লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী
![]() |
সত্যজিৎ রায় |
বাঙালির একটা মুশকিল
হল, কাউকে যদি সে একবার মাথায় বসায়, তবে তাকে নিয়ে আর কোনও কথা বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথকে
যখন বিবেকানন্দ 'বাঙালি জাতিকে রসের সাগরে ভাসিয়ে সর্বনাশ করলেন' বলে অভিযোগ তোলেন
তখন বাঙালি দাঁড়িয়ে পরে বিবেকানন্দের বিপরীতে। কবি ব্যঙ্গ করে লিখে ফেলেন 'চিরকুমার
সভা'। আবার যখন বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন যে 'আমার বৈপ্লবিক ভাইকে
এরা সাধু বানিয়ে ছেড়ে দিল', তখন সেই বাঙালিই আবার রে-রে করে ওঠে ভূপেনের 'কমিউনিস্ট'
মতলবের বিপক্ষে। তাই বাঙালির কাছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ,
বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে সত্যজিৎ পর্যন্ত এক লম্বা সারিতে প্রায় একডজন
মনীষী রয়েছেন, যাঁদের বাঙালি কার্যত কাচের আলমারিতে বন্দি করে রেখেছে। তাঁদের দিকে
ঢিল ছোঁড়া মানা, কোনও কাটা ছেঁড়া
করা একরকম 'অপরাধ'।
ফলত, এঁদের নিয়ে
যেটা হয় সেটা চর্বিত চর্বন, মহান থেকে সুমহান করার অতিপ্রয়াস। অথচ বিদেশে ব্যাপারটা
একদম আলাদা। সেখানে দ্য ভিঞ্চি, শেক্সপিয়র, গ্যঠে, বিটোভেন কেউ-ই সমালোচনার উর্ধ্বে
নন। তাই সেখানে এঁদের নিয়ে একবারে অন্য রকমের নানা কাজ হয়েছে বা হচ্ছে। একটা গোটা ডিকশনারি
তৈরি হয়েছে শেক্সপিয়রের নাটকে ব্যবহৃত ইতর শব্দাবলী নিয়ে। এমন একটি কাজ এই বাংলার মনীষীদের
নিয়ে করতে গেলে, লেখককে পাঠিয়ে দেওয়া হবে হয় পাগলাগারদে আর তা না হলে হাজতবাস নিশ্চিত।
এই যে আমি সত্যজিৎ নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে, এত শব্দ খরচ করলাম সেটা ওই রক্ষণশীলদের জন্য,
অনেকটা সেই বঙ্কিমকে যেমন করতে হত, স্বামী এসে স্ত্রীর কপালে ঠোঁট ছোঁওয়াবেন, তার আগে
দু'পাতা ধরে পাঁয়তাড়া!
আসলে, সংস্কৃত আর
সংস্কৃতি একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হলেও দুটো নিকট সম্পর্কিত নয়। কৃষির সঙ্গে কৃষ্টির
তথা সংস্কৃতির নিকট সম্পর্ক। যে ফসল ফলেনি তাকে ফলানোই কৃষকের কর্ম। সে-জন্য সে মাঠে
কাজ করে। কালটিভেট করে। আর
যা ফলে রয়েছে তাকে সিদ্ধ করে, শুদ্ধ করে পরিবেশন করা হচ্ছে পাচকের কর্ম। সে রিফাইন
করে। সবাই যদি রিফাইন করে তবে কালটিভেট করবে কে?
সত্যজিৎ প্রসঙ্গেই
এই কথাগুলো বলা। চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, প্রচারবিদ, বাগ্মী, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই
সমান দক্ষ লেখক সত্যজিতের প্রধান পরিচয় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা। 'পথের
পাঁচালি' ছবিতে সত্যজিৎ যেটা করেছিলেন তা ছিল
সংস্কৃতি জগতে একটি সম্পূর্ণ নতুন উৎপাদন। 'পথের পাঁচালি' ছিল এক নতুন ফলানো ফসল। তাঁর
পরবর্তী ছবিগুলির মুক্তি ভারতীয় সংস্কৃতির সরণির এক একটি মাইলফলক, বিশ্বের মানচিত্রেও
সেগুলো সগর্ব অধ্যায়। কিন্তু সেই ছবিগুলোতে কোথাও কি রয়ে গেল তাঁর প্রথম ছবির রিফাইনমেন্ট
প্রক্রিয়া? প্রথম ছবির যে স্বাক্ষর তা কি সারা জীবন তাড়া করে ফিরল না তাঁকে? এ ব্যাপারে
কোনও সংশয় নেই যে তাঁর সাধনা নিষ্ঠাবান, যাত্রা তাঁর নিঃসঙ্গ, শিল্পরুচি সৃষ্টিতে অতিক্রম
করেছেন নিজেকেই, দৃষ্টি ছিল সম্মুখবর্তী। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এমন একটা ছবিও হল
না যা দেখলে মনে হয়, এ ছবি সত্যজিতের হতেই পারে না? অনেকে 'সীমাবদ্ধ' ছবির নায়কের মত
জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সেটা ভালো না খারাপ? সে বিচার অবশ্যই দর্শকের। চিত্রনাট্য, সংলাপ,
রূপসজ্জা থেকে শুরু করে সম্পাদনা, বিজ্ঞাপন, প্রচারে সত্যজিৎ অনন্য। কিন্তু গোদার বা
গুনে বা অন্তনিওনির যে বৈচিত্র্যময় দুনিয়া, সেই বৈচিত্র্য সত্যজিতের আছে কি?
এ ব্যাপারে কুরুসওয়ার
সঙ্গে সত্যজিতের মিল রয়েছে, দুজনেই সিগনেচার ফিল্মমেকার। যাঁদের ছবির প্রথম শটেই চিনে
নেওয়া তাঁদের। যিনি 'দেবী' তুলেছেন তিনিই তুলেছেন 'শতরঞ্জ কি খিলারি'। 'দেবী'র ছবি
বিশ্বাস আর 'শতরঞ্জ কি খিলারি'র আমজাদ খাঁ-কে পাশাপাশি রাখলে যেন মনে হয় তাঁদের দ্যোতনা
একদম এক। তফাৎ শুধু প্রেক্ষিত, আর সময়ের। 'গুপি গাইন, বাঘা বাইন'-এ গুপি গাধার পিঠে
চেপে যখন গ্রাম ছাড়ছে, তখন গুপি'র বাবার চোখের জল মোছা যেন ফিরে এলো 'শাখা-প্রশাখা'র
আনন্দ মজুমদার-এর চোখের জল হয়ে। যাঁরা বহুবার করে সত্যজিৎ দেখেছেন তাঁদের কি কখনও মনে
হয়নি, যে তিনি একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা পড়ে গেছেন। এতে হয়ত তাঁর ছবির উচ্চতা এতটুকু
কমেনি, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা?
আজও বাঙালির প্রাণের মানুষ তিনি, ভদ্রলোক বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনিই আমাদের ছবি দেখতে শিখিয়েছেন, তাঁর অমূল্য সব প্রবন্ধের মাধ্যমে। তাই মনে হয়, এটা নেহাত কাকতলীয় নয় যে তিনি শুরু করলেন 'অপু ট্রিলজি' দিয়ে আর শেষ করলেন, 'গণশত্রু', 'শাখা প্ৰশাখা' আর 'আগন্তুক' - ট্রিলজি দিয়ে। হয়ত তিনিই চেয়েছেন এই ঘেরাটোপে থাকতে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আর একটা সম্ভবনার কথা মনে হয়। আমরা এতবার করে ছবিগুলো দেখেছি, শট, এঙ্গেল, ডায়লগ সব মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই কি মনে হয় সব একই রকম। আলাদা গল্প, প্রেক্ষাপট, কাস্ট সত্ত্বেও। ছবির বাজনা শুনলেই কান বলে দেয় এটা সত্যজিৎ। আশা করি, আগামী দিনে এই নিয়ে আরও আলোচনা হবে।২০২১- সত্যজিতের শতবর্ষ। এই একটি সান্ত্বনাই আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারে সব আতঙ্ক, অস্থিরতা। আবার হয়ত শুরু হবে নিভৃতবাস, অচল হয়ে যাবে পৃথিবী, খানিক শুশ্রূষার আবহ নিয়ে আসুক তাঁর লেখা বই, ছবি, ফিল্ম, সংগীত। সত্যজিতের কাজ হয়ে উঠুক সর্বার্থে থেরাপিউটিক।