়?  এভাবেই ব্রতোঁ চাইলেন ‘মানসিক স্বয়ংক্রিয়তার জগতে’ প্রবেশ করতে। তার জন্য উদ্ভাবন করতে হবে স্বয়ংক্রিয় রচনাপদ্ধতি। স্যুররেয়ালিস্তদের ‘বিপ্লবী’ রচনা প্রকাশের জন্য সম্পাদিত হল নতুন পত্রিকা ‘লা স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’। সবাই প্রাথমিকভাবে বিনা প্রশ্নে ব্রতোঁকে মেনে নিয়েছেন স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলনের নেতা হিসেবে। ব্রতোঁর জন্যই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ফিলিপ সুপো, ল্যুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, বেঞ্জামিন পেরে, রবের দেসনস প্রমুখ কবিরা।

         

১৯২৪ সাল থেকে আঁদ্রে ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্তদের নতুন নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ শুরু হয়েছে। কবিকল্পনা ছিল তাঁদের মনে আর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন ছিল তাঁদের চোখে। স্যুররেয়ালিসম যে কোনো ্দার্শনিক প্রস্তাবনা নয়, শিল্প-সাহিত্যের এক নিরীক্ষা মাত্র, তা স্পষ্ট করে দিয়ে ব্রতোঁ বলেছেন, ‘ কবিতা চর্চা করতে হবে’। এই চর্চার অর্থ এমন ছিল না যে সবাই একসুরে কথা বলবেন। প্রত্যেক কবিরই নিজস্ব ও পুর্বলব্ধ ধারণা ছিল, এ কথা ব্রতোঁও স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

১) আমাদের কোন প্রতিভা নেই; উৎপাদনের স্বয়ংক্রিয় দ্রব্য এবং নিম্ন আয়ের বসবাস  লম্বা শহরগুলোকে ধ্বংস করবে (ফিলিপ সুপো)

২) আমি যে গল্প বলছি তা বহুবার বলা, একটি কবিতা যা আমি পুনর্বার পড়ছি : আমার তরুণ কান ও  পুড়ে খাস্তা হয়ে যাওয়া ঠোঁট নিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ছি দেওয়ালের দিকে। (পল এলুয়ার)

৩) পার্টি শেষ হলে খেলোয়াড়রা যখন পানপাত্রের সামনে জড়ো হয় তখন আমি গাছটিকে জিজ্ঞেস করি সে কি সবসময় লাল রিবন পরে থাকে? ( লুই আরাগঁ)

 

আর ব্রতোঁ কবিতায় লিখেছেন—

 

          ১)পাথরের টুপিগুলো স্ফটিক হয়েছে

          তারা হিম আটকাচ্ছে সজোরে আঘাত করা শিরোস্ত্রাণ দিয়ে

          তারপর বিদ্যুতের দারুণ ঝিলিক

          ধ্বংসের পতাকায় আঘাত করে

          বালি এখন অনুজ্জ্বল এক ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়...

 

          ২)খাপছাড়া কিছু প্রাণী পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে

          তারা আমার কল্পনাইয় পৌঁছোনোর দিকনির্দেশ চায়

          যেটা নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীজুড়ে

          তবে দুপক্ষই ঘুরছে উলটোদিকে

         

স্যুররেয়ালিস্তদের এই সৃজনশীলতা সক্রিয় থেকেছে ১৯৩০ সালে স্যুরলিয়ালিসম-এর দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত। পরের পর্যায়ের রচনাগুলোকে ব্রতোঁ বলেছেন স্যুররেয়ালিসম-এর যুক্তির পর্ব। ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’-কে সংহত করতে চেয়েছেন ব্রতোঁ। এই সময় স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যায়। একটি হল—কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ। আর দ্বিতীয়টি হল—স্যুররেয়ালিসমকে পশ্চিম ইউরোপ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁরা যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছিলেন সে কৃতিত্ব অবশ্যই আঁদ্রে ব্রতোঁর প্রাপ্য।

 

ব্রতোঁর নিজের সাহিত্যকৃতিতে তাঁর কবিতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর অন্যান্য রচনার তুলনায় কবিতা পরিমাণের দিক থেকে বেশ কম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ Mont de piété (১৯১৯) থেকে শেষ প্রধান কাব্যগ্রন্থ Ode à Charles Fourier (১৯৪৭) পর্যন্ত ব্রতোঁর কবিতায় সংগতি ও সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর চিত্রকল্প, যেখানে কল্পনাশক্তির সঙ্গে মেশে মানুষের মূল প্রবণতা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো, কখনও আবার দুর্বোধ্য অযৌক্তিকতার উদ্ভট রূপ গ্রহণ করে। চিত্রকল্পের মধ্যে আছে এমন তুলনা যা পরস্পরবিরোধী এবং এক উপমা থেকে হঠাৎ-ই অন্য উপমায় চলে যাওয়া আছে। তবে সব উপমাই স্বতঃস্ফূর্ত, ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা বলে মনে হয় না। অটোমেটিক রচনার এটাই বৈশিষ্ট্য যে তার মধ্যে থাকে চিন্তার বাস্তব প্রক্রিয়া; যে চিন্তার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে যৌনতা, অবচেতনের আকাঙ্ক্ষা ও চেতন মনের প্রকাশ। স্যুররেয়ালিস্তরা চেয়েছিলেন অবচেতনের জগতে প্রবেশ করে বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করতে। কারণ, ব্রতোঁ বলেছেন, ‘বিস্ময় সবসময় সুন্দর’।

 

ব্রতোঁর কবিতার চিত্রকল্প স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে তাঁর লেখনশৈলীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য। একটি বৈশিষ্ট্য হল বাক্যগঠনের পরিচিত ছকটিকে ভেঙে ফেলা, যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ কূটাভাস থেকে ভাষাগত বৈপরীত্য, অন্বয়গত অস্পষ্টতা, ও প্রসঙ্গের জটিলতা। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যভাষা, যা কাব্যিক ইমেজে-এর নাটকীয় প্রকাশে সহায়তা করে। এই ভাষার সামর্থ্যের জায়গা হল ব্রতোঁর সীমাহীন শব্দভাণ্ডার। এই শব্দভাণ্ডারে আছে শারীরবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষঙ্গ, কিন্তু সমস্যা হল সেসব অনুষঙ্গ প্রায়শই কবিতার পাঠকের কাছে পরিচিত নয়। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত হল একই বিষয়ের পুনঃপুন ব্যবহার ও প্রতীকধর্মী ‘মোটিফ’, যেমন রিভলভার হল যে কোনো ধরনের বিদ্রোহ বা বিপ্লবের আলঙ্কারিক ইমেজ।

 

ব্রতোঁর কবিতায় তিনটি মূল ধারণা প্রকাশ পেয়েছে—এক, কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতা; দুই, জাগতিক পৃথিবীর ইউটোপীয় রাজ্যে রূপান্তর; এবং তিন, ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানবিক সামর্থ্যের অনুসন্ধান। তাঁর কবিতায় এই স্যুররেয়ালিস্ত দৃষ্টিভঙ্গিই ধরা পড়ে। মানবিক কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতায় ব্রতোঁর বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল আধুনিক মনোবিশ্লেষণমূলক চিন্তা, বিশেষ করে অচেতনের ক্রিয়াকলাপে ফ্রয়েডের চিন্তা। ব্রতোঁর কাছে অচেতন বলতে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ স্থান বা শক্তি বোঝায় না, বরং তা হল জাগতিক বাস্তবতার জগৎ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ যা নিয়ে যায় পরাবাস্তবতার জগতে। আর পরাবাস্তবতার এই জগতে মানুষের যুক্তি ও কল্পনা পরস্পরের বিরুদ্ধে পড়াই করে না, বরং একসঙ্গে মিলে কাজ করে—এটাই হল মোক্ষম বাস্তবতা, আমাদের প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য এই বাস্তবতার চিহ্নগুলোর ক্রমাগত সন্ধান, এবং সেই অভিজ্ঞতা লাভ করার অর্থই হল জীবন বদলে যাওয়া।  সব মানুষের পক্ষেই এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য আছে, এমন বিশ্বাস  ব্রতোঁ করলেও শিল্পীদের পক্ষে তা অবশ্যই যোগ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করেছেন। শিল্পীর কাজ হল তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এই ‘আশ্চর্য’ (le merveilleux) –এর চিহ্নগুলোকে উপস্থাপিত করা। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্যুররেয়ালিস্তরা নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে দুটি পদ্ধতির কথা ব্রতোঁর কাজের মধ্যে আমরা পাই—এক) বিশ্বের hazard objectif  বা বস্তুগত ভাগ্যের কাছে মানুষের আত্মসমর্পণ এবং দুই) অটোমেটিক লেখার মধ্যে দিয়ে অবচেতনের প্রাথমিক প্রক্রিয়াকে গ্রহণ। প্রথম পদ্ধতির উদাহরণ আমরা পেয়েছি ব্রতোঁর Clair de terre (পৃথিবীর আলোয়) কাব্যগ্রন্থের Au regard des divinités (দেবতাদের চোখে) কবিতা—

মধ্যরাতের একটু আগে সিঁড়ির কাছে

অবিন্যস্ত চেহারার কোনো নারী যদি তোমাকে অনুসরণ করে তাকিয়ো না তার দিকে।

এ হল নীল। নীলের থেকে তোমার ভয়ের কিছু নেই।

গাছের ওপরে থাকবে এক লম্বা সোনালি চুলের পাত্র।

গলিত রঙের গ্রামের কুণ্ডলীর একটি পাক

তোমার দিকচিহ্ন হবে। সহজভাবে নেবে,

মনে রেখো। অন্ধকার উষ্ণ প্রস্রবণ যা ছুড়ে দেয় ফার্নপাতা

আকাশের দিকে, স্বাগত জানায়

তোমাকে স্বাগত।

একগুচ্ছ নির্দেশনা কবির এবং hazard objectif পদ্ধতি, হঠাৎ-পাওয়া বাস্তবতার মধ্য দিয়ে থেকে উঠে আসছে এক ‘আশ্চর্যময়তা’ (le merveilleux)। ‘আশ্চর্য’কে আহ্বান করার আর এক পদ্ধতি অবচেতনার ভিতরে চিন্তার লাগামহীন অনুষঙ্গ, যা স্বয়ংক্রিয় লেখনিতে ধরা পড়ে—

১৯৩৪-এর মনোরম আধো-আলোর মধ্যে

বাতাস ছিল সাড়ম্বর গোলাপ ছিল লাল ফুলের মতো রং

এবং বন যখন আমি প্রবেশ করতে প্রস্তুত

শুরু করেছে এক বৃক্ষ দিয়ে, পর্ণ যার সিগারেটের পাতা

তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি...

 

La Clé des Champs গ্রন্থের ভূমিকায় ব্রতোঁ ব্যবহার করেছেন Le Merveilleux contre le Mystère, অর্থাৎ ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে রহস্যের বিরোধিতা আছে; রহস্য বাস্তব নয়, মানুষের অজ্ঞতাজনিত কল্পনা। ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে আছে বিস্মিত হওয়ার উপাদান। বাস্তবতার পরিচয় আবিষ্কারের পর মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। সুতরাং আশ্চর্যের অন্বেষণ রহস্যময় নয়, বরং মিস্টিসিজম-এর উপাদান আছে, যা কবির সঙ্গে সংপৃক্ত, দার্শনিকের সঙ্গে নয়। দার্শনিক বের্গসন এক মনের সংজ্ঞা দিতে চেয়েছিলেন যা যুক্তির নিয়ম মানে না; তিনি তাকে বলেছিলেন স্বজ্ঞা বা ইনটুইশন; আর ব্রতোঁ কবিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকে বলেছেন কল্পনা।          

 

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ

তবে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে শুধুমাত্র সৃষ্টিশীল কল্পনার সামর্থ্য দিয়ে পরিবর্তনের কথা ভাবেননি ব্রতোঁ, রাষ্ট্র ও সমাজকে সমাজতন্ত্রের চিন্তা দিয়ে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায়। ১৯৩০ সাল থেকে ব্রতোঁর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ এবং এই সংযোগ ফরাসি স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। এতদিন যাঁরা স্যুররেয়ালিসম-এর নন্দনতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভাবনায় আস্থা রেখেছেন তাঁরা বিশ্বাস করতে চাননি যে জীবন সম্পর্কে ধারণা রাষ্ট্র ও সমাজের বস্তুজগৎকে বদলে দিতে পারে। স্যুররেয়ালিস্তদের রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার এই  বিরোধিতাকে ব্রতোঁ দেখলেন স্যুররেয়ালিসম-এর প্রতি তাঁদের অপর্যাপ্ত আনুগত্যের ইঙ্গিত হিসেবে। অপরদিকে, যাঁরা বিরোধিতা করলেন তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকারী চরিত্র, তার শ্বাসরোধকারী নিয়মানুবর্তিতা এবং শিল্পকর্মের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করলেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রতোঁ তাঁর বিশ্বাস থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে চাননি। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ Ode to Charles Fourier তাঁর এই বিশ্বাসের পরিচয় বহন করছে। এই কবিতাগুলোতে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। 

ব্রতোঁর আর একটি বিশ্বাসের জায়গা ছিল প্রেমের পরিবর্তনকারী ভূমিকায়। কল্পনাশক্তির মতো প্রেমের ক্ষমতার প্রতি এই বিশ্বাস অন্য স্যুররেয়ালিস্ত কবিদেরও ছিল। ব্রতোঁর ধারণা, রোম্যান্টিক প্রেমের মধ্য দিয়েই মানুষ পার্থিব পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে পরাবাস্তবতার সীমাহীন অনন্ত জগতের দৃঢ় মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। তাঁর অনেক কবিতাতেই এই অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। ধারণাটি তাঁর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মূলত দুটি আকারে। প্রথমটি হল নারীকে গ্রিক পুরাণের দেবী ‘মিয়ুজ’ হিসেবে দেখা—প্রিয় নারী পরাবাস্তবের সঙ্গে সংযোগের সূত্র হয়ে ওঠেন, যেমন ব্রতোঁর বহুপঠিত দুটি কবিতা—Catalogue poème Free Union—প্রেমিকা ও কলূষমুক্ত প্রকৃতির জগতের মধ্যে জাদুকরি সম্পর্কের উদযাপন। Free Union দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে

আমার স্ত্রীর আছে কাঠের আগুনের চুল

তার আছে বিদ্যুৎ উত্তাপের মতো ভাবনা

আওয়ারগ্লাসের কটি

তার কটি বাঘের দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা ভোঁদড়ের

গোলাপ আকৃতি মুখ তার আর একগুচ্ছ নক্ষত্র ...

                                                           

আর Fata Morgana-তে দেখা যায় নতুন প্রেমের আবিষ্কারে কবির আনন্দপূর্ণ উদ্দীপন। দ্বিতীয় রীতি হল প্রেমের জাদুকরি শক্তির প্রতি এই বিশ্বাস যে কাব্যসৃষ্টির সঙ্গে যৌনপ্রেমকে সমদৃষ্টিতে দেখা, যেমন Sur la route de San Romano (সান রোমানোর রাস্তায়)—

কবিতা সৃষ্ট হয় বিছানায় প্রেমের মতন

তার এলোমেলো চাদরেরা হল নতুনের ভোর

 

আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি যে ব্রতোঁর প্রেমের কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর প্রভাব। তাঁর এই ধরনের কবিতায় ‘ইরোটিক’ বিষয়ও তাঁর কাব্যিকতার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। তাঁর কবিতায় শরীরী বর্ণনাতে মিশে আছে কাব্যিক ফ্যান্টাসির উপাদান। এক অবাস্তব রূপকথার পরিবেশ জড়িয়ে থাকে এই প্রেমের কবিতাগুলোতে। স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে আসে শরীরী উপাদান—

স্বপ্নে দেখি তুমি নিজেকে নিজের ওপর স্থাপন করে রেখেছ অনির্দিষ্টকাল

নিজেকে বসিয়ে রেখেছ প্রবাল-আসনে

তোমার আয়নার সামনে তুমি

চিরুনির জলের অংশে আছে তোমার দু’আঙুল

...

আমার আদর যাকিছু শুধুই তুমি

তোমার সবকিছু, এখনো যা হয়ে ওঠেনি

                                                        (Poèmes, ১৯৪৮ থেকে)

 

 ব্রতোঁর কবিতার আলোচিত তিনটি চিন্তাস্তর প্রভাবিত করেছে স্যুররেয়ালিস্ত কবি ও লেখকদের। তিনি নিজেও পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্বস্ত থেকেছেন নিজের ভাবনায়। ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও যে ধারণা তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন চিন্তায়, ইস্তাহারে, ও নিজের কবিতায়, তা এখনও সক্রিয় থেকে বিশ্বকবিতাকে আচ্ছন্ন ও  প্রভাবিত করে রেখেছে। 


[ লেখকের কর্পোরেট বায়োডাটা হয় না । লেখকের পরিচয় জন্মসাল-মৃত্যুদিনের উৎসব পালনে নেই । লেখক বেঁচে থাকেন স্রেফ লেখায় । সৈয়দ কওসর জামাল, একজন দাপুটে বাঙালি কবিপ্রাবন্ধিকঅনুবাদক ও সম্প্রচারক। আছে ১০ টি প্রকাশিত কবিতার বই এবং কবিতা সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধের সংকলন । শত শত সাহিত্য প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

পেয়েছেন, ১৯৯৫ সালে আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার । সোপন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে, কবিতা গ্রন্থ 'চেরনোবিলার মেঘএর জন্য ।]


সৈয়দ কওসর জামালের বইগুলি পড়ুন,






Thursday, February 4, 2021

শাসকের দম্ভ বড়ই পলকা

লিখেছেন অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত
[গতে বাঁধা বাঙালি পড়েছে এখন মহাবিপদে। সান্ধ্য অবসরে টেলিভিশনে চড়া ডেসিবেলের সিরিয়াল যারা ততটা উপভোগ করতে পারেন না, তেমন মধ্য ও বেশি বয়সের মানুষের খানিক চরে বেড়ানোর জায়গা ছিল খবরের দুনিয়া ও তথাকথিত তর্ক-বিতর্কের মজলিস। ইদানীং সে সবও আতান্তরে পড়ে হারাতে বসেছে। এখন টিভি খুললেই কে কবে দল বদল করলেন, বা করতে চলেছেন অথবা করেও করলেন না- রাতদিন সাতদিন এমন সব হরেকরকম্বায় ও অতি নাটকীয়তায় ভরপুর পুনঃপুনঃ একই বিষয় অবলোকনে দর্শককুল পড়েছেন মহাফাঁপরে। এ কী গেরো রে বাবা! গোদি মিডিয়ার এ কী হাল হল যে দৃশ্যান্তরে যেতেও তাদের অনীহা বা জড়তা! নাকি কোনও অদৃশ্য নির্দেশ?]

 

দলবদলের এই কুনাট্যে প্রথম দিকে বেশ টি-২০ ধাঁচের উত্তাপ ও উত্তেজনা ছিল। আমোদ-গেঁড়ে লোকজন বেশ মজাও পাচ্ছিল। কিন্তু কোথায় জানি কেমন একটা একঘেয়ে ও অতি-নাটকীয় চড়া আওয়াজ এতে লেগে গিয়ে তা এমন গা-সওয়া হয়ে গেল যে ধীরে ধীরে সে মজাটাও এখন উধাও। যেন, এমন দলবদল রোজই হবে, কিন্তু তাতে গড়পড়তা আমজনতার কী আসে যায়, সে উত্তর যেন বড্ড বেশি অধরা। আর যাচ্ছে কারা? যারা নাকি ‘কাজ করতে পারেনি’। কী বিপদ! এক বন্ধু বলল, জঙ্গলে বাঘও নাকি কাজ না পেয়ে আজকাল চিড়িয়াখানায় এসে ঢুকে পড়ছে।

 

কলকাতায় গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে অমিত শাহের পদযাত্রা থেকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর  সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ হাজারে হাজারে ‘আমি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র’এর আবির্ভাব হয়েছিল, যারা প্রত্যেকে হুবুহু একই বয়ানে বলতে শুরু করে তারা সেদিন প্রত্যক্ষত কী কী দর্শন করেছিল। প্রত্যকের এমন নিখুঁত অবলোকন ছিল যা প্রকাশেও এতটুকু দাড়ি-সেমিকোলনের তারতম্য পর্যন্ত রাখেনি- যেন আরএসএস শাখার কোনও শিবির যেখানে রোবটের মতো হাফ-খাকি পরে সকলে এমন দাঁড়িয়ে আছে যে কে জগা আর কে পঞ্চা সেটুকু বোঝবারও জো নেই। একইভাবে তারা এখন কৃষক আন্দোলনের গুষ্টির শ্রাদ্ধ করতে ছড়িয়ে দিচ্ছে হরেকরকম ‘আমি এক ছোট চাষি’র বাচন। শুধু কি তাই! বলা হচ্ছে, লাখে লাখে এত মানুষ যে দিল্লির সীমান্তগুলিতে বসে আছেন তাঁরা নাকি প্রকৃত কৃষক নন, সন্ত্রাসবাদী। এমনকি পররাষ্ট্র দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হচ্ছে যে খুব অল্প সংখ্যক কৃষকেরাই এইসব ঝামেলা পাকাচ্ছে। এরেই কয় আইটি সেলের কেদ্দারি যা অবশ্য এখন বোঝাই যাচ্ছে যে বেশ ল্যাজেগোবরে মাখামাখি।

 

তবে শুধু আইটি সেলকে দোষ দিই কেন! গোদি মিডিয়াও তো এই মহাযজ্ঞে সামিল। ‘নিউজ বাংলা’ নামক এক চ্যানেলে তো সঞ্চালক ধমক দিয়ে বক্তাকে বলে দিলেন যে আম্বানির চ্যানেলে বসে আম্বানির চুরি-জোচ্চুরি নিয়ে বলা যাবে না। অতএব, দু-একটি চ্যানেল বাদ দিলে (যেমন এনডিটিভ) কোথাও আপাতত কোনও খবর নেই। সবই মোদি বন্দনা এবং ঘাড় ধরে দেশভক্তির পাঠ শেখানো। এদের মধ্যে সব থেকে উগ্র চ্যানেলটি তো টিআরপি রেটিং’এ হেরাফেরি করে জনৈক পার্থ দাশগুপ্তকে জেলে পাঠিয়ে এখন নিজেরা জেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত।

 

তাই, বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে দেশ এখন ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্বানি-আদানির সাম্রাজ্যকে দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে সংসদের সমস্ত রীতিনীতিকে তুচ্ছ করে যে তিনটি কৃষি আইন পাশ করনো হয়েছে, তা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে এক মহা আলোড়ন তৈরি করেছে। পপ তারকা রিহানা থেকে পরিবেশ আন্দোলনের দৃপ্ত মুখ গ্রেটা থুনবার্গ সকলেই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, দিল্লির সীমান্তে যেখানে কৃষকেরা বসে আছেন সেখানে রাস্তায় লোহার গজাল পুঁতে, কংক্রিটের দেওয়াল তুলে, কাঁটাতারের প্রাচীর গড়ে মোদি সরকার কৃষকদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধে তার দরকার এমন এক প্রচারযন্ত্র যা কৃষকের মনকে বিভ্রান্ত করতে ও আপামর দেশবাসীর অন্তরে বিষবাষ্প ঢেলে এক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বাঁধাবার আবহ তৈরি করে রাখতে পারে। আর সে জন্যই তাদের দরকার আইটি সেলের পাশাপাশি গোদি মিডিয়াকেও যেখানে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যা দৃশ্য রচনা করে ও অভিসন্ধিমূলক বাচন রেখে এক গভীর অন্তর্ঘাত সংগঠিত করা যায়। এর জন্য তারা অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ভায়াকনের নামে বহু নিউজ চ্যানেলকে কিনে নিয়ে আম্বানি গোষ্ঠী একটি কনফেডারেশন তৈরি করে রেখেছে। এই সামগ্রিক প্রয়াসে গত কয়েক বছরে তারা কিছু সাফল্যও পেয়েছে যেখানে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুপরিকল্পিত ভাবে একটি দাঙ্গা লাগিয়ে দিতেও তারা সক্ষম হয়েছিল। তবে ইতিহাস তো অমন সোজা পথে স্বৈরাচারীদের হুকুম মেনে চলে না। তাই এতদসত্ত্বেও, তারাও এখন থড়হরিকম্পমান।

 

প্রথমত, এমন অভূতপূর্ব এক কৃষক আন্দোলন যা আম্বানি-আদানি কোম্পানির হাতে দেশকে তুলে দেওয়ার বিজেপি-আরএসএস’এর ফন্দিটিকে শুধু ধরে ফেলেছে তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তা ক্ষমতায় আসীন এই ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শক্তি আগে থেকে মোটেও আন্দাজ করতে পারেনি। নিজেদের ‘ইকো চেম্বার’এ বসে তারা ক্ষমতার আয়েসে এতটাই মশগুল ছিল যে মানুষের ক্ষোভ ও জেগে ওঠার প্রস্তুতিকে তারা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে গড়ে ওঠা পিপলস মিডিয়া, যা সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে মানুষের গভীরে এতটাই সুবিস্তৃত হয়ে পড়েছে যে তার অভিঘাতেরও বিন্দুমাত্র আভাস তারা পায়নি। তারা নিশ্চিত ছিল গোদি মিডিয়া ও আইটি সেলের ওপর নির্ভর করে জনগণের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার জারি রাখতে পারবে। আসলে, স্বৈরাচারীরা কখনই বুঝতে পারে না যে তাদের ক্ষমতার দৌড় একটা নির্দিষ্ট সীমার পরে আর কাজ করে না।

 

এই আবহেই গোদি মিডিয়ার দ্বারা সজ্জিত হয়ে মোদি-শাহ চক্র এখন খোয়াব দেখছে পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসীন হবে। এরজন্য শাসক দলের মধ্যে ভাঙন ঘটিয়ে, গোদি মিডিয়ায় লাগাতার ডঙ্কা বাজিয়ে ও আইটি সেলের ঘৃণাবর্ষণকারী বাচন ছড়িয়ে তারা উন্মাদের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। এই দৌড় সত্যি সত্যি কোথায় গিয়ে থামবে তা তারা নিজেরাও জানে না।

 

আজকের কৃষক আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার যা উত্তর ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়ে এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মুখে তার জাগরণের ব্যাপ্তি ও প্রকাশের ব্যঞ্জনার মধ্যেই আগামী ভারতের বীজ লুকিয়ে আছে। কোনও আইটি সেল বা গোদি মিডিয়া অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যারিকেড-গোলাগুলি এই উত্থানের শক্তি ও তাৎপর্যকে বিন্দুমাত্র অনুধাবন করার অবস্থায় নেই। তাই শাসক যত বকবে, যত পেশিশক্তি দেখাবে, যত মিথ্যা প্রচারে মাতবে ততই নিজেদের ধ্বংসের পথকে আরও ত্বরান্বিত করবে। আশার কথা, ভারতের সংবিধান গণতন্ত্রের এমন এক আধারকে সুনিশ্চিত করে রেখেছে যা আমাদের রক্ষাকবচ। আজকের দুর্বিনীত শাসক যদি সেই রক্ষকবচে গুলিগোলা চালায় তবে আমি নিশ্চিত সারা দেশ একযোগে উঠে দাঁড়াবে:উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।’      


[অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত । ]  

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বইগুলি পড়ুন, 

অর্ডার দিন বইঘরের অনলাইন স্টোর থেকে ক্লিক করুন এখানে