Saturday, February 6, 2021

আঁদ্রে ব্রতোঁ ও স্যুররেয়ালিস্ট আন্দোলন

লিখেছেন সৈয়দ কওসর জামাল

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ




[১৯১৫ সাল—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। উনিশ বছরের এক তরুণ, বাধ্যত তখন ফরাসি গোলন্দাজবাহিনীর সদস্য হলেও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কবি আপলিনের-কে পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা দুটি কবিতাসহ একটি চিঠি। তরুণটির পিতা প্যারিসের উপকণ্ঠে এক গ্লাসোয়ার্ক ফ্যাকটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র ডাক্তারি পড়ে পরিবারটিকে সম্মানজনক বুর্জোয়া প্রেণিতে স্থাপন করবে। কিন্তু মেডিসিনের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি তরুণ, আসলে কোনো বস্তুগত বিষয়ের দিকেই আগ্রহ ছিল না তাঁর, উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষকের কাছে মালার্মের কবিতা শোনার পর থেকে তাঁর উচ্চাশা জেগেছিল তিনিও কবি হবেন। ]


আপলিনের ফেরাননি তাঁকে—চিঠির উত্তরে জানিয়েছেন, ‘তোমার লাইনগুলোতে আমি এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভার পরিচয় পাচ্ছি’। বরিষ্ঠ কবির সঙ্গে তরুণ কবির এই যোগাযোগ এভাবেই শুরু হয়েছে। ‘আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পেরে আনন্দিত’, কখনও লিখেছেন, ‘তোমার মনে যেসব প্রশ্ন আসবে আমাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য, আমার চিঠিতে সে সবের উত্তর পাবে’, আর তরুণ কবিকে সম্বোধন করেছেন, Mon cher poète, ‘আমার প্রিয় কবি’ বলে। আপলিনের-এর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে উৎসাহিত এই তরুণ কবি,  আঁদ্রে ব্রতোঁ, দুটি সনেট লিখে পাঠিয়েছেন আর এক কবি-ব্যক্তিত্ব পল ভালেরিকে। বস্তুত এই সনেটদুটি—Décembre (ডিসেম্বর)  ও  A vous seule (শুধু তোমাকে)—মালার্মে-প্রভাবিত হলেও কবিতা রচনায় ব্রতোঁ-র একটা নির্দিষ্ট ঝোঁক লক্ষ করা গেছে। ভালেরি দ্বিতীয় কবিতাটিতে অন্তর্জগতের দ্বন্দ্বের উল্লেখ করেছেন। ব্রতোঁকে চিঠি লিখে ভালেরি জানান—

 

তোমার পাঠানো শেষ কবিতা পড়েছি। আমার মনে হয়েছে তুমি এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছো চিকিৎসকরা যাকে বলবেন সঙ্কটজনক। কবিতাদুটির ছন্দময় প্রবাহ, নির্দিষ্ট ধাঁচের মধ্যে মানিয়ে-যাওয়া নৈপুণ্য, আকস্মিকতার যে ইচ্ছাকৃত ও প্রতিমুহূর্তেই গুটিয়ে-নেওয়া ব্যবহার—এ সব থেকে বোঝা যায় যে তুমি বুদ্ধিবৃত্তির এক মিশ্রণ বা স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছেছ, যে অবস্থাটি সম্পর্কে আমি সম্যক জানি এবং যেখানে র‍্যাঁবো ও মালার্মের মতো চির-অমিল দুজন এক কবির মধ্যে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করছে।

 

স্পষ্টতই ভালেরি ব্রতোঁর কবিতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিও ব্রতোঁর কবিতায় মালার্মের সঙ্গে র‍্যাঁবোরও প্রভাব লক্ষ করেছেন। এই সময়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছে Mont de piété (১৯১৯) কাব্যগ্রন্থে। ব্রতোঁ কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ১৯১৪ সাল থেকে। ১৮৯৬ সালে জন্ম, তাই তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিল তাঁর মন। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছিল প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র ও সমুদ্রতীরের বর্ণনা। আসলে আঁদ্রের জন্ম নরম্যান্ডির পুরোনো ফরাসি শহরে হলেও তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল ফ্রান্সের অ্যাটলান্টিক উপকূলে ব্রিটানির বন্দরশহর লরিয়া-তে। এ সবই তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যে জীবন ব্রতোঁ কাটিয়েছিলেন তার সঙ্গে প্যারিসের দুস্তর ফারাক। তাঁর পিতার কথা আমরা বলেছি। মা সম্পর্কে ব্রতোঁ নিজেই লিখেছেন যে তিনি ছিলেন স্পষ্ট বক্তা, প্রাচীনপন্থী, এবং কোনো কিছু মনোমতো না হলে খুব রূঢ় হয়ে উঠতেন। বাবা-মার শাসন ও পুরোনো পন্থা হয়তো আঁদ্রে ব্রতোঁকে কোনো বাধা ও প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মানসিকতা তৈরি করেছিল। প্যারিসের স্কুলে আঁদ্রে পড়েছেন ১৯০৭ সাল থেকে, স্নাতক হয়েছেন ১৯১২তে এবং ১৯১৩তে সরবনে মেডিশিন পড়তে গেছেন। এই ডাক্তারি পড়ার প্রভাব ব্রতোঁর কবিতায় এসেছে নানা শব্দের ব্যবহারে।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোলন্দাজ বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে হলেও পরে তাঁকে নঁত-এ হাসপাতালের নিউরোলজিক্যাল সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ করার পর তাঁকে আবার পাঠানো হয়েছে স্যাঁ-দিজিয়ের-এর সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে চিকিৎসা সহকারি হিসেবে। প্রথমে নঁত ও পরে স্যাঁ-দিজিয়ের এই দুই জায়গায় কাজের ফলে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি দেখেছেন কী ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভোগে সৈন্যরা; এছাড়া তাদের চিকিৎসার জন্য যে সব পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, যেমন জঁ-মার্ত্যা শারকো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও পিয়ের জানে-র প্রায়োগিক চিকিৎসা-পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ব্রতোঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মানুষের মনের চিন্তাপদ্ধতি, গঠন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। মনের অবচেতনের অস্তিত্ব ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা  জেনেছেন ফ্রয়েডের কাছ থেকে। সব কিছুই ব্রতোঁর স্যুররেয়ালিস্ত কবিজীবনকে প্রভাবিত করেছে। স্বপ্ন ও অবচেতনকেই কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। তাঁর অটোমেটিক রচনার উৎস এই মনোবিজ্ঞানের পাঠ। বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ফিলিপ সুপো-র সঙ্গে মিলিতভাবে রচিত কাব্য Les Champs magnétiques (১৯২১) ও তাঁর একক কাব্য Poisson soluble-এ। উপন্যাস ‘নাদজা’তেও দেখি এক রহস্যময় নারীকে যিনি সাইকোসিসের রোগী। এ ছাড়া পল এলুয়ার-এর সঙ্গে মিলিতভাবে ব্রতোঁ লিখেছেন L’Immaculée Conception; এই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কথার ভিতর দিয়ে কাউকে উজ্জীবিত করা, যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অপ্রকৃতিস্থতার চিন্তাক্রম।

 

১৯১৭ সালে যুদ্ধের মধ্যেই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বন্ধু জাক ভাশের সঙ্গে আপলিনের-এর লেখা ‘স্যুররেয়ালিস্ত’ নাটক ‘Les Mamelles de Tirésias’(তিরেসিয়াসের স্তন) দেখে কৌতূহলী হন ব্রতোঁ এবং তাঁর ধারণা হয়েছিল যে এই নাটকের ভাবনা শিল্পকলার জগতে এক গভীর পরিবর্তন আনতে চলেছে। আপলিনের তাঁর চিন্তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে –‘মানুষ যখন হেঁটে যাওয়াকে অনুকরণ করতে চেয়েছে, তখন সে চাকা আবিষ্কার করেছে, যা দেখতে পায়ের মতো নয়। এটা না জেনেই সে স্যুররেয়ালিস্ত হয়েছে’।

 

চিরকালের ‘মূর্তিভঙ্গকারী’ ভাবধারা ও নতুনত্বের পক্ষে থেকেছেন আঁদ্রে ব্রতোঁ। নতুন ধ্যানধারণাকে গ্রহণ করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুই ছিল তাঁর। নতুনের অন্বেষণেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন দাদাবাদীদের। ১৯১৭ সালেই তিনি দাদাবাদীদের মুখপত্রের দুটি সংখ্যা পড়েছিলেন। তৃতীয় সংখ্যা ‘দাদা’ পড়েছেন আরো দুবছর পরে। ১৯১৯-এই  পড়েছেন ত্রিস্তাঁ জারার ‘দাদা মানিফেস্ত ১৯১৮’। ইস্তেহার অনুযায়ী ‘শৃঙ্খলা=বিশৃঙ্খলা; অহং=আত্মহীনতা; নিশ্চিতি=অনিশ্চিতি’। তাঁদের নীতি – ‘প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ বলা মানে ভণ্ডামি, ‘নিজেকে জানো’ বলাটা ইউটোপীয়, তবু এর মধ্যে মালিন্য থাকায় কিছুটা গ্রহণীয়। আমরা ভীত নই, কারণ আমরা আবেগপ্রবণ নই। আমরা ঝোড়ো বাতাসের মতো মেঘ ও প্রার্থনার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে দিই; আমরা প্রবল বিপর্যয়, বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড ও পচন-দৃশ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছি... প্রতিটি মানুষের চিৎকার করা দরকার; খুবই ধ্বংসকারী, নঙর্থক চেষ্টায় সামিল হতে হবে।‘ কিংবা ইস্তাহারের ঘোষণা—‘ মুক্তি : দাদা দাদা দাদা, কুঁকড়ে যাওয়া রঙের আর্তনাদ, বৈপরীত্য ও যত রকমের বিরোধ, বীভৎসতা ও অপরিণামদর্শিতা : জীবন’।  ইস্তেহারের এই ভাষা ব্রতোঁ ও তাঁর দুই কবিবন্ধু সুপোল ও আরাগঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চিন্তা ও মূল্যবোধের জগতে যে আঘাত করেছিল তার সেই হতাশা ও মরিয়া অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দাদাবাদকে তাঁরা দেখেছেন।  

         

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদাবাদীদের বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল নৈরাজ্য ও প্রলাপসর্বস্ব হট্টগোলের আশ্রয়। ফলে নঙর্থক এই আন্দোলন থেকে তাঁরা সরে এসে বিদ্রোহকে নতুন রূপ দিতে চেয়েছেন ‘স্যুররেয়ালিসম’ (Surréalisme) -এর আশ্রয়ে। এক দিক থেকে, দাদাবাদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্যুররেয়ালিসমের বীজ। দাদাবাদ যদি নাস্তির আশ্রয়, স্যুররেয়ালিসম তবে ছিল নাস্তির নাস্তি। এ এক নতুন স্বীকৃতি যা পরিলক্ষিত হয়েছে সদর্থক সৃষ্টিশীলতায় ও আদর্শবাদী ভাবনায়। ১৯২৪ সালের ‘দ স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে লেখা হয়েছিল—‘মানুষের অধিকারের নতুন ঘোষণা হওয়া দরকার’। ১৯২০ থেকে ১৯২৪—দাদাবাদ থেকে স্যুররেয়ালিসম—বিবর্তনের এই কালকে বলা হয়েছে নিদ্রার কাল, ‘লা পেরিওদ দে সোমেই’।

 


এই ‘নিদ্রাকাল’-এর মধ্যেই ১৯২২ সালে প্রকাশ পেয়েছে ব্রতোঁর পত্রিকা Littérature-এর একটি সংখ্যা, যেখানে  ২৪ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছিল প্রতীকবাদীদের মধ্যে তখনও সক্রিয়—ভালেরি, আঁদ্রে জিদ ও লেয়ঁ-পল ফার্গ-এর কবিতা ও গদ্য। ছিল ব্রতোঁ-র ‘ক্লে দ সল’ ও আরাগঁ-র একটি ছোটো কবিতা। এই সংখ্যাতেই ব্রতোঁ জানিয়েছেন কীভাবে তাঁর Les Champs magnetiques কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর সঙ্গে মিশে ছিল স্বপ্ন এবং ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছিল কবিবন্ধুদের মধ্যে। এখানেই ব্রতোঁ ‘স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এইভাবে—

 

শব্দটি আমরা আবিষ্কার করিনি, কিন্তু নির্দিষ্ট অর্থে প্রয়োগ করেছি। আমরা সহমত হয়েছি এর মধ্য দিয়ে বোঝাব ‘সাইকিক অটোম্যাটিজম’ যা কমবেশি স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তবে এই স্বপ্নাবস্থার সীমা বেঁধে দেওয়া এখন খুবই কঠিন।

স্যুররেয়ালিসম তখনও আন্দোলনের রূপ পায়নি, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে ভেবেছেন ব্রতোঁ। তাঁর মনে হয়েছে ‘কবিতা হল আমাদের জীবনের সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান’। যে কবিতার প্রশংসা তিনি করেছেন, ভেবে দেখলেন, ‘তা এসেছে মানুষের জীবনের ভিতর থেকে’। মানুষের জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে হয়েছে ‘এ এক পথ যেখানে মেনে নেওয়া যায় না এমন মানবিক অবস্থাকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে’। তাঁর মতে, ‘শব্দ ও ভাষা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এবং মানুষের মনই যোগ্যতম বিপ্লবের স্থান’। অর্থাৎ, কবিতা কোনো পৃষ্ঠার ওপর শব্দ নয়, তা একটা মাধ্যম যা দিয়ে স্বপ্ন পূর্ণ করা এক পৃথিবীতে প্রবেশ করা যায়।

 

ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলন, যাকে বলা হয়েছিল ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’, স্পষ্টতা পেয়েছে ১৯২৪ সালে ‘মানিফেস্ত্ দ্যু স্যুররেয়ালিসম’ বা স্যুররেয়ালিস্ত ইস্তাহার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। এই ইস্তেহার রচনা করেছেন ব্রতোঁ। এবার তিনি স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দিলেন এইভাবে—

 

স্যুররেয়ালিসম, বিশেষ্য, পুংলিঙ্গ। বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা (automatisme psychique pur), যার          সাহায্যে মৌখিক বা লিখিতভাবে চিন্তার প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। এ হল নন্দনতাত্ত্বিক বা নৈতিক   বিষয়ের বাইরে, যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় চিন্তার কর্তৃত্ব (dictée de la pensée)।

 

দার্শনিক অর্থ : স্যুররেয়ালিসম বিশ্বাস করে নানা ধরনের অনুষঙ্গে প্রকাশিত, যা এতকাল অবহেলিত, এক উচ্চ বাস্তবে (réalité supérieure), স্বপ্নের সার্বভৌমত্বে এবং চিন্তার নিস্পৃহতায়। এর উদ্দেশ্য অন্য সমস্ত মানসিক কলকব্জাগুলোর চিরতরে বিনাশ (ruiner définitivement tous les autres          mécanismes  psychiques) এবং জীবনের প্রধান সমস্যাজাত সিদ্ধান্তের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন।

 

 অবচেতনকে তিনি করলেন কাব্যের উৎস—অবচেতনেই কাব্যের মুক্তি। ইস্তাহারে ব্রতোঁ বললেন—‘আমি বিশ্বাস করি যে আপাতবিরোধী দুই মানবিক অবস্থা অর্থাৎ স্বপ্ন ও বাস্তব অপসৃত হয়ে তাদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হবে এক নতুন বাস্তব, এক  surréalité’। এই অবস্থাকেই কি জঁ আর্ত্যুর র‍্যাঁবো বলেছিলেন dérelegment de tous les sens, সমস্ত চেতনার বিপর্যয়?  এভাবেই ব্রতোঁ চাইলেন ‘মানসিক স্বয়ংক্রিয়তার জগতে’ প্রবেশ করতে। তার জন্য উদ্ভাবন করতে হবে স্বয়ংক্রিয় রচনাপদ্ধতি। স্যুররেয়ালিস্তদের ‘বিপ্লবী’ রচনা প্রকাশের জন্য সম্পাদিত হল নতুন পত্রিকা ‘লা স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’। সবাই প্রাথমিকভাবে বিনা প্রশ্নে ব্রতোঁকে মেনে নিয়েছেন স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলনের নেতা হিসেবে। ব্রতোঁর জন্যই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ফিলিপ সুপো, ল্যুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, বেঞ্জামিন পেরে, রবের দেসনস প্রমুখ কবিরা।

         

১৯২৪ সাল থেকে আঁদ্রে ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্তদের নতুন নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ শুরু হয়েছে। কবিকল্পনা ছিল তাঁদের মনে আর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন ছিল তাঁদের চোখে। স্যুররেয়ালিসম যে কোনো ্দার্শনিক প্রস্তাবনা নয়, শিল্প-সাহিত্যের এক নিরীক্ষা মাত্র, তা স্পষ্ট করে দিয়ে ব্রতোঁ বলেছেন, ‘ কবিতা চর্চা করতে হবে’। এই চর্চার অর্থ এমন ছিল না যে সবাই একসুরে কথা বলবেন। প্রত্যেক কবিরই নিজস্ব ও পুর্বলব্ধ ধারণা ছিল, এ কথা ব্রতোঁও স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

১) আমাদের কোন প্রতিভা নেই; উৎপাদনের স্বয়ংক্রিয় দ্রব্য এবং নিম্ন আয়ের বসবাস  লম্বা শহরগুলোকে ধ্বংস করবে (ফিলিপ সুপো)

২) আমি যে গল্প বলছি তা বহুবার বলা, একটি কবিতা যা আমি পুনর্বার পড়ছি : আমার তরুণ কান ও  পুড়ে খাস্তা হয়ে যাওয়া ঠোঁট নিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ছি দেওয়ালের দিকে। (পল এলুয়ার)

৩) পার্টি শেষ হলে খেলোয়াড়রা যখন পানপাত্রের সামনে জড়ো হয় তখন আমি গাছটিকে জিজ্ঞেস করি সে কি সবসময় লাল রিবন পরে থাকে? ( লুই আরাগঁ)

 

আর ব্রতোঁ কবিতায় লিখেছেন—

 

          ১)পাথরের টুপিগুলো স্ফটিক হয়েছে

          তারা হিম আটকাচ্ছে সজোরে আঘাত করা শিরোস্ত্রাণ দিয়ে

          তারপর বিদ্যুতের দারুণ ঝিলিক

          ধ্বংসের পতাকায় আঘাত করে

          বালি এখন অনুজ্জ্বল এক ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়...

 

          ২)খাপছাড়া কিছু প্রাণী পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে

          তারা আমার কল্পনাইয় পৌঁছোনোর দিকনির্দেশ চায়

          যেটা নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীজুড়ে

          তবে দুপক্ষই ঘুরছে উলটোদিকে

         

স্যুররেয়ালিস্তদের এই সৃজনশীলতা সক্রিয় থেকেছে ১৯৩০ সালে স্যুরলিয়ালিসম-এর দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত। পরের পর্যায়ের রচনাগুলোকে ব্রতোঁ বলেছেন স্যুররেয়ালিসম-এর যুক্তির পর্ব। ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’-কে সংহত করতে চেয়েছেন ব্রতোঁ। এই সময় স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যায়। একটি হল—কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ। আর দ্বিতীয়টি হল—স্যুররেয়ালিসমকে পশ্চিম ইউরোপ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁরা যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছিলেন সে কৃতিত্ব অবশ্যই আঁদ্রে ব্রতোঁর প্রাপ্য।

 

ব্রতোঁর নিজের সাহিত্যকৃতিতে তাঁর কবিতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর অন্যান্য রচনার তুলনায় কবিতা পরিমাণের দিক থেকে বেশ কম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ Mont de piété (১৯১৯) থেকে শেষ প্রধান কাব্যগ্রন্থ Ode à Charles Fourier (১৯৪৭) পর্যন্ত ব্রতোঁর কবিতায় সংগতি ও সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর চিত্রকল্প, যেখানে কল্পনাশক্তির সঙ্গে মেশে মানুষের মূল প্রবণতা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো, কখনও আবার দুর্বোধ্য অযৌক্তিকতার উদ্ভট রূপ গ্রহণ করে। চিত্রকল্পের মধ্যে আছে এমন তুলনা যা পরস্পরবিরোধী এবং এক উপমা থেকে হঠাৎ-ই অন্য উপমায় চলে যাওয়া আছে। তবে সব উপমাই স্বতঃস্ফূর্ত, ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা বলে মনে হয় না। অটোমেটিক রচনার এটাই বৈশিষ্ট্য যে তার মধ্যে থাকে চিন্তার বাস্তব প্রক্রিয়া; যে চিন্তার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে যৌনতা, অবচেতনের আকাঙ্ক্ষা ও চেতন মনের প্রকাশ। স্যুররেয়ালিস্তরা চেয়েছিলেন অবচেতনের জগতে প্রবেশ করে বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করতে। কারণ, ব্রতোঁ বলেছেন, ‘বিস্ময় সবসময় সুন্দর’।

 

ব্রতোঁর কবিতার চিত্রকল্প স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে তাঁর লেখনশৈলীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য। একটি বৈশিষ্ট্য হল বাক্যগঠনের পরিচিত ছকটিকে ভেঙে ফেলা, যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ কূটাভাস থেকে ভাষাগত বৈপরীত্য, অন্বয়গত অস্পষ্টতা, ও প্রসঙ্গের জটিলতা। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যভাষা, যা কাব্যিক ইমেজে-এর নাটকীয় প্রকাশে সহায়তা করে। এই ভাষার সামর্থ্যের জায়গা হল ব্রতোঁর সীমাহীন শব্দভাণ্ডার। এই শব্দভাণ্ডারে আছে শারীরবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষঙ্গ, কিন্তু সমস্যা হল সেসব অনুষঙ্গ প্রায়শই কবিতার পাঠকের কাছে পরিচিত নয়। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত হল একই বিষয়ের পুনঃপুন ব্যবহার ও প্রতীকধর্মী ‘মোটিফ’, যেমন রিভলভার হল যে কোনো ধরনের বিদ্রোহ বা বিপ্লবের আলঙ্কারিক ইমেজ।

 

ব্রতোঁর কবিতায় তিনটি মূল ধারণা প্রকাশ পেয়েছে—এক, কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতা; দুই, জাগতিক পৃথিবীর ইউটোপীয় রাজ্যে রূপান্তর; এবং তিন, ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানবিক সামর্থ্যের অনুসন্ধান। তাঁর কবিতায় এই স্যুররেয়ালিস্ত দৃষ্টিভঙ্গিই ধরা পড়ে। মানবিক কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতায় ব্রতোঁর বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল আধুনিক মনোবিশ্লেষণমূলক চিন্তা, বিশেষ করে অচেতনের ক্রিয়াকলাপে ফ্রয়েডের চিন্তা। ব্রতোঁর কাছে অচেতন বলতে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ স্থান বা শক্তি বোঝায় না, বরং তা হল জাগতিক বাস্তবতার জগৎ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ যা নিয়ে যায় পরাবাস্তবতার জগতে। আর পরাবাস্তবতার এই জগতে মানুষের যুক্তি ও কল্পনা পরস্পরের বিরুদ্ধে পড়াই করে না, বরং একসঙ্গে মিলে কাজ করে—এটাই হল মোক্ষম বাস্তবতা, আমাদের প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য এই বাস্তবতার চিহ্নগুলোর ক্রমাগত সন্ধান, এবং সেই অভিজ্ঞতা লাভ করার অর্থই হল জীবন বদলে যাওয়া।  সব মানুষের পক্ষেই এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য আছে, এমন বিশ্বাস  ব্রতোঁ করলেও শিল্পীদের পক্ষে তা অবশ্যই যোগ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করেছেন। শিল্পীর কাজ হল তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এই ‘আশ্চর্য’ (le merveilleux) –এর চিহ্নগুলোকে উপস্থাপিত করা। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্যুররেয়ালিস্তরা নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে দুটি পদ্ধতির কথা ব্রতোঁর কাজের মধ্যে আমরা পাই—এক) বিশ্বের hazard objectif  বা বস্তুগত ভাগ্যের কাছে মানুষের আত্মসমর্পণ এবং দুই) অটোমেটিক লেখার মধ্যে দিয়ে অবচেতনের প্রাথমিক প্রক্রিয়াকে গ্রহণ। প্রথম পদ্ধতির উদাহরণ আমরা পেয়েছি ব্রতোঁর Clair de terre (পৃথিবীর আলোয়) কাব্যগ্রন্থের Au regard des divinités (দেবতাদের চোখে) কবিতা—

মধ্যরাতের একটু আগে সিঁড়ির কাছে

অবিন্যস্ত চেহারার কোনো নারী যদি তোমাকে অনুসরণ করে তাকিয়ো না তার দিকে।

এ হল নীল। নীলের থেকে তোমার ভয়ের কিছু নেই।

গাছের ওপরে থাকবে এক লম্বা সোনালি চুলের পাত্র।

গলিত রঙের গ্রামের কুণ্ডলীর একটি পাক

তোমার দিকচিহ্ন হবে। সহজভাবে নেবে,

মনে রেখো। অন্ধকার উষ্ণ প্রস্রবণ যা ছুড়ে দেয় ফার্নপাতা

আকাশের দিকে, স্বাগত জানায়

তোমাকে স্বাগত।

একগুচ্ছ নির্দেশনা কবির এবং hazard objectif পদ্ধতি, হঠাৎ-পাওয়া বাস্তবতার মধ্য দিয়ে থেকে উঠে আসছে এক ‘আশ্চর্যময়তা’ (le merveilleux)। ‘আশ্চর্য’কে আহ্বান করার আর এক পদ্ধতি অবচেতনার ভিতরে চিন্তার লাগামহীন অনুষঙ্গ, যা স্বয়ংক্রিয় লেখনিতে ধরা পড়ে—

১৯৩৪-এর মনোরম আধো-আলোর মধ্যে

বাতাস ছিল সাড়ম্বর গোলাপ ছিল লাল ফুলের মতো রং

এবং বন যখন আমি প্রবেশ করতে প্রস্তুত

শুরু করেছে এক বৃক্ষ দিয়ে, পর্ণ যার সিগারেটের পাতা

তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি...

 

La Clé des Champs গ্রন্থের ভূমিকায় ব্রতোঁ ব্যবহার করেছেন Le Merveilleux contre le Mystère, অর্থাৎ ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে রহস্যের বিরোধিতা আছে; রহস্য বাস্তব নয়, মানুষের অজ্ঞতাজনিত কল্পনা। ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে আছে বিস্মিত হওয়ার উপাদান। বাস্তবতার পরিচয় আবিষ্কারের পর মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। সুতরাং আশ্চর্যের অন্বেষণ রহস্যময় নয়, বরং মিস্টিসিজম-এর উপাদান আছে, যা কবির সঙ্গে সংপৃক্ত, দার্শনিকের সঙ্গে নয়। দার্শনিক বের্গসন এক মনের সংজ্ঞা দিতে চেয়েছিলেন যা যুক্তির নিয়ম মানে না; তিনি তাকে বলেছিলেন স্বজ্ঞা বা ইনটুইশন; আর ব্রতোঁ কবিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকে বলেছেন কল্পনা।          

 

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ

তবে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে শুধুমাত্র সৃষ্টিশীল কল্পনার সামর্থ্য দিয়ে পরিবর্তনের কথা ভাবেননি ব্রতোঁ, রাষ্ট্র ও সমাজকে সমাজতন্ত্রের চিন্তা দিয়ে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায়। ১৯৩০ সাল থেকে ব্রতোঁর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ এবং এই সংযোগ ফরাসি স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। এতদিন যাঁরা স্যুররেয়ালিসম-এর নন্দনতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভাবনায় আস্থা রেখেছেন তাঁরা বিশ্বাস করতে চাননি যে জীবন সম্পর্কে ধারণা রাষ্ট্র ও সমাজের বস্তুজগৎকে বদলে দিতে পারে। স্যুররেয়ালিস্তদের রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার এই  বিরোধিতাকে ব্রতোঁ দেখলেন স্যুররেয়ালিসম-এর প্রতি তাঁদের অপর্যাপ্ত আনুগত্যের ইঙ্গিত হিসেবে। অপরদিকে, যাঁরা বিরোধিতা করলেন তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকারী চরিত্র, তার শ্বাসরোধকারী নিয়মানুবর্তিতা এবং শিল্পকর্মের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করলেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রতোঁ তাঁর বিশ্বাস থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে চাননি। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ Ode to Charles Fourier তাঁর এই বিশ্বাসের পরিচয় বহন করছে। এই কবিতাগুলোতে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। 

ব্রতোঁর আর একটি বিশ্বাসের জায়গা ছিল প্রেমের পরিবর্তনকারী ভূমিকায়। কল্পনাশক্তির মতো প্রেমের ক্ষমতার প্রতি এই বিশ্বাস অন্য স্যুররেয়ালিস্ত কবিদেরও ছিল। ব্রতোঁর ধারণা, রোম্যান্টিক প্রেমের মধ্য দিয়েই মানুষ পার্থিব পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে পরাবাস্তবতার সীমাহীন অনন্ত জগতের দৃঢ় মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। তাঁর অনেক কবিতাতেই এই অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। ধারণাটি তাঁর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মূলত দুটি আকারে। প্রথমটি হল নারীকে গ্রিক পুরাণের দেবী ‘মিয়ুজ’ হিসেবে দেখা—প্রিয় নারী পরাবাস্তবের সঙ্গে সংযোগের সূত্র হয়ে ওঠেন, যেমন ব্রতোঁর বহুপঠিত দুটি কবিতা—Catalogue poème Free Union—প্রেমিকা ও কলূষমুক্ত প্রকৃতির জগতের মধ্যে জাদুকরি সম্পর্কের উদযাপন। Free Union দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে

আমার স্ত্রীর আছে কাঠের আগুনের চুল

তার আছে বিদ্যুৎ উত্তাপের মতো ভাবনা

আওয়ারগ্লাসের কটি

তার কটি বাঘের দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা ভোঁদড়ের

গোলাপ আকৃতি মুখ তার আর একগুচ্ছ নক্ষত্র ...

                                                           

আর Fata Morgana-তে দেখা যায় নতুন প্রেমের আবিষ্কারে কবির আনন্দপূর্ণ উদ্দীপন। দ্বিতীয় রীতি হল প্রেমের জাদুকরি শক্তির প্রতি এই বিশ্বাস যে কাব্যসৃষ্টির সঙ্গে যৌনপ্রেমকে সমদৃষ্টিতে দেখা, যেমন Sur la route de San Romano (সান রোমানোর রাস্তায়)—

কবিতা সৃষ্ট হয় বিছানায় প্রেমের মতন

তার এলোমেলো চাদরেরা হল নতুনের ভোর

 

আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি যে ব্রতোঁর প্রেমের কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর প্রভাব। তাঁর এই ধরনের কবিতায় ‘ইরোটিক’ বিষয়ও তাঁর কাব্যিকতার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। তাঁর কবিতায় শরীরী বর্ণনাতে মিশে আছে কাব্যিক ফ্যান্টাসির উপাদান। এক অবাস্তব রূপকথার পরিবেশ জড়িয়ে থাকে এই প্রেমের কবিতাগুলোতে। স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে আসে শরীরী উপাদান—

স্বপ্নে দেখি তুমি নিজেকে নিজের ওপর স্থাপন করে রেখেছ অনির্দিষ্টকাল

নিজেকে বসিয়ে রেখেছ প্রবাল-আসনে

তোমার আয়নার সামনে তুমি

চিরুনির জলের অংশে আছে তোমার দু’আঙুল

...

আমার আদর যাকিছু শুধুই তুমি

তোমার সবকিছু, এখনো যা হয়ে ওঠেনি

                                                        (Poèmes, ১৯৪৮ থেকে)

 

 ব্রতোঁর কবিতার আলোচিত তিনটি চিন্তাস্তর প্রভাবিত করেছে স্যুররেয়ালিস্ত কবি ও লেখকদের। তিনি নিজেও পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্বস্ত থেকেছেন নিজের ভাবনায়। ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও যে ধারণা তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন চিন্তায়, ইস্তাহারে, ও নিজের কবিতায়, তা এখনও সক্রিয় থেকে বিশ্বকবিতাকে আচ্ছন্ন ও  প্রভাবিত করে রেখেছে। 


[ লেখকের কর্পোরেট বায়োডাটা হয় না । লেখকের পরিচয় জন্মসাল-মৃত্যুদিনের উৎসব পালনে নেই । লেখক বেঁচে থাকেন স্রেফ লেখায় । সৈয়দ কওসর জামাল, একজন দাপুটে বাঙালি কবিপ্রাবন্ধিকঅনুবাদক ও সম্প্রচারক। আছে ১০ টি প্রকাশিত কবিতার বই এবং কবিতা সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধের সংকলন । শত শত সাহিত্য প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

পেয়েছেন, ১৯৯৫ সালে আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার । সোপন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে, কবিতা গ্রন্থ 'চেরনোবিলার মেঘএর জন্য ।]


সৈয়দ কওসর জামালের বইগুলি পড়ুন,






Thursday, February 4, 2021

শাসকের দম্ভ বড়ই পলকা

লিখেছেন অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত
[গতে বাঁধা বাঙালি পড়েছে এখন মহাবিপদে। সান্ধ্য অবসরে টেলিভিশনে চড়া ডেসিবেলের সিরিয়াল যারা ততটা উপভোগ করতে পারেন না, তেমন মধ্য ও বেশি বয়সের মানুষের খানিক চরে বেড়ানোর জায়গা ছিল খবরের দুনিয়া ও তথাকথিত তর্ক-বিতর্কের মজলিস। ইদানীং সে সবও আতান্তরে পড়ে হারাতে বসেছে। এখন টিভি খুললেই কে কবে দল বদল করলেন, বা করতে চলেছেন অথবা করেও করলেন না- রাতদিন সাতদিন এমন সব হরেকরকম্বায় ও অতি নাটকীয়তায় ভরপুর পুনঃপুনঃ একই বিষয় অবলোকনে দর্শককুল পড়েছেন মহাফাঁপরে। এ কী গেরো রে বাবা! গোদি মিডিয়ার এ কী হাল হল যে দৃশ্যান্তরে যেতেও তাদের অনীহা বা জড়তা! নাকি কোনও অদৃশ্য নির্দেশ?]

 

দলবদলের এই কুনাট্যে প্রথম দিকে বেশ টি-২০ ধাঁচের উত্তাপ ও উত্তেজনা ছিল। আমোদ-গেঁড়ে লোকজন বেশ মজাও পাচ্ছিল। কিন্তু কোথায় জানি কেমন একটা একঘেয়ে ও অতি-নাটকীয় চড়া আওয়াজ এতে লেগে গিয়ে তা এমন গা-সওয়া হয়ে গেল যে ধীরে ধীরে সে মজাটাও এখন উধাও। যেন, এমন দলবদল রোজই হবে, কিন্তু তাতে গড়পড়তা আমজনতার কী আসে যায়, সে উত্তর যেন বড্ড বেশি অধরা। আর যাচ্ছে কারা? যারা নাকি ‘কাজ করতে পারেনি’। কী বিপদ! এক বন্ধু বলল, জঙ্গলে বাঘও নাকি কাজ না পেয়ে আজকাল চিড়িয়াখানায় এসে ঢুকে পড়ছে।

 

কলকাতায় গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে অমিত শাহের পদযাত্রা থেকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর  সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ হাজারে হাজারে ‘আমি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র’এর আবির্ভাব হয়েছিল, যারা প্রত্যেকে হুবুহু একই বয়ানে বলতে শুরু করে তারা সেদিন প্রত্যক্ষত কী কী দর্শন করেছিল। প্রত্যকের এমন নিখুঁত অবলোকন ছিল যা প্রকাশেও এতটুকু দাড়ি-সেমিকোলনের তারতম্য পর্যন্ত রাখেনি- যেন আরএসএস শাখার কোনও শিবির যেখানে রোবটের মতো হাফ-খাকি পরে সকলে এমন দাঁড়িয়ে আছে যে কে জগা আর কে পঞ্চা সেটুকু বোঝবারও জো নেই। একইভাবে তারা এখন কৃষক আন্দোলনের গুষ্টির শ্রাদ্ধ করতে ছড়িয়ে দিচ্ছে হরেকরকম ‘আমি এক ছোট চাষি’র বাচন। শুধু কি তাই! বলা হচ্ছে, লাখে লাখে এত মানুষ যে দিল্লির সীমান্তগুলিতে বসে আছেন তাঁরা নাকি প্রকৃত কৃষক নন, সন্ত্রাসবাদী। এমনকি পররাষ্ট্র দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হচ্ছে যে খুব অল্প সংখ্যক কৃষকেরাই এইসব ঝামেলা পাকাচ্ছে। এরেই কয় আইটি সেলের কেদ্দারি যা অবশ্য এখন বোঝাই যাচ্ছে যে বেশ ল্যাজেগোবরে মাখামাখি।

 

তবে শুধু আইটি সেলকে দোষ দিই কেন! গোদি মিডিয়াও তো এই মহাযজ্ঞে সামিল। ‘নিউজ বাংলা’ নামক এক চ্যানেলে তো সঞ্চালক ধমক দিয়ে বক্তাকে বলে দিলেন যে আম্বানির চ্যানেলে বসে আম্বানির চুরি-জোচ্চুরি নিয়ে বলা যাবে না। অতএব, দু-একটি চ্যানেল বাদ দিলে (যেমন এনডিটিভ) কোথাও আপাতত কোনও খবর নেই। সবই মোদি বন্দনা এবং ঘাড় ধরে দেশভক্তির পাঠ শেখানো। এদের মধ্যে সব থেকে উগ্র চ্যানেলটি তো টিআরপি রেটিং’এ হেরাফেরি করে জনৈক পার্থ দাশগুপ্তকে জেলে পাঠিয়ে এখন নিজেরা জেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত।

 

তাই, বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে দেশ এখন ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্বানি-আদানির সাম্রাজ্যকে দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে সংসদের সমস্ত রীতিনীতিকে তুচ্ছ করে যে তিনটি কৃষি আইন পাশ করনো হয়েছে, তা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে এক মহা আলোড়ন তৈরি করেছে। পপ তারকা রিহানা থেকে পরিবেশ আন্দোলনের দৃপ্ত মুখ গ্রেটা থুনবার্গ সকলেই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, দিল্লির সীমান্তে যেখানে কৃষকেরা বসে আছেন সেখানে রাস্তায় লোহার গজাল পুঁতে, কংক্রিটের দেওয়াল তুলে, কাঁটাতারের প্রাচীর গড়ে মোদি সরকার কৃষকদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধে তার দরকার এমন এক প্রচারযন্ত্র যা কৃষকের মনকে বিভ্রান্ত করতে ও আপামর দেশবাসীর অন্তরে বিষবাষ্প ঢেলে এক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বাঁধাবার আবহ তৈরি করে রাখতে পারে। আর সে জন্যই তাদের দরকার আইটি সেলের পাশাপাশি গোদি মিডিয়াকেও যেখানে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যা দৃশ্য রচনা করে ও অভিসন্ধিমূলক বাচন রেখে এক গভীর অন্তর্ঘাত সংগঠিত করা যায়। এর জন্য তারা অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ভায়াকনের নামে বহু নিউজ চ্যানেলকে কিনে নিয়ে আম্বানি গোষ্ঠী একটি কনফেডারেশন তৈরি করে রেখেছে। এই সামগ্রিক প্রয়াসে গত কয়েক বছরে তারা কিছু সাফল্যও পেয়েছে যেখানে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুপরিকল্পিত ভাবে একটি দাঙ্গা লাগিয়ে দিতেও তারা সক্ষম হয়েছিল। তবে ইতিহাস তো অমন সোজা পথে স্বৈরাচারীদের হুকুম মেনে চলে না। তাই এতদসত্ত্বেও, তারাও এখন থড়হরিকম্পমান।

 

প্রথমত, এমন অভূতপূর্ব এক কৃষক আন্দোলন যা আম্বানি-আদানি কোম্পানির হাতে দেশকে তুলে দেওয়ার বিজেপি-আরএসএস’এর ফন্দিটিকে শুধু ধরে ফেলেছে তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তা ক্ষমতায় আসীন এই ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শক্তি আগে থেকে মোটেও আন্দাজ করতে পারেনি। নিজেদের ‘ইকো চেম্বার’এ বসে তারা ক্ষমতার আয়েসে এতটাই মশগুল ছিল যে মানুষের ক্ষোভ ও জেগে ওঠার প্রস্তুতিকে তারা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে গড়ে ওঠা পিপলস মিডিয়া, যা সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে মানুষের গভীরে এতটাই সুবিস্তৃত হয়ে পড়েছে যে তার অভিঘাতেরও বিন্দুমাত্র আভাস তারা পায়নি। তারা নিশ্চিত ছিল গোদি মিডিয়া ও আইটি সেলের ওপর নির্ভর করে জনগণের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার জারি রাখতে পারবে। আসলে, স্বৈরাচারীরা কখনই বুঝতে পারে না যে তাদের ক্ষমতার দৌড় একটা নির্দিষ্ট সীমার পরে আর কাজ করে না।

 

এই আবহেই গোদি মিডিয়ার দ্বারা সজ্জিত হয়ে মোদি-শাহ চক্র এখন খোয়াব দেখছে পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসীন হবে। এরজন্য শাসক দলের মধ্যে ভাঙন ঘটিয়ে, গোদি মিডিয়ায় লাগাতার ডঙ্কা বাজিয়ে ও আইটি সেলের ঘৃণাবর্ষণকারী বাচন ছড়িয়ে তারা উন্মাদের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। এই দৌড় সত্যি সত্যি কোথায় গিয়ে থামবে তা তারা নিজেরাও জানে না।

 

আজকের কৃষক আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার যা উত্তর ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়ে এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মুখে তার জাগরণের ব্যাপ্তি ও প্রকাশের ব্যঞ্জনার মধ্যেই আগামী ভারতের বীজ লুকিয়ে আছে। কোনও আইটি সেল বা গোদি মিডিয়া অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যারিকেড-গোলাগুলি এই উত্থানের শক্তি ও তাৎপর্যকে বিন্দুমাত্র অনুধাবন করার অবস্থায় নেই। তাই শাসক যত বকবে, যত পেশিশক্তি দেখাবে, যত মিথ্যা প্রচারে মাতবে ততই নিজেদের ধ্বংসের পথকে আরও ত্বরান্বিত করবে। আশার কথা, ভারতের সংবিধান গণতন্ত্রের এমন এক আধারকে সুনিশ্চিত করে রেখেছে যা আমাদের রক্ষাকবচ। আজকের দুর্বিনীত শাসক যদি সেই রক্ষকবচে গুলিগোলা চালায় তবে আমি নিশ্চিত সারা দেশ একযোগে উঠে দাঁড়াবে:উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।’      


[অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত । ]  

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বইগুলি পড়ুন, 

অর্ডার দিন বইঘরের অনলাইন স্টোর থেকে ক্লিক করুন এখানে








Tuesday, January 26, 2021

প্রজাতন্ত্রের নামে প্রহসন আর কত দিন?

 লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী



Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay



আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানীর বুকে যে ঘটনা ঘটল, তাকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বলা যেতেই পারে। প্রজার কথা শাসক শুনবেন, প্রজার মঙ্গলে শাসক কাজ করবেন এটাই দস্তুর হওয়া উচিত। আজ ভারতবর্ষ যা প্রত্যক্ষ করলো তার কিন্তু সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে ভারতের রাজনীতিতে। গণ আন্দোলনকে যদি প্রসারিত না হতে দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে রাষ্ট্র তবে তার কি ফল হয় আমরা তা দেখলাম। ১৯৫৬ সালে যে প্রজাতন্ত্র সংবিধানের শপথ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তা পথভ্রষ্ট।এর কারণ নিহিত আছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের অন্তরসম্পর্কে।রাজনৈতিক দল কি রাষ্ট্রের পরিপূরক হতে পারে? প্রশ্নটা আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে এসেছিল এরিস্টটলের মাথায়। তাঁর মনে হয়েছিল ক্ষমতাসীন দল সংবিধানের পরিবর্তন ঘটালে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য।প্রকারান্তে এটাই রাষ্ট্র ও দলের অভিজ্ঞতা।আসলে সমকালীন গ্রিসের প্রায় প্রত্যেকটি নগর রাষ্ট্রে ধনিক ও গণতন্ত্রীদের মধ্যেকার তীব্র বিরোধ এরিস্টটল দেখেছিলেন, এবং এও দেখেছিলেন যে গণতন্ত্রীরা ক্ষমতায় এলে তা পাল্টে যায়। সংবিধানের পরিবর্তন সরাসরি প্রভাবিত করে নগর রাষ্ট্রের চরিত্রকে।বর্তমানে অবশ্য আমাদের দেশে সংবিধানের পরিবর্তন না ঘটিয়েও রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে ফেলা যায়।তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দল সমার্থক কিনা, এই প্রশ্ন বর্তমান সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক। আজকে ধারে-ভারে বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধানকে সামনে রেখে, শিরোধার্য করে, আইনের পাকাপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ যে ভাবে নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাতে স্পষ্টতই সন্দেহ জাগে ভারত রাষ্ট্রে সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা আছে তো? ক্ষমতাসীনের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভারত রাষ্ট্রের আদর্শ, পরিচলন পদ্ধতি স্থিরীকৃত হয় বা পাল্টে যায়, তা সে সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে যতই সংঘাতপূর্ণ হোক না কেন। তা যদি না হত তবে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যাথা থাকত না, তা যদি না হত তবে চলতি কথায় গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি তার একেবারে প্রাথমিক শর্ত হিসাবে পৃথক মতের প্রতি সহনশীলতার যে ধারণা রয়েছে, তা নিয়ে গেল গেল রব উঠতো না। বড়ো বড়ো বুলি আওড়ানো সংবিধান, রাষ্ট্রপ্রকৃতির নির্দেশক ও রাষ্ট্রের পরিচালনার মৌলিক নীতি সম্বলিত সংবিধান পড়ে থাকলো এক কোনে, একেবারেই গুরুত্বহীন অবস্থায়।সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজনৈতিক দল ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। একদিকে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঢাক পেটাচ্ছি অন্যদিকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সমস্ত দুর্বলতা আমাদের দেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের বিষয়টা তো প্রাত্যহিক চর্চার বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চিন্তায় ও আচরণে সে চর্চা নেই।বৌদ্ধিক ভাবে ও চেতনায় গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার কোনও বাসনা নেই তাঁদের, সে কারণেই বিরুদ্ধমতকে তাঁরা শ্রদ্ধা দেখাতে পারেন না। ভুল করেও পারেন না। রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে প্রতিহিংসাপরায়ণতা চরিতার্থ করা, বিরুদ্ধ স্বর হলেই সর্বাত্মক ভাবে তা দমনের মানসিকতা নিশ্চয়ই ভারতের সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ আমাদের চারপাশে নিয়মিত ভাবে সেটাই হয়ে চলেছে। স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর না হলেও চলবে এই অসঙ্গতি গুলি দেখতে পাওয়ার জন্য।
 

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay
পার্টি পলিসি, পার্টি পলিটিক্সই সত্য। তাই রাজনৈতিক দলগুলি এরকমটাই ভেবে অভ্যস্ত যে একবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারলেই শাসন, আইন সবই তার।যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা তার।সে-ই শাসন, সে-ই আইন, সে-ই বিচার। পুলিশ প্রশাসন তখন বোবা, কালা ও অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করে - সাংবিধানিকতা কোমায়(যেমন, উত্তরপ্রদেশের হাতরাস কান্ডে)। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যার জায়গা এটাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হলেই গণতান্ত্রিক উপায় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব(যেমন,৩৭০ধারা লোপ)। যেখানে আর্থিকনীতি, শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি এমনকি বিচার বিভাগ - সবখানেই ক্ষমতাসীনের অহং ও আত্মকেন্দ্রিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। যার মাধ্যমে পোশাক পরিচ্ছদ থেকে খাদ্যাভ্যাস, চিন্তার স্বাধীনতা থেকে মত প্রকাশ (নতুন সংযোজন, লাভ জিহাদ) - সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।অধ্যাপক,সাংবাদিক,লেখক, সরকারি কর্মচারী - সবাইকে সবক শেখানো সম্ভব। তা ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক!সংখ্যা গরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত বলে কথা। আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা ক্রমশই হারাতে হারাতে ভারতীয় জনগণ এতেই খুশি যে সবটাই হচ্ছে আমাদের নামে।ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকা অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির নেশা বড্ড মারাত্মক।এর সঙ্গে আছে নামের মোহ। আমি এবং আমিত্ব, সবটা বজায় রাখার জন্য এখনকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অধিকাংশই পোস্ট ট্রুথ সিনড্রোম-এ আক্রান্ত। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাই অসত্য, অর্ধসত্য এবং মিথ্যা, মনগড়া তথ্য হাতে হাতে ঘুরছে।এতে এক ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই যাঁদের কাজ, হটাৎ হটাৎ শোনা যায় তাঁরা রাজধর্ম পালন করছেন। নীতির সাথে প্রতিনিয়ত রাজ করা সম্ভব হলে দুম করে রাজধর্ম পালনের কৃতিত্ব দাবি করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তা সম্ভব নয় কারণ, রাজনৈতিক দলগুলির সব গিলে খাওয়ার হাঙ্গরের হাঁ রয়েছে।বিরোধী শূন্য ফাঁকা মাঠ চাই তাঁদের।ভোটের আগে প্রচার করতে না দেওয়া থেকে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ফতোয়া জারি কিংবা ভিটে মাটি ছাড়া করা - এর সবটুকু সংবিধান বিরুদ্ধ হলেও আমাদের দেশের দলতন্ত্র অনুযায়ী তা বৈধ। বৈধ বলেই একজন মানুষ এরকম সময়ে রাষ্ট্রের সাহায্য পান না।এই দলতন্ত্র অনুযায়ী বিরুদ্ধ মতের মানুষদের জন্য বিভিন্ন কমিটি, কমিশন বা এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়াও বৈধ।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এখানে মুখ্য। এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, উদারনৈতিক গণতন্ত্র তাত্বিক ভাবে নিজের বৃত্তের বাইরে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ দলতন্ত্র ক্ষমতার স্বার্থে যে কোনও 'বাদ'কে, যে কোনও 'বাদী'কে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে, প্রয়োজন ফুরোলে রাষ্ট্রের যুক্তি দিয়ে তাকে জেলেও পুরতে পারে(কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি)। তাই, দিনের শেষে রাজনৈতিক দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের সমার্থক। যে ব্যবস্থায় তদন্ত কমিশন থেকে নির্বাচন কমিশন কিংবা মানবাধিকার কমিশন - সবই সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দলের হরবোলা হিসেবে কাজ করে অভ্যস্থ সেখানে আলাদা কিছু প্রত্যাশা করা যায় কি?আমাদের বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা অর্জনকে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের নিরিখে দেখা হয়।বৈধতার প্রশ্ন এখানে উপেক্ষিত। বৈধতা হল কর্তৃত্বকে মান্যতা দেওয়া। এই বৈধতা সংবিধান ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উচিত-অনুচিত বোধের প্রেক্ষিতে স্বীকৃতি পায়। তা না হলে সাংবিধানিকতা প্রতিষ্টিত হয় না এবং 'জোর যার মুলুক তার' নীতিতে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র উঁকি দেয়।আজকের ভারত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেই যে বৈধতার দাবি করা যায় না - এই বোধ এবং শিক্ষা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের নেই, তাঁরা সেটা শিখতেও আগ্রহী নন। সরকারি পদক্ষেপ সঠিক কি না, ন্যায়সঙ্গত কি না এবং তার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার প্রতিটি মানুষের থাকা দরকার(কৃষি বিল নিয়ে কৃষকদের বিক্ষোভ)। তত্ত্বগতভাবে এটাই যে কোনও সরকারের সঠিক নীতি গ্রহণে সাহায্য করে। কিন্তু বাস্তবতা হল ক্যাডারের সংখ্যার আধিক্য এবং আসনগত ভাবে সংখ্যাগরিষ্টতা - এই দুই হল রাজনৈতিক দলের মোক্ষ। তাই কৃষক আন্দোলনকে এখন ঘুর পথে বাগে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসবের ফলে দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই দল। এটা কিন্তু প্রজাতন্ত্র নয়, সেটা আমরা আর কবে বুঝবো।

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay


[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]


Thursday, January 21, 2021

রোজা লুক্সেমবার্গ: মানবতার মুখ

  লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী



[নবিংশ ও বিংশ শতকের একটি ছোট পরিসরে ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রোজা লুক্সেমবার্গ, তাঁর ধ্যানধারণার জন্য। তারপর দীর্ঘকাল তাঁর চিন্তাধারা মার্কসবাদের অঙ্গনে ব্রাত্য থাকার পর সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রোজা। আজকের পৃথিবীতে রোজা-র নব মূল্যায়নের একটি দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের মধ্যে গণতন্ত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রোজা তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন, আর সেই সঙ্গে ছিল তাঁর মানবতাবাদের আদর্শ। জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন কঠোর সমালোচক। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ আজ যখন বিশ্বের নানান দেশে তার দাঁত, নখ বের করে আমাদের প্রতিদিন আতঙ্কিত করে চলেছে, তখন রোজার চিন্তা ও বক্তব্য নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।


থচ তদানীন্তন মার্ক্সবাদ তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে একটা বিপথগামিতা লক্ষ্য করেছিল এবং প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে না হলেও স্বধর্মত্যাগীদের তাঁর সহাবস্থানকে মোটেই সুনজরে দেখেনি। বলশেভিকদের বিরূপ সমালোচনা ও মেনশেভিকদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর সাযুজ্যই রোজা-কে মার্কসীয় মতাদর্শের ধ্বজাধারীদের চক্ষুশূল করেছিল। আন্তর্জাতিক কমিউনিজম-এর ক্ষেত্রে রোজা তাঁর কালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলেন। জাতিতে ইহুদি পোল, তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল জার্মানি। জার্মান শ্রমিকশ্রেণীর একজন তাত্ত্বিক নেত্রী এবং প্রতিবাদী চিন্তক হিসাবেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (১৮৮৯-১৯১৪) সময়কালে তাঁর নাম জনসমক্ষে উঠে আসে।প্রথমত এসপিডি-তে (জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দল) থাকাকালীনই এডওয়ার্ড বেয়ার্নস্টাইন ও কার্ল কাউটস্কির সঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক বিরোধ বাধে। ১৯০৩-এ বলশেভিক ও মেনশেভিক দু'টি দল আলাদা হয়ে গেলে তিনি দু'টি দলকে এক হওয়ার সুপরামর্শ দেন। এর পর ১৯০৪-এ শ্রমিক শ্রেণির পার্টিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রশ্নে লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতাদর্শগত বিরোধ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসপিডি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি ইউএসপিডি (স্বাধীন এসপিডি) দল গড়ে তোলেন। পরে ১৯১৮ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কেপিডি(জার্মানির কমিউনিস্ট দল) বা স্পার্টাকাস দল গড়ে তোলার পর এসপিডি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারে চুকে যায়। সমাজতন্ত্রের প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করে রোজা লেনিনের সঙ্গে যে বিতর্কে নেমেছিলেন, তাতে লেনিনের রায় ছিল, রোজা ভুল পথ নিয়েছেন।১৯১৯-এর জার্মানিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গ্রেপ্তারের ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বার্লিন ছেড়ে পালাতে চাননি। এ বাড়ি ও বাড়ি করে থাকছিলেন। শেষে ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণপন্থী ফ্রাইকর্পস-এর গার্ড ক্যাভালরির সিকিউরিটি ডিভিশন রোজা এবং কার্ল লিবক্লেখট -কে একসঙ্গে ধরে ফেলে। দুজনকেই হত্যা করে খালের জলে ফেলে দেয় তারা। এইভাবে রোজা অকালে মৃত্যুবরণ করেন। লেনিন ১৯২৪-এ রোজার ভুলগুলি উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন পোল্যান্ডের স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা ভ্রান্ত। ১৯০৩-এ মেনশেভিকদের প্রশংসা করেও তিনি ভুল করেছেন। পুঁজির সঞ্চয় সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা ঠিক নয়, মেনশেভিক ও বলশেভিকদের মিলনের কথা বলেও তিনি ঠিক করেননি। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি রোজাকে প্রশংসা করতেও পিছপা হননি, রোজার অকুতোভয় মনোভাব ও যুক্তির প্রতি অগাধ আস্থার জন্য। লেনিনের পর স্টালিন এলে তিনিও রোজাকে ট্রটস্কির সমমনস্ক স্থির করে তাঁকে বর্জন করেন। লুক্সেমবুর্গিজম নাম দিয়ে রোজাকে তখনও ব্রাত্য করে রাখা হয়। পূর্ব জার্মানিতে একমাত্র সত্তরের দশকে রোজার রচনাসম্ভার প্রকাশের একটা প্রয়াস চালানো হয়। বলা বাহুল্য, পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভেঙে যাওয়ার পর, সোভিয়েট রাশিয়ায় ধস নেমে এলে রোজা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাঁকে নিয়ে একাডেমিক চর্চাতেও একটা জোয়ার আসে। এই কাজে সত্তরের দশক থেকেই যিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তিনি জাপানের নরিহিতো ইটো। তাঁরই উদ্যোগে জুরিখ-এ ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, 'ইন্টারন্যাশনাল রোজা লুক্সেমবার্গ সোসাইটি'। ইটো সত্তরের দশক থেকেই ভাবছিলেন স্টালিনীয় সমাজতন্ত্রের বোধ থেকে আলাদা করে তিনি মার্কসীয় তত্ত্বের বিকল্প একটি স্বাতন্ত্র্য কীভাবে শনাক্ত করবেন।এই থেকেই রোজার প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগে।রোজাকে নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণ উদ্যমে কাজকর্ম আরম্ভ করে দেওয়ার পর ১৯৮৫-তে গর্বাচেভ -এর সময়কাল থেকে রোজা ক্রমশ আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকেন। তার প্রধান কারন, এই সময় সকলের নজরে পড়ে যে, পুঁজিবাদের সংকট এবং সমাজতন্ত্রের অর্জিত বিষয় খোদ প্রাতিষ্ঠানিক মার্কবাদের অবস্থান থেকেই ক্রমশ প্রশ্নাত্বক হয়ে উঠছে এবং প্রকাশ্যেই তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এই সময় থেকেই বামপন্থীরা বুঝতে শুরু করেন, এতদিন ধরে যে-সমস্ত ধরতাই লম্বা লম্বা বুলি মার্কসবাদকে ঘিরে রেখেছিল, তা সবই শূন্যগর্ভ। যদিও তার মধ্যে অনেক বক্তব্যই ছিল মার্কসবাদের বিকৃতি, যা মার্ক্স কখনও বলেননি, পরবর্তী কালের নেতাদের কল্পনা প্রসূত। সে যাই হোক, এই সময় থেকেই  বামপন্থার একটা পুনর্নির্মানের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকেন রোজা।  রাশিয়ার বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা, বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁর যুক্তি, আত্মমুখিনতা ও গণ-ধর্মঘটের উপর তাঁর বিশেষ ঝোঁক, নিরঙ্কুশ কেন্দ্রবদ্ধতা এবং দলীয় আমলাতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর বিরূপতা সময়ের কষ্ঠিপাথরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মানুষ অন্যায় ও অসাম্যের বর্বরতার বিরুদ্ধে রোজার অনপনেয় দৃঢ়তা উপলব্ধি করে। সাবেক রাশিয়ার পতন উত্তর পৃথিবীতে মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং রোজার ধারণা সময়োচিত হয়ে ওঠে। আজকের বামপন্থীরাও ভাবছেন রোজা কী কারণে সমাজতন্ত্রের পরিধিতে গণতন্ত্রের ভাবনাকে সসম্মানে স্থান দিয়েছেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি কতখানি বৈপ্লবিক ও মানবতাবাদী। সংসদীয় গণতন্ত্র ও ভোটের পাটিগণিতের পরিধির বাইরে যে বৃহৎ বামপন্থার জগৎ সেখানে আজ রোজা ভীষণ প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে রোজার রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরম্পরা। সমাজতন্ত্রের বিকল্প ছবিটিতে সেখানে একটি মানবতাবাদী কল্যাণকামী মুখও এসে যায়। রোজা এমন সব যোগসূত্র রেখে গেছেন, যার ফলে আমরা আজ বুঝতে পারি দলীয় আমলাতন্ত্রিকতা আসলে কী এবং কীভাবে তা জনগণের উদ্যোগ এবং উদ্যমকে নষ্ট করে। এর ফলে দল থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রোজা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন যে জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হয়ে বা তাদের মঙ্গলের অংশীদার না হয়ে শ্রমিকদলের প্রতিষ্ঠান যদি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলে তা সমাজতন্ত্রের অন্তঃশক্তিকেই অবহেলা করছে। রোজার তত্ত্বের একটা বড় গুণ এই যে, সেই তত্ত্বের মাধ্যমে যেমন রোজার সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তা তৈরি হয় তেমনই রোজার একটি আত্মপ্রকৃতি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সত্যের প্রতি অদম্য আবেগ ও দায়বদ্ধতা তাঁকে বিচারবিরুদ্ধবাদ থেকে দূরে রেখেছিল। কোনও কর্তৃত্বকারী শক্তির কাছে তিনি কখনও মাথা নোয়াননি। মার্ক্স-এর যোগ্য ছাত্রী ছিলেন রোজা, যার জন্য কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার শক্তি পেয়েছিলেন। মার্কসের শিক্ষার যে নির্যাস , তার সঙ্গে যুক্ত থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোজা সবসময় স্বাধীন চিন্তা ও কঠিন সমালোচনাকে প্রয়োগ করেছেন। 

আবার একই ভাবে মার্কসের মানবতাবাদকেও টেনে এনেছেন তিনি, কারণ মার্কসের কাছে সমাজতন্ত্র যথার্থই মানবতাবাদী, মার্কস বলছেন যে, এখানে আমরা এমন একটা সমাজ পাই 'in which the full and free development of every individual is the ruling principle'(Capital,Vol 1)। রোজার জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে একদিকে যেমন তাঁর হৃদয় ও মেধা জুড়ে সমাজতন্ত্র বিষয়টি একটি স্থায়ী আবেগের বিষয়, তেমনই অন্ত্যজ ও নির্যাতিতদের জন্য তাঁর বুকভরা সহমর্মিতা। তাই তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে এই ধরণের মানুষের প্রতি অপার ভালবাসা কাজ করে। মানুষের হাসিতে, কান্নায় তাঁর চিত্ত ব্যথিত হলেও তিনি কিন্তু সমাজজীবনের সমৃদ্ধির প্রবণতার উপরেই আলোকপাত করেন, শ্রমিকশ্রেণীকে বলেন তাদের অনুদ্ভুত অথচ সম্ভনাময় বৃত্তিশক্তিকে কাজে লাগাতে।বলেন আবেগতাড়িত না হয়ে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করতে।এর ফলে স্টালিন, মাও, পোলপট প্রভৃতির মানবতাবিরোধী কমিউনিজমে বীতশ্রদ্ধ বামপন্থীদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন রোজা।তাঁদের মনে এক অপার বিস্ময় তৈরি করেন তিনি, যিনি মার্কসীয় চিন্তাধারার মধ্যে আকন্ঠ ডুবে থেকেও সমাজতন্ত্রের ধারাকে গণতন্ত্র ও মানবতাবোধের সঙ্গে একই সুতোয় গেঁথেছিলেন।ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে রোজার প্রাসঙ্গিকতা মৌল মানবতাবাদী চিন্তার ভগীরথ মানবেন্দ্রনাথ রায়(প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)-এর কাজের প্রেক্ষিতে।এম এন রায় একটা সময়ে স্ট্যালিনের হাতে মার্ক্সবাদের দুর্দশা দেখে প্রতিবাদ করেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত হন।১৯৪০-স্থাপন করেন রোজার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যার মূলমন্ত্র ছিল যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ। তিনি মনে করেছিলেন বুদ্ধির মুক্তির সপক্ষে ও সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গেলে, তা চালাতে হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে। তিনি যে ভুল ভাবেননি, আজ অনেক পথ ঘুরে আমরা তা টের পাচ্ছি। প্রচলিত বামপন্থার উল্টো পথে একটা দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী, সেই রাস্তার পথিকৃৎ অবশ্যই এম এন রায়ের মানবতাবাদী বামপন্থা।এম এন রায়ের মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর দলে যোগ দিয়েছিলেন আর এক বিদগ্ধ মানবাতিবাদী শিবনারায়ণ রায়, বর্তমান বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। এই দুই রায় ও রায়পন্থীদের মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ কেন্দ্রিক পথ আজকের নয়া দক্ষিণপন্থীদের উদগ্র অনাচারে অসুস্থ ভারতবর্ষকে সুস্থতার পথ দেখাতে পারে।



বিঃদ্রঃ - ছবিগুলি ইন্টারনেটের দৌলতে প্রাপ্ত । ছবির উৎসকে বিববক্ষিতর তরফে কৃতজ্ঞতা । 

[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । এটি ওয়েবজিনে তাঁর প্রথম লেখা । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]