Friday, April 23, 2021

সত্যজিৎ রায় : প্রয়াণ দিবসে ফিরে দেখা

  লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী

সত্যজিৎ রায়

বাঙালির একটা মুশকিল হল, কাউকে যদি সে একবার মাথায় বসায়, তবে তাকে নিয়ে আর কোনও কথা বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথকে যখন বিবেকানন্দ 'বাঙালি জাতিকে রসের সাগরে ভাসিয়ে সর্বনাশ করলেন' বলে অভিযোগ তোলেন তখন বাঙালি দাঁড়িয়ে পরে বিবেকানন্দের বিপরীতে। কবি ব্যঙ্গ করে লিখে ফেলেন 'চিরকুমার সভা'। আবার যখন বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন যে 'আমার বৈপ্লবিক ভাইকে এরা সাধু বানিয়ে ছেড়ে দিল', তখন সেই বাঙালিই আবার রে-রে করে ওঠে ভূপেনের 'কমিউনিস্ট' মতলবের বিপক্ষে। তাই বাঙালির কাছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে সত্যজিৎ পর্যন্ত এক লম্বা সারিতে প্রায় একডজন মনীষী রয়েছেন, যাঁদের বাঙালি কার্যত কাচের আলমারিতে বন্দি করে রেখেছে। তাঁদের দিকে ঢিল ছোঁড়া মানা,  কোনও কাটা ছেঁড়া করা একরকম 'অপরাধ'। 

ফলত, এঁদের নিয়ে যেটা হয় সেটা চর্বিত চর্বন, মহান থেকে সুমহান করার অতিপ্রয়াস। অথচ বিদেশে ব্যাপারটা একদম আলাদা। সেখানে দ্য ভিঞ্চি, শেক্সপিয়র, গ্যঠে, বিটোভেন কেউ-ই সমালোচনার উর্ধ্বে নন। তাই সেখানে এঁদের নিয়ে একবারে অন্য রকমের নানা কাজ হয়েছে বা হচ্ছে। একটা গোটা ডিকশনারি তৈরি হয়েছে শেক্সপিয়রের নাটকে ব্যবহৃত ইতর শব্দাবলী নিয়ে। এমন একটি কাজ এই বাংলার মনীষীদের নিয়ে করতে গেলে, লেখককে পাঠিয়ে দেওয়া হবে হয় পাগলাগারদে আর তা না হলে হাজতবাস নিশ্চিত। এই যে আমি সত্যজিৎ নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে, এত শব্দ খরচ করলাম সেটা ওই রক্ষণশীলদের জন্য, অনেকটা সেই বঙ্কিমকে যেমন করতে হত, স্বামী এসে স্ত্রীর কপালে ঠোঁট ছোঁওয়াবেন, তার আগে দু'পাতা ধরে পাঁয়তাড়া!  

আসলে, সংস্কৃত আর সংস্কৃতি একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হলেও দুটো নিকট সম্পর্কিত নয়। কৃষির সঙ্গে কৃষ্টির তথা সংস্কৃতির নিকট সম্পর্ক। যে ফসল ফলেনি তাকে ফলানোই কৃষকের কর্ম। সে-জন্য সে মাঠে কাজ করে।  কালটিভেট করে। আর যা ফলে রয়েছে তাকে সিদ্ধ করে, শুদ্ধ করে পরিবেশন করা হচ্ছে পাচকের কর্ম। সে রিফাইন করে। সবাই যদি রিফাইন করে তবে কালটিভেট করবে কে? 

সত্যজিৎ প্রসঙ্গেই এই কথাগুলো বলা। চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, প্রচারবিদ, বাগ্মী, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমান দক্ষ লেখক সত্যজিতের প্রধান পরিচয় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা। 'পথের পাঁচালি' ছবিতে সত্যজিৎ যেটা করেছিলেন তা  ছিল সংস্কৃতি জগতে একটি সম্পূর্ণ নতুন উৎপাদন। 'পথের পাঁচালি' ছিল এক নতুন ফলানো ফসল। তাঁর পরবর্তী ছবিগুলির মুক্তি ভারতীয় সংস্কৃতির সরণির এক একটি মাইলফলক, বিশ্বের মানচিত্রেও সেগুলো সগর্ব অধ্যায়। কিন্তু সেই ছবিগুলোতে কোথাও কি রয়ে গেল তাঁর প্রথম ছবির রিফাইনমেন্ট প্রক্রিয়া? প্রথম ছবির যে স্বাক্ষর তা কি সারা জীবন তাড়া করে ফিরল না তাঁকে? এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে তাঁর সাধনা নিষ্ঠাবান, যাত্রা তাঁর নিঃসঙ্গ, শিল্পরুচি সৃষ্টিতে অতিক্রম করেছেন নিজেকেই, দৃষ্টি ছিল সম্মুখবর্তী। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এমন একটা ছবিও হল না যা দেখলে মনে হয়, এ ছবি সত্যজিতের হতেই পারে না? অনেকে 'সীমাবদ্ধ' ছবির নায়কের মত জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সেটা ভালো না খারাপ? সে বিচার অবশ্যই দর্শকের। চিত্রনাট্য, সংলাপ, রূপসজ্জা থেকে শুরু করে সম্পাদনা, বিজ্ঞাপন, প্রচারে সত্যজিৎ অনন্য। কিন্তু গোদার বা গুনে বা অন্তনিওনির যে বৈচিত্র্যময় দুনিয়া, সেই বৈচিত্র্য সত্যজিতের আছে কি? 

এ ব্যাপারে কুরুসওয়ার সঙ্গে সত্যজিতের মিল রয়েছে, দুজনেই সিগনেচার ফিল্মমেকার। যাঁদের ছবির প্রথম শটেই চিনে নেওয়া তাঁদের। যিনি 'দেবী' তুলেছেন তিনিই তুলেছেন 'শতরঞ্জ কি খিলারি'। 'দেবী'র ছবি বিশ্বাস আর 'শতরঞ্জ কি খিলারি'র আমজাদ খাঁ-কে পাশাপাশি রাখলে যেন মনে হয় তাঁদের দ্যোতনা একদম এক। তফাৎ শুধু প্রেক্ষিত, আর সময়ের। 'গুপি গাইন, বাঘা বাইন'-এ গুপি গাধার পিঠে চেপে যখন গ্রাম ছাড়ছে, তখন গুপি'র বাবার চোখের জল মোছা যেন ফিরে এলো 'শাখা-প্রশাখা'র আনন্দ মজুমদার-এর চোখের জল হয়ে। যাঁরা বহুবার করে সত্যজিৎ দেখেছেন তাঁদের কি কখনও মনে হয়নি, যে তিনি একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা পড়ে গেছেন। এতে হয়ত তাঁর ছবির উচ্চতা এতটুকু কমেনি, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা? 

আজও বাঙালির প্রাণের মানুষ তিনি, ভদ্রলোক বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনিই আমাদের ছবি দেখতে শিখিয়েছেন, তাঁর অমূল্য সব প্রবন্ধের মাধ্যমে। তাই মনে হয়, এটা নেহাত কাকতলীয় নয় যে তিনি শুরু করলেন 'অপু ট্রিলজি' দিয়ে আর শেষ করলেন, 'গণশত্রু', 'শাখা প্ৰশাখা' আর 'আগন্তুক' - ট্রিলজি দিয়ে। হয়ত তিনিই চেয়েছেন এই ঘেরাটোপে থাকতে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আর একটা সম্ভবনার কথা মনে হয়। আমরা এতবার করে ছবিগুলো দেখেছি, শট, এঙ্গেল, ডায়লগ সব মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই কি মনে হয় সব একই রকম। আলাদা গল্প, প্রেক্ষাপট, কাস্ট সত্ত্বেও। ছবির বাজনা শুনলেই কান বলে দেয় এটা সত্যজিৎ। আশা করি, আগামী দিনে এই নিয়ে আরও আলোচনা হবে।২০২১- সত্যজিতের শতবর্ষ। এই একটি সান্ত্বনাই আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারে সব আতঙ্ক, অস্থিরতা। আবার হয়ত শুরু হবে নিভৃতবাস, অচল হয়ে যাবে পৃথিবী, খানিক শুশ্রূষার আবহ নিয়ে আসুক তাঁর লেখা বই, ছবি, ফিল্ম, সংগীত। সত্যজিতের কাজ হয়ে উঠুক সর্বার্থে থেরাপিউটিক।



[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এই সময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]

Wednesday, April 21, 2021

জীবনের ছন্দের শিক্ষক

 লিখেছেন অংশুমান কর

কবির হাতে "সীমানা ছাড়িয়ে" তুলে দেওয়ার মুহূর্ত (দ্বিতীয় ছবি)

ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কীভাবে এখন আর মনে পড়ে না। তবে এটুকু মনে আছে যে, ওঁর সঙ্গে প্রথম কথা বলেছিলাম ফোনেই। তার আগে অবশ্য নানা অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখেছিলাম একাধিকবার। কী নিয়ে প্রথম কথা বলেছিলাম তাও ভুলে গেছি আজ। তবে ওঁর সঙ্গে যত কথা বলেছি ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে, তার চেয়ে বেশি কথা বলেছি ফোনেই। রবিবারের আড্ডাতেও গিয়েছি খুবই কম। হাতে গোনা কয়েকদিনই। কখনও কবিতা দেখানোর সাহস পাইনি। পাণ্ডুলিপি পড়ানোর কথা ভাবতেও পারিনি কোনোদিন। মাঝে মাঝেই অবশ্য নানা শব্দের শুদ্ধ বানান জিগ্যেস করেছি। শুধু একবার আমার একটি ছোট্ট বইয়ের নামকরণ নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। ওঁকে ফোন করতেই মুহূর্তে সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন। আমার কয়েকজন বন্ধুর মতো ওঁর পায়ের কাছে বসে কবিতা লেখার পাঠ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি; বলা ভালো, আমার দিক থেকেই  সাহস ও সংকল্পের অভাব ছিল। তবে সাহিত্যের প্রকরণ কৌশল ওঁর কাছে শিখিনি কি কিছুই? একলব্যের মতো যেমন অনেক তরুণ কবিই দূর থেকে ওঁকে দেখে দেখেই শিখেছে অনেক কিছু, ওঁর লেখা পড়ে কিছুটা বুঝেছে রবীন্দ্রনাথ, কিছুটা ছন্দ, তেমন আমিও বুঝেছি। কবিতার পর কবিতা পড়ে শিখেছি নির্মাণের কৃৎকৌশলও। কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতা আজ লিখব না। বছর তিনেক আগে ওই পাহাড়ের মতো স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটি সরাসরি ছোট্ট একটি শিক্ষা দিয়েছিলেন আমায়, বলব সেই শিক্ষালাভের কথা।

        সেবার বইমেলায় আমার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশ পেয়েছে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা 'বীরুৎজাতীয়' সাহিত্য সম্মিলনী থেকে। নাম “সীমানা ছাড়িয়ে”। ভারতবর্ষের পাঁচটি ভাষার তরুণ কবিদের কবিতার বাংলা অনুবাদ ছিল সেই বইয়ে। প্রকাশনা সংস্থার ছেলেগুলি খুবই যোগ্য এবং তরুণ। তাঁদের আবদার বইটি শঙ্খ ঘোষের হাতে দিয়ে একটি ছবি তুলে আনতে হবে। স্যারের জন্মদিনে আমি চেষ্টা করতাম প্রতিবার যাওয়ার আর নিজের বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলি ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার। কিন্তু ছবি তুলতাম না সাধারণত। আমাদের বন্ধু সন্দীপন কতগুলো ছবি এমনিই তুলে দিত, বা অন্য কেউ তুলতেন, সেই ছবি পরে পেতাম–এমনটাই হত। নিজের থেকে আমারই সম্পাদিত একটি বই ওঁকে দিয়ে সেই বইয়ের ছবি তুলে ফেসবুকে দেব এটি ওঁকে বলতে আমার সঙ্কোচ হবে জানিয়েছিলাম প্রকাশক ভাইদের। কিন্তু ওদের আব্দার, চেষ্টা করে দেখতে হবে, ছবি যদি পাওয়া যায়। অগত্যা, স্যারকে সেবার ৫ ফেব্রুয়ারি বললাম যে, স্যার একটি বই আপনার হাতে দিয়ে ছবি তুলব। উনি রাজি হলেন। এল ছবি তোলার পালা। আমি ওঁর হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালাম ফোনের ক্যামেরার দিকে। সাধারণত, এভাবেই ছবি তোলা হয়। এটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একটা ছবি তোলাও হয়ে গেল। এরপরই উনি প্রায় ফিশফিশ করে আমাকে বললেন, “এটা কি ঠিক হল?” আমি তো গেলাম ঘাবড়ে! ভুল করলাম কোথায়? কিসে হল ভুল? উনি ঘরের আর কেউ যেন শুনতে না পায় সেভাবেই মৃদু স্বরে আমাকে বললেন, “এই যে তুমি আমার হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালে ক্যামেরার দিকে, এতে কি মনে হল যে, বইটা তুমি আমাকে দিচ্ছ? এতে তো মনে হল ছবিটা সাজানো। ক্যামেরা না-থাকলে কি তুমি এভাবেই দিতে আমাকে বইটা?” বুঝলাম কোথায় হয়েছে ভুল! বুঝলাম ছোট্ট দু’তিনটি বাক্যে উনি আমাদের দেখনদারিত্বের ফাঁপা দিকটা কেমন মুহূর্তে উন্মুক্ত করে দিলেন! বলে দিলেন, স্বাভাবিক ছবি তোলার নিয়মটুকুও। আমি আবার সন্দীপনকে বললাম, নতুন করে ছবি তুলতে। এইবার ক্যামেরা না-থাকলে যেভাবে দিতাম বই, দিলাম সেভাবেই। ওঁর মুখে তখন স্মিত হাসি।

        এই ঘটনাটির পরে আজ পর্যন্ত আর কাউকেই বই দিয়ে ছবি তুলিনি। কিন্তু তুললে, ওই ছোট্ট শিক্ষাটুকু ভুলব না। আসলে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি চাইতেন শুধু কবিতায় নয়, তরুণ কবিদের জীবনের ছন্দেও যেন ভুল না থাকে।


অংশুমান কর

অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় 

এবং 

প্রাক্তন সচিব, সাহিত্য আকাদেমি, পূর্ব অঞ্চল

অংশুমান কর সমসময়ের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কলমের মুগ্ধতায় মাতোয়ারা হয়েছেন বহু পাঠক। কবিতা ছাড়াও গদ্যের মুক্তাঞ্চলে তাঁর অবাধ গতায়াত। প্রকৃত অর্থে তিনি হলে লেখক, লেখাই তাঁর ধর্ম । তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ  "মৃত অশ্বের সওয়ার" ।  সংগ্রহ করুন নিচের লিংকে ক্লিক করে,

'বইঘর' - অনলাইনে বই কিনুন ও পড়ুন

 

Sunday, April 4, 2021

রমানাথ রায় : ঘটের মাথায় এঁচড়

 লিখেছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়

রমানাথ রায়


রমানাথ রায় (জন্ম ৩ জানুয়ারি, ১৯৪০) সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিন মেলা উপলক্ষ্যে বাংলা আকাদেমি সভাঘরে ৭ই ফেব্রুয়ারি একটি আলোচনাসভা ছিল। রমানাথ রায় ছিলেন সে সভার অন্যতম বক্তা । বছর খানেক পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। দেখে বেশ সুস্থ‌ই মনে হয়েছিল।  প্রায়  আধঘণ্টা সময় নিয়ে বললেনও ।

       ষাট বছর আগের কথা দিয়ে তিনি  শুরু করেছিলেন। যেভাবে গল্প লেখা হচ্ছিল তাতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না। 'সামাজিক বাস্তবতা' থেকে 'লেখকের দায়বদ্ধতা'  ইত্যাদি শব্দগুলো বেশ ভারী ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল অন্য ভাবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতিতে, নতুন কিছু বলা দরকার । রমানাথের সে-সব ইচ্ছে  ১৯৬২-তে প্রকাশিত দশটি গল্পের সংকলন 'দু ঘণ্টার ভালোবাসা'-তে ধরা আছে। এক‌ই সময়ে রমানাথ প্রকাশ করতে শুরু করেন 'এই দশক' নামের একটি বুলেটিন। বুলেটিনের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেন আগের দশকগুলি থেকে ভিন্ন কিছু ভাবা ও করার দরকার আছে। ন-টি বুলেটিন প্রকাশিত হয়।  ১৯৬৬-তে সেটি পত্রিকার চেহারা নেয়  এবং  শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের মুখপত্র হয়ে ওঠে। প্রায় ষোলো বছর বেরিয়েছিল সে পত্রিকা। ততদিনে শুধু শাস্ত্রবিরোধী লেখকদল নয়,  পাশাপাশি একটি পাঠকগোষ্ঠীও তৈরি হয়ে গেছে। শাস্ত্রবিরোধীতার ক্ষেত্র‌ও গল্প থেকে উপন্যাসে বিস্তৃতি পেয়েছে।

        বাংলা গল্পের প্রচলিত রীতি যে ভাঙা দরকার তা পাঁচের দশকের শেষ দিকে অনুভব করেছিলেন কেউ কেউ। ১৯৫৯ সালে বিমল কর চারজন গল্পকারের  চারটি ছোটোগল্প  প্রকাশ করে নতুন রীতির গল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন বলা যায় । এই চারটি গল্পের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'বিজনের রক্তমাংস' এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জটায়ু'। এ  দুটি গল্প রমানাথের বিশ্বাসকে আর‌ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল যে অন্য  পথে যাওয়া দরকার এবং তা সম্ভব‌ও। সেই  নতুন পথের সন্ধানে গিয়ে রমানাথের মনে হয়েছিল কাহিনিনির্ভর গল্পের মধ্যে বড়ো বেশি যুক্তি ও শৃঙ্খলা।  সে সব গল্পের যে গার্হস্থ্য‌জীবন তাও বানানো । তাঁর মনে  প্রশ্ন জেগেছিল জীবনে যখন এতো অনিশ্চয়তা তখন সাহিত্যে এতো বানানো নিশ্চয়তা  কেন ? এই শৃঙ্খলা  এক অর্থে শৃঙ্খল, এই নিটোল নির্মাণ এক অর্থে স্থিতাবস্থার সহচর। শিল্প একটা মুক্ত পরিসর খোঁজে।  তত্ত্ব ও সূত্র  দিয়ে তাকে জড়ালে অন্তরের জটিল অনুভূতি প্রকাশের পথ  মেলে না।  তাই সাহিত্যের সংহিতা থেকে বেরিয়ে জীবনের সহজিয়া পথে কথাকারদের চলা দরকার। বিশ-বাইশ বছরের রমানাথ  'দু ঘণ্টার ভালোবাসা' পর্বের গল্পগুলিতে সে পথ ধরেই হেঁটেছেন।

          'দু ঘণ্টার ভালোবাসা' নামের যে গল্প তার শুরু একজন সেলসম্যান ও তার সঙ্গে আসা বাইশ-তেইশ বছরের এক অবিবাহিত যুবতীকে দিয়ে। তারা একটি বাড়িতে তাদের কোম্পানির বিস্কুট বিক্রি করতে এসেছে। সেলসম্যান জানাচ্ছে যে তাদের বিস্কুট কিনলে তারা  একটি বিশেষ গিফ্ট দিচ্ছে। তারপর গল্পে লেখা হয় ---

        গিফ্টের কথা শুনে উৎসুক হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী  গিফ্ট ?
        লোকটি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এর গালে একটা চুমু খেতে পারেন।
        কথাটা শুনে চমকে উঠি, সত্যি?
        ---সত্যি।
        ---যদি দুটো নিই?
        ---তাহলে দুটো চুমু।  আর যদি দশটা প্যাকেট নেন তাহলে এর  সঙ্গে দু-ঘণ্টা সময় কাটাতে পারবেন। আপনার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে।

        রমানাথ রায় ঠিক এতখানি যান্ত্রিক এক জগতের গল্প শুনিয়েছিলেন এখন থেকে প্রায় ষাট বছর আগে। সেখানে একাধিক যুবতী নারী আছে,  তাদের তুলতুলে হাত আছে, তাদের গালে চুমু খাওয়ায় অধিকার আছে কিন্তু তাদের প্রেম নেই। তাদের ভিন্ন পরিচিত‌ও নেই। একটাই নাম তাদের--- টিনা। তারা কোনো স্বপ্ন দেখায়‌ না, দেখেও না।  পরিদের মতো ডানাওয়ালা যুবতীও  মেলে  কিন্তু মনে পড়ে ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আর দু-বোনের প্রতীক্ষার কথা । তখন যুবতীটির সঙ্গে  ডানায় চড়ে পাহাড় কিংবা সমুদ্র দেখে আসার ইচ্ছে চলে যায়।  এই গল্পে কোনো রোমান্টিক ভাবালুতা নেই, প্রেমের পেলবতা নেই, যৌনতার আনন্দ নেই।  একটা পারিবারিক জীবনের ছবি আছে কিন্তু তা বেশ ভাঙাচোরা। মা রোগে কাতরায়, দিদি তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে না পেরে ফিরে আসে, ছোটো বোন দেখতে তেমন ভালো নয় বলে বিয়ে হয় না। তাই একটা বিষণ্ণতা সংসারের চারটি মানুষকে ঘিরে রাখে । আর দশ প্যাকেট বিস্কুটের বিনিময়ে চুক্তির যে কেনা ভালোবাসা, তা  ঠিক দু ঘণ্টা পরে, একবার‌ও পিছন ফিরে না তাকিয়ে  চলে যায়। বাস্তব ও ফ্যান্টাসি মিশিয়ে এমন‌ই এক গল্পের জগৎ সেদিন তৈরি করছিলেন রমানাথ।


           'কারণ অজ্ঞাত' গল্পে একটা চমৎকার পারিবারিক ও সামাজিক ছবি আছে । সে ছবি বেশ নিখুঁত ও নিটোল কিন্তু পাঁচুর রাগ  দুদিন পরেও না পড়াতে সেই ছবিটাই  দ্রুত এলোমেলো হতে শুরু করে। চারপাশের মানুষজনের ভিতরের চেহারাটা বেরিয়ে আসে। পাঁচুর রাগের প্রকৃত কারণ কেউ জানে না আর তাই সবাই ভাবে  তার উপরে  রাগ করেই পাঁচু কথা বলছে না । বাজারের যে  আলুওয়ালা, পেঁয়াজওয়ালা, মাছ‌ওয়ালারা বহুকাল ধরে পাঁচুকে ওজনে ঠকিয়ে আসছে, তারা এবার ঠিকঠাক ওজন দেওয়া শুরু করে। অফিসের বড়োকর্তা পাঁচুর  যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বঞ্চিত করে অযোগ্য শিবপ্রসাদকে প্রমোশন দিয়েছে কারণ সে  ইলিশ ও ট্যাংরা খাইয়েছে এবং  মদের বিল‌ও মিটিয়েছে। কিন্তু পাঁচুর রাগী মুখটা দেখে বড়োকর্তা ভাবে এবার পাঁচুর জন্যে কিছু একটা করতেই হবে । পাঁচুর ব‌উ ভাবে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে  যোগাযোগ রাখার খবরটা  পাঁচু নিশ্চিত জেনেছে আর তাতেই এমন রেগে আছে। সে ঠিক করে এবার থেকে সে শুধু পাঁচুকেই ভালোবাসবে। পাঁচুর আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়ার ক্লাবের কর্মকর্তারা পর্যন্ত  নিজেদের ভুল শুধরে নেবার কথা ভাবে। শেষ পর্যন্ত পাঁচুর ঘরে বাড়ির ও পাড়ার মহিলারা একসঙ্গে সোচ্চারে কান্না জোড়ে । তা দেখে পাঁচু হেসে ফেলে এবং চারপাশের মানুষজন আবার তাদের পুরোনো চরিত্রে ফেরে। রমানাথ রায়ের এই গল্পের শেষে পাঁচুর চারপাশের লোকজনদের মধ্যে আর কোনো আত্মগ্লানি নেই। পাঁচুর‌ও  রাগ নেই, বরং সে হাসছে। সব মিলে যা তৈরি হয় তা হলো ব্ল্যাক হিউমার। ডুবন্ত জাহাজের নাবিক, শত্রুপক্ষের কামানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক, ফাঁসির আসামির  কোনো কোনো কথা ও কাজে এই হাসি জন্ম নেয়।

           'ফু' গল্পের কথক কোনো একজনের কাছে বলেছিল যে তার জ্যাঠামশাই মিথ্যেবাদী। কেউ একজন সে কথা তার মুখ্যমন্ত্রী জ্যাঠামশাইয়ের কানে তুলে দেয়। তাতেই কলকাতার সরকারী দপ্তর থেকে ষোলো বছরের জন্যে নির্বাসিত হয়ে কুচবিহার, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জায়গায় ঘোরা। আবার জ্যাঠামশায়ের কৃপাদৃষ্টিতে কলকাতায় ফেরা এবং মনের আনন্দে চাকরি করা, ব‌উ মিনুর সঙ্গে সিনেমা দেখা, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাতায়াত করা। কিন্তু হঠাৎ একদিন জানলার কাছে দুর্গন্ধ পাওয়া গেল এবং দেখা গেল একটা মরা কুকুর পড়ে আছে। তারপর কুকুরের সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কর্পোরেশনে যোগাযোগ করে, পুলিশে খবর দিয়ে, এমনকী মুখ্যমন্ত্রী জ্যাঠামশাইকে বলেও কাজ হয় না। শেষে জ্যাঠামশাই প্রমাণ চেয়ে বসেন। একটার পর একটা প্রমাণ দিতে দিতে হঠাৎ দেখা গেল  'জ্যাঠামশাইয়ের চেয়ারে আমি বসে আছি আর আমার চেয়ারে জ্যাঠামশাই বসে আছেন।' জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে 'আমি কখন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছি।' তখন  জ্যাঠামশাইয়ের মুখে রাস্তায় দুর্গন্ধ, বিনা চিকিৎসায় মানুষজনের মৃত্যু, বেকার সমস্যা,খাদ্য সমস্যা, মেধাহীনতা ইত্যাদি নানা অভিযোগ আর  ভাইপো সে সব অভিযোগের প্রমাণ চায়। জ্যাঠামশাই টেবিল চাপড়ে 'ফুঃ' বলেন আর মুখ্যমন্ত্রী ভাইপোও টেবিল চাপড়ে 'ফুঃ' বলে। রমানাথ রায় সেদিন বাংলা কাহিনির প্রচলিত বিন্যাস  এবং চরিত্রের নির্মাণকে ঠিক  এতখানিই ওলটপালট করে দেন। গল্পের মানুষজনের মধ্যে ভালোমন্দের কোনো ভাগাভাগি নেই। রমানাথ বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না কিন্তু তার পরিচিত তাত্ত্বিক গড়নকে একেবারেই আমল দেন না।


           নিজের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপে নিজেকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, 'কাকে চাই?' দু-চার কথার পর জানা যায় যে শুধু ফ্ল্যাট‌ই বেদখল হয়নি, যার সঙ্গে থাকত সেই বিবিও বেদখল হয়ে গেছে। যে এখন ফ্ল্যাটের দখল নিয়েছে সেই বলাই দত্তের  সঙ্গে বিবি এখন স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকে। থানায়  গিয়ে অভিযোগ করাতে জানা গেল বলাই দত্ত রাজনৈতিক লোক এবং সব অর্থেই বেশ ক্ষমতাবান। তবু পুলিশ ফ্ল্যাটে যায় এবং বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে আর ভাড়ার রসিদ দেখে বলাই দত্তকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে দেয়। সে সঙ্গে বিবিও বেরিয়ে যায় কারণ সে বলাই দত্তকে ভালোবাসে। অবশ্য বলে রায় বলাই দত্তের সঙ্গে ভালো না লাগলে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু ফেরার সে পথ বন্ধ করতে নতুন মেয়ের সন্ধান করে কিন্তু কেউ কালো, কেউ ঢেঙা, কার‌ও আবার কোমর মোটা। সে তাদের বাতিল করে আবার কেউ কেউ তাকেও বাতিল করে কারণ সে বেঁটে ও কালো। শেষ পর্যন্ত বিবি‌ই ফিরে আসে কারণ বলাই দত্তের সঙ্গে তার থাকতে ভালো লাগল না। মনে হলো সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেল। কিন্তু আবার অফিসের কাজে বাইরে থেকে ঘুরে এসে দরজার কলিং বেল টেপার পর সেই এক‌ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়---কাকে চাই? তবে এবার শুধু বলাই দত্ত নয়, তার পিছনে আছে বাড়ির মালিক, অন্য প্রতিবেশী এবং পুলিশ‌ও। রমানাথ রায়ের এই গল্পের শুরু ও শেষে একটাই প্রশ্ন শোনা গেছে ---কাকে চাই ?  কে যে  ঠিক কাকে চায় তার নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই।  যাকে চায় সে  বিবি হতে পারে, ঝুমা হতে পারে, হেমা হতে পারে, চাঁপা হতে পারে।  আবার অন্য কেউ হলেও ক্ষতি নেই। উল্টোদিকে বিবি বা ঝুমারাও যে নির্দিষ্ট কাউকে চায়, এমন‌ও নয়।  কখন‌ও জৈবিক একটা সম্পর্ক, কখন‌ও অর্থনৈতিক একটা নিরাপত্তা একজন মানুষকে আর একজনের কাছে এনে ফেলে। এমন‌ই ক্ষণস্থায়ী কিছু অসম্পর্কে বাঁচা। ঘরের বাইরে গেলে আবার সেখানে ফেরাও অনিশ্চিত। আত্মকেন্দ্রিক ও নিরাশ্রয় এক জগতের অনাসক্ত  বিবরণ লিখলেন রমানাথ। সে বিবরণের একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো গল্পকার সেখানে দর্শক মাত্র। রমানাথ অনেক বেশি চরিত্রগুলির  সংলাপের উপর জোর দিলেন । ফলে গল্পকার‌ অনেক অনাবশ্যক দায় থেকে মুক্তি পেলেন।

           পুষ্কর দাশগুপ্ত তাঁর একটি লেখায় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে  তাঁদের অভিনব  স্টল সাজানোর কথা লিখেছিলেন। হাতে টাকা কম বলে তেমন ভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি তবে হঠাৎ একটা মাটির ঘট পেয়ে যান।   সেটাকে সাজিয়ে স্টলে রাখবেন বলে রমানাথ রায়কে একটা ডাব আনতে বলেন কিন্তু কলেজ স্ট্রিট বাজারে গিয়ে রমানাথ দেখেন সব ডাব বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি অবশ্য ফাঁকা হাতে ফেরেননি। একটি এঁচড় কিনে নিয়ে যান এবং সেটাই ঘটের উপর রাখা হয়।  মঙ্গলঘটের প্রতীকটি এভাবে ভেঙে যাওয়াতে  স্টলে আসা মানুষজনের অনেকেই চটে যান।  রমানাথ বাংলা গল্পে ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন। কাহিনি, চরিত্রায়ণ, দায়বদ্ধতা, জীবনদর্শন, মহত্ত্ব ইত্যাদি মঙ্গলচিহ্নগুলিকে বিসর্জন দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের ঘটে এঁচড় চড়িয়েছিলেন।  ঘটটা সংগ্রহ করেছিলেন পুষ্কর দাশগুপ্ত কিন্তু মেলার মাঠে ঘটটা কে ছেড়ে এসেছিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন। মার্ক টোয়েন, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়,  শ্রীরামকৃষ্ণ, সুকুমার রায়, পরশুরাম থেকে অঁতোন্যাঁ আর্তোর মধ্যে যে কেউ এটা করতে পারেন আবার তাঁরা একসঙ্গে গিয়েও রেখে আসতে পারেন।‌ তবে সে ঘটের মাথার এঁচড়টা যে  রমানাথ রায়‌ই বাজার থেকে কিনে নিয়ে যান,  এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। একজন লেখকের প্রধান কাজ‌ই তো হলো  প্রচলিত প্রতীক ও চেনা রীতিকে ভেঙে ফেলা।



রামকুমার মুখোপাধ্যায় 

ব্যস, আর কিচ্ছু নয় । 

Saturday, February 20, 2021

একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণে

লিখেছেন শুভজিৎ পাত্র

ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত 

একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করলেই কী হবে?

শুধু বছরের একটা দিন,চব্বিশটা ঘন্টা!

যে আন্তরিক আবেগে একদা উদ্বেল হয়েছিল ঢাকার রাজপথ,

তার ভগ্নাংশও কি ধারণ করতে পেরেছি আমাদের সত্তায়?

যে ডাক মুক্তির,যে ডাক আকাশে মাথা তোলবার

সেই তীব্র তেজ কই আমাদের চেতনায়?

পুলিশের গুলির মুখে মাথা উঁচু রেখে সালাম,রফিকরা গেয়েছিল মাতৃভাষার জয়গান

কিন্তু প্রতি পদে,প্রতি মুহূর্তে,ভিন্ন ভাষায় নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি মনের সজীবতা!

যদি রক্তের প্রতিটি কণায় মাতৃভাষার প্রকৃত মর্ম  না করি অনুভব,তবে একুশে ফেব্রুয়ারি নেহাতই একটি দিন

তা ছাড়া অন্য কিছু নয় !


শুভজিৎ পাত্র- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের শিক্ষক।  মৌলিক গদ্য ও কবিতার প্রতি অগাধ আকৰ্ষণ।  লিখেছেন বহু পত্র-পত্রিকায়।  সবচেয়ে জরুরি ঘোষণাখানি হল তিনি একজন বাংলা ভাষার সেনানি।   

Monday, February 15, 2021

আবছা বসন্ত পঞ্চমীর ঝাপসা জলছবি

লিখেছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

ছবি: ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ 

মাঘ সন্ধ্যার কাঁপন ফিকে হয়ে এলেই আকাশে একফালি চাঁদ ওঠে। কুয়াশার গা বেয়ে ঝুলে পড়ে রাতজাগা বাদুর। জোনাকির ঝাড় এসে রূপালী টিপ পরিয়ে দেয় ফুলের কপালে সজনে ফুল দুলে ওঠে সোহাগের শিহরণে। পলাশের নিঃশ্বাসে রঙ ঝরে পড়ে। শিমুলের সিঁথিতে জমাট হয় থোকা থোকা রক্ত সিঁদুরপাখির ডানায় সুদূরের গন্ধ গাঢ় হয়। দখিনা বাতাসে স্মৃতির দোলায় দুলতে থাকে তিরতিরে পাতারা। পায়ে পায়ে নেমে আসে মায়াবী আকাশও। “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে”! ঝাঁক ঝাঁক রোদ্দুর এসে উবু হয়ে বসে পড়ে মায়া টানটান উঠোনে। অশান্ত পানকৌড়ির ডানায় জল রোদ্দুরের কাটাকুটি খুঁড়ে জীবন খোঁজার চমক। এমনি ভাবেই অমোঘ বসন্ত পঞ্চমীতে আছড়ে পড়ে সরস্বতী পুজোর ধূম।  

দখিণা বাতাসের জলতরঙ্গে কোকিলের চমক জাগার আগেই আমি ঘ্রাণ পাই। পলাশ রঙা ভোরের গন্ধ। পোয়াতি ধানের আকাঙ্খার গন্ধ। দুকুল ভাসানো সর্ষে ক্ষেতের গন্ধ। ধানের শীষে লেগে থাকা শিশিরের মায়ার গন্ধ। সোহাগী করতলের গন্ধ। সরস্বতী পুজোর গন্ধ। সেই কোন ছেলেবেলায় ফেলে আসা কৈশোরের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় বাসন্তী সকালেবন-বনান্তর পেরিয়ে থোকা থোকা জোনাকির ঝাড়ের সঙ্গেও। বৎসর ভর সবকিছু আগলে রাখতে রাখতে বসন্ত পঞ্চমীতে ঝাঁপি ভেঙে বেরিয়ে পড়ে তারা। সেই সব গন্ধ মাখা, স্পর্শ লাগা, স্মৃতির ঘেরা তারুণ্যের জলছবিগুলো

ছেলেবেলায় আমার একটা বুক ভরা উচ্ছল নদী ছিল। এতদিনে তিলতিল করে শুকিয়ে গেলেও পিছন পানে বয়ে যেতে পারেনি। বসন্ত এসে উঁকি দিলেই নদীটায় প্রবল জলস্ফীতি হয়। উপচে পড়ে উচ্ছ্বাস। যৌবনের মণিমালারাও একে একে এসে জড়ো হয় নদী পাড়ে বাসন্তী পঞ্চমী আর নুড়িপাথরের খুনসুটির যুগলবন্দীর অমোঘ ইশারায় নুড়িপাথর ডিঙিয়ে উজান স্রোতে ভেসে চলে আবেগের নদী। বল্গাহীন তরঙ্গের হিল্লোল। ছায়া ছায়া বিপুল মাঠ। দুকুল বেয়ে টকটকে শিমূলের উল্লাস। নদী বক্ষে আমার প্রাণের কুয়াশা আর মেঘের ছাউনি ঘেরা ছোট্ট নৌকার গলুই ভেসে চলে টলোমলো পায়ে। একূল ছাড়িয়ে অন্য কোন কূলের আঘ্রাণে। ছেলেবেলার অচিনপুরের ডাহুক, পানকৌড়ি, মণিমালা, রক্তপলাশের সুলুক সন্ধানে। ভেজা চুল, থরথর ঠোঁট, ছলছল চোখের কালান্তরি ইশারায়। উচ্ছ্বাসময় উজান পেরিয়ে ভাটির টানে বয়ে চলা নদীও বসন্ত বাতাসের আশকারায় সুর ভাজে ... তুমি প্রান হয়ে এসো, উতলা এই বসন্ত দিনে।  

বসন্ত রোদ্দুরের একটা গন্ধ থাকে। একটা আহ্লাদী স্পর্শ থাকে। একটা মায়া থাকে। সারা গায়ে রোদ্দুর জড়িয়ে এক বাসন্তী সকালে সেও এসেছিল। যেন বহুদূরের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে কূলপ্লাবী জ্যোৎস্নার অমোঘ টানেতাঁর বুকের ভাঁজে যেন জ্যোৎস্না চলকে উঠেছিল। তাঁর কাছে ভালবাসার গোলাপ ছিল। মায়ার আকুতিও। নিজেকে উজাড় করে সে অনুভব করেছিল ... ফাল্গুনী ঠোঁটে মৌটুসির আকণ্ঠ চুমুক। আমি তাঁর মায়ার প্রশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বহু যুগ পরে যখন ঘুম ভেঙেছিল, কালের সমুদ্রতটে তাঁর কঙ্কালখানি শুধু পড়েছিল। ভালবাসার গোলাপটাও। কালান্তরি বাসন্তী সকালের রোদ্দুরের বাহুতে এখনও সেই গন্ধ লেগে আছে। আমি প্রাণপণে তার ঘ্রাণ নিই।

বাসন্তী সকালে প্রশান্তির আঁতর গায়ে মেখে ঝলমলে শাড়ির আঁচল বেয়ে একটি প্রাণোচ্ছল যুবতীকে পথ হাঁটতে দেখেছিলামকতই বা বয়স হবে! ২০ কিংবা ২২। কিন্তু মনে হয়েছিল, যেন কালের অনুশাসন পেরিয়ে বহুকাল ধরে সে হেঁটেই চলেছে। কোথায় চলেছে সে? কে জানে! হয়তো কোন ফাল্গুনী মায়ার দুর্নিবার টানে! হয়তো তাঁর সুলুক সন্ধানে, যার জিনসের পকেট ফুঁড়ে বসন্তের রোদ্দুর উঁকি মারে!   

আমার মতো প্রঢ়দের বসন্তে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’-র মোড়কে পাশ্চাত্য প্রেমের দিন যাপনের কোন অবকাশই ছিল না। আমাদের কচি পাতার মতো প্রেমের উদ্দাম জলপ্রপাত পাহাড় বেয়ে আছড়ে পড়তো বসন্ত পঞ্চমীর কাকভোরেই। সেকালে সরস্বতী পুজোয় যতটা না ধর্মীয় ভাবাবেগ ছড়িয়ে থাকতো, তার থেকে ঢের বেশি জড়িয়ে থাকতো বঙ্গীয় সংস্কৃতির চিরহরিৎ উচ্ছ্বাস। তাই বাংলার গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, মফঃস্বলে সরস্বতী পুজো হয়ে উঠত আক্ষরিক অর্থে সর্বজনীন।       

বাসন্তী পঞ্চমীর উচ্ছ্বাসের এলোমেলো আশকারায় জীবনটা যেন হঠাৎ পিছন ফিরে চলতে শুরু করে! কাকভোরে উঠে স্নান। ইস্কুলের পূজা প্রাঙ্গণ। বিদ্যা দেবীর পূজার কোলাহল মুখর আয়োজন। বন্ধুর বাড়ানো হাত। রংবেরঙের শাড়ি। রাঙা পলাশের হাতছানি। আলতা পায়ের আলাপী খুনসুটি। আলতো হাতের পরশ। চাহনি ভরা ইচ্ছের ঝলক। আঁচল বোঝাই মায়া। দিনদুপুরে অবিরাম বৃষ্টি ধারা। মুহূর্তদের হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা, যতক্ষণ না তাঁরা স্মৃতির আকুতি নিয়ে ফিরে ফিরে আসে তোলপাড় করা বক্ষ মাঝেবয়ে নিয়ে চলি আমরা, স্মৃতির ফল্গুধারা, জীবনের অথৈ আঁকেবাঁকে। ফুরিয়ে যাওয়া মুহূর্তদের আকস্মিক প্লাবনে চলকে ওঠে হৃদয়কুম্ভ কানায় কানায় স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে জ্বলতে থাকে বোবা রোদ্দুরের টিপ।  

সেই কাঁচা বয়েসে, সারা বছর ধরে স্ফুলিঙ্গ ছোটানো রকের রকমারি ফুলঝুরি ... রবীন্দ্রনাথ না গ্যেটে, জীবনানন্দ না বিষ্ণু দে, শক্তি না সুনীল, পিকাসো না নন্দলাল বসু, মার্ক্সবাদ না ফ্যাসিবাদ, লেনিন না রোজা লুক্সেমবার্গ ... এইসব অমীমাংসিত তত্ত্বকথার তর্কের তোড় সরস্বতী পুজোর দিনগুলিতে শিকেয় তোলা থাকতো। তখন আমরা সবাই কেবলই কচ অথবা দেবযানী। রোমিও অথবা জুলিয়েট। কিংবা লায়লা অথবা মজনু। লাল-হলুদ শাড়ির আঁচলের বিহ্বলতায় কেবলই মজে থাকা। সেই যে কবে একবার লিখে ফেলেছিলাম না! ‘তুই যদি চাস ফাগুন আবার, আনতে পারি রক্তপলাশ’। যেন গাছে গাছে ফুটে থাকা রক্তপলাশের উচ্ছ্বাস বইত আমাদের রক্ত ধারায়। তখন ঝাঁক ঝাঁক সোনালি রঙের রোদ ছিল। সেদিনের হৃদয় কুম্ভ কানায় কানায় ভরে থাকতো ঝলমলে বাসন্তী রোদ্দুরে।  

ছেলেবেলার বন্ধু অনির্বাণ এমন রোদ ঝলমলে বাসন্তী সকালে নদীপাড়ের বালিতে কত কি আঁকিবুঁকি কাটতো। ওঁর আঙুলে বসন্তের রোদ্দুর লেগে থাকতো। মেঘ রঙা খামে মন কেমনের চিঠি পাঠাতো সহপাঠিনী সুচরিতাকে। দুজনের দেখা হতো কলকল নদীর উচ্ছলতায় বিভোর হয়ে। আদিগন্ত ব্যাপী পলাশ-শিমুলের আলিঙ্গনে। বাঁশবনের আবডালে খোপা বোঝাই জ্যোৎস্না মেখে। হৃদয়ের উথালপাতালের উচ্ছ্বাসে হাওয়ার বাঁশি কেঁপে কেঁপে উঠত। শিমূল-পলাশের কপাল নুইয়ে পড়তো মাটির ছোঁয়া পেতে। তারপর কত বসন্ত পঞ্চমীর অশান্ত ঢেউ বয়ে গেছে নদী বক্ষেসুচরিতা এখন পরপারের গৃহিণী। অনির্বাণ এখনও আঁকিবুঁকি কাটে নদীর এপারের ঢিবি করা বালির স্তূপে কাঁচাপাকা চুল। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। আঙুলে বোঝাই শ্রাবণী মেঘের ঘনঘটা। বাসন্তী সকালের রোদ্দুরে আজ যেন কত জন্মের ঘুমের অবসাদ!

এমনি ভাবেই কাঁচের মার্বেলের মতো গড়িয়ে যায় জীবনের কত মধুমাস! ছুটন্ত রেলগাড়ির থেকে দেখা প্রকৃতির মতো সরে সরে যায় পলাশ রাঙা বসন্ত দিনের করুণ আর্তিধাবমান গতির আবর্তনে ক্রমশই ফিকে হয়ে পড়ে ঝকমকে আলোর চকচকে মুহূর্তের আলিঙ্গনশুন্যতা বুকে বয়ে একাকী পড়ে থাকে থোকা থোকা রঙহীন রক্তপলাশরাত গভীরের তুমুল বৃষ্টিতে হয়তো মুছে যাবে রক্তিম আভায় এঁকে আসা শিমূলের রাঙা ঠোঁটের সকল আকুতি। এমনি ভাবেই পাকদণ্ডী পথ চরাই-উৎরাই পেরিয়ে সকলকেই এগিয়ে নিয়ে চলে জীবন পথের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রত্যন্ত প্রান্তে। পেরিয়ে এসেছি কাজল কালো চকিত চাহনির আঁচল ভরা অবগাহন। কিংবা মেঠো ফুলের খিলখিল হাসিতে টোল পরা গালের শিহরণ। অথবা বাসন্তী বিকেলের মায়াবী আস্কারায় টলমল করা সেই দুটি আকাঙ্খার ঠোঁট! বাঁকা চাঁদ আজও এসে উবু হয়ে বসে কৃষ্ণচূড়ার কাঁধে মিটিমিটি নক্ষত্ররা ঘুমিয়ে পরে বকুলের সোহাগী ডালে। এলোমেলো দখিণা বাতাস চিৎকার করে বলে, “ফিরায়ে দাও অক্ষত মন সাদা পাতা”। প্রতিধ্বনি ফিরে আসে না। তবু রাত জেগে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষার অস্থির পাহাড়। রাত জাগা ঠোঁটে আজও ঝুলে থাকে বাসন্তী পঞ্চমীর আবেগময় অষ্টপ্রহর। 

 



ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ । এই অ্যাকাডেমিক পরিচয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তিনি এমন একজন লেখক যিনি সময়ের রোজনামচাকে লেখকজীবনের আঙ্গিকে সাজিয়েছেন । তিনি নিয়মিত নানা দৈনিক সংবাদপত্রে, যেমন - আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান একদিন ও পুবের কলম ইত্যাদি, লিখেছেন, লিখে চলেছেন বহু মূল্যবান সমাজ-দলিল । 

Friday, February 12, 2021

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সব তথ্যপ্রমাণ সাজানো : ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বিস্ফোরক ওয়াশিংটন পোস্ট

লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী 

শিল্পীঃ মলিয়ার ডিমানচে (উৎসঃ দ্য কনভার্সেশন পত্রিকা)


২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুনের শনিবারওয়াড়ায় ভীমা কোরেগাঁওয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এলগার পরিষদের সম্মেলন চলছিল। ওই সম্মেলন চলাকালীন বক্তৃতা করেছিলেন ভারাভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, রোনা উইলসন প্রমুখ আদিবাসী, দলিত ও নিপীড়িত মানুষের কাছের মানুষেরা। পরের দিন, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবজাগর প্রতিষ্ঠান ও হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির উস্কানিতে ও প্ররোচনায় সেখানে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে ও একজনের মৃত্যু হয়। এরপর পুলিশ এই দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে এফআইর করে। এরপরই চালচিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলায় পুলিশ একে একে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে দশজন বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের, পুলিশ যাঁদের চিহ্নিত করেন 'শহুরে মাওবাদী' হিসেবে, কিন্তু এফআইআর-এ যাদের নাম ছিল না। এরপর খেলা আরও জমে ওঠে।মুম্বাই, দিল্লি, নাগপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও পাঁচজনকে। কয়েকঘন্টার মধ্যে মহারাষ্ট্র পুলিশ একটি ই-মেল বার্তার ফটোকপি পৌঁছে দেয় বাছাই করা কিছু সাংবাদিক ও দিল্লিতে শাসক দলের সদর দপ্তরে।বলা হয় ই-মেল বার্তাটি পাওয়া গেছে গ্রেপ্তার হওয়া একজনের কম্পিউটার থেকে।কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিক জেনে গেলেন, মহারাষ্ট্র পুলিশের তৎপরতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ভীমা মামলার মূল কুচক্রী 'শহুরে মাওবাদী' পাঁচ শীর্ষ নেতা নেত্রী, সোমা সেন, রোনা উইলসন, মহেশ রাউত, সুধীর ধাওলে এবং সুরেন্দ্র গ্যাডলিং। এখানেই শেষ নয়, পরের দিন জানা গেল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন মাওবাদীরা! এবং এক মাসের মধ্যে আর একটি ই-মেলের প্রতিলিপি পুলিশ পৌঁছে দিল নির্দিষ্ট একটি টিভি চ্যানেলের দপ্তরে।গ্রেপ্তার হলেন সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ পেরেরা, গৌতম নওলখা ও ভারাভারা রাও। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে এদের নিক্ষেপ করা হল জেলে। এরপর ২০১৯ সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করে, অভিযুক্ত সমাজকর্মীদের সাহায্য করতে চাইছেন, এমন কয়েকজনের ই-মেলে 'নেটওয়্যার'-এর মতো ম্যালওয়্যার পাঠানো হচ্ছে। এমনেস্টি-র আরও দাবি ছিল, সমাজকর্মীদের পক্ষে সওয়াল করা কয়েকজনকে এনএসও গ্ৰুপের 'পেগাসাস স্পাইওয়্যার' দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। এই সংস্থাটি শুধুমাত্র সরকারকেই তাদের স্পাই - টুল বিক্রি করে।সে ক্ষেত্রে সরকারকে প্রশ্ন করা হলে কোনও উত্তর পাওয়া যায় নি। কিন্তু সত্যের এমনই জোর, যে তা প্রকাশিত হয়ে তবেই ছাড়ে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল সেই সত্য, যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় চার বছর ধরে চলতে থাকা এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার গ্রেপ্তার হওয়া 'শহুরে মাওবাদী'রা। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। অভিযুক্ত রোনা উইলসনের আইনজীবী তাঁর মক্কেলের ল্যাপটপের ডিজিটাল কপি খতিয়ে দেখার জন্য মার্কিন ডিজিটাল ফরেন্সিক ফার্ম 'আর্সেনাল কনসাল্টিং'-এর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বিদেশের নানা হাই প্রোফাইল ঘটনার তদন্ত করে থাকে এই ফার্ম।তাঁদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। রিপোর্ট-এ বলা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় কোনও ব্যক্তি ম্যালওয়ার ব্যবহার করে উইলসনের কম্পিউটার হ্যাক করে। আর তারপর সেখানে একটি লুকোনো ফোল্ডারে ১০টি চিঠি জমা করে। উইলসন গ্রেপ্তার হওয়ার পর  তাঁর ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার হওয়া এই দশটি চিঠিকেই চার্জশিটে তুলে ধরে পুলিশ। তাঁদের দাবি ছিল এই চিঠিগুলির মধ্যেই নাকি এক মাওবাদী নেতাকে অস্ত্র কেনার কথা বলেন উইলসন, এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। আর্সেনাল কনসাল্টিং জানাচ্ছেন এই চিঠিগুলি ছিল এক গোপন ফোল্ডারে যা খুলেই দেখেননি উইলসন। এই সাইবার হামলার মূল কুচক্রীকে খুঁজে না পেলেও এটা পরিষ্কার যে একই সার্ভার এবং আইপি এড্রেস ব্যবহার করে বাকিদের ল্যাপটপ হ্যাক করা হয়েছে। আর্সেনাল জানিয়েছেন তাঁরা যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপের তদন্ত করেছেন তার মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। যে বিপুল সময় ও যতটা পরিকল্পিত ভাবে এই ঘটনা সাজানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। কি ভাবে হয়েছিল হ্যাকিং?২০১৬ সালে ভারাভারা রাওয়ের আকাউন্ট থেকে উইলসনের কাছে বেশ কিছু ই-মেল আসে। প্রতিটি মেলেই একটি বিশেষ ডকুমেন্ট খোলার কথা বলা হয়েছিল। আর্সেনাল কনসাল্টিং-এর মতে সে ই-মেলেই ছিল 'নেটওয়্যার'-এর লিঙ্ক। যে ম্যালওয়্যারের সাহায্যে উইলসনের ল্যাপটপের রিমোট একসেস নিয়েছিল আততায়ী। তাঁর পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে ব্রাউজিং এক্টিভিটি, সব কিছুর উপর চলেছিল নজরদারি। তারপর গোপন ফোল্ডার করে রাখা হয় চিঠিগুলো। এমনকি চিঠিগুলো ওয়ার্ডের যে নতুন ভার্সনে লেখা হয়েছিল , মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের সেই ভার্সন উইলসনের ল্যাপটপেই নেই। উইলসন যার খোঁজ পেলেননা পুলিশ তাঁর খোঁজ পেল কিভাবে? এই ভাবে আদাজল খেয়ে সমাজকর্মীদের পেছনে রাষ্ট্র লাগাতার ভাবে কাজ করে গেছে, এমনটা শেষ কবে দেখেছে বিশ্ব? আসলে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। তাঁদের লক্ষ্য , যাঁরা নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের সামনের সারিতে, তাঁদের 'অপরাধী' তকমা দিয়ে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করা।তাই এঁদের বিরুদ্ধে রচিত হয় দীর্ঘমেয়াদি ফাঁসানোর পরিকল্পনা। সরকারি মদতেই যে এসব হয় তা এমেনেস্টির রিপোর্টে পরিস্কার ইঙ্গিত করা হয়েছে।ভয় হয়, এরপর দেশদ্রোহীর খোঁজ শুরু হলে, ঠগ বাছতে না গাঁ উজাড় হয়ে যায়।দেশের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে যখন নির্লজ্জের মত দেশের অন্নদাতা কৃষকদের 'পরজীবী' বলছেন। কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিকে যাঁরা সমর্থন করছেন তাঁদের 'আন্দোলনজীবী' বলছেন, তখন তিনি নিজে যে একজন হীন 'কুচক্রীজীবী' সেটা তাঁকে অবিলম্বে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। কৃষকদের এরপর তিনি যদি 'দেশদ্রোহী' বলে বসেন তবে সারা দুনিয়া বিস্মিত হলেও, সেটাই হয়ত হবে প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাত! দলিত, নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গ দিলে যদি দেশদ্রোহী আখ্যা মেলে, তবে তেমন দেশদ্রোহীর আমাদের দেশে অভাব হবে না। পরিশেষে জানিয়ে রাখি ,ভীমা কোরাগাঁও মামলায় পুলিশ যে দুটি হিন্দু সংগঠনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল, তার মধ্যে একটি সংগঠনের প্রধান এক রাতের জন্য জেলে ছিলেন। অন্য সংগঠনের প্রধান আজও দলিতদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রচার করে চলেছেন, পুলিশের খাতায় তিনি আত্মগোপন করে আছেন। বোঝা যাচ্ছে আজকের ভারতে আত্মগোপন একরকমের আত্মনির্ভরতা!



[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]

Tuesday, February 9, 2021

নকশালবাড়ী আন্দোলনের অন্তঃসারটা আজও যে পড়ে রইলো বেহিসেবী আস্তাকুঁড়েই!

 লিখেছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত

এক ঝাঁক কোকিলের কলতানে আবার একটা বসন্ত এল বলে! সেদিনও ঝাঁক ঝাঁক ভূমিহীন খেটে খাওয়া মানুষের বজ্রমুষ্টি এনেছিল অন্য এক বসন্ত। নাকি ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’! সময়টা পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে। এতকাল ধরে বালাসন নদীর দুকুল ভাসিয়ে অনেক অম্লমধুর জলের ধারা বয়ে গেছে। তবু বঙ্গদেশের ‘নিঃসঙ্গ কবি’র(!) সেই অমোঘ লাইনটি কিন্তু এখনও টিকে আছে কুরুক্ষেত্রের এই পৃথিবীতে ... 

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়”

 

সে এক অস্থির সময়। যার পটভূমি আঁকা হয়েছিল সেই ১৯৬৭ সালে। জোতদার বুদ্ধিমান তিরকে আর ভূমিহীন কৃষক বিগল কিষাণের জমি বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে যেদিন পুলিশকর্মী সোনাম ওয়াংদিকে তীর বিদ্ধ করে হত্যা করে ফেললো ক্ষিপ্ত ভূমিহীন কৃষকের মিছিল পিকিং রেডিও থেকে যাকে বলা হয়েছিল ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’। এবং ১৯৬৭-র ২৫-শে মে রাষ্ট্রশক্তির উদ্ধত রাইফেল থেকে ছিটকে আসা সীসার আগুনে প্রসাদজোতের ধুলোয় মিশে যাওয়া এগারোটা তরতাজা লাসের থেকে চুয়ে পড়া রক্ত। সেদিনই সূচনা হয়ে গিয়েছিল ভারতবর্ষে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক আন্দোলনের এক নূতন সুদূরপ্রসারী অধ্যায়। সেদিনের আগুনের আঁচটা উপলব্ধি করতে পারেননি অনেকেই। তাই তদানীন্তন যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী তথা ডাকসাইটে কম্যুনিস্ট নেতা প্রয়াত হরেকৃষ্ণ কোঙারের সক্রিয় হস্তক্ষেপের পরেও সে আগুন নেভানো গেল না। সেই ধিকিধিকি আঁচ ক্রমেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো ... উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূব থেকে পশ্চিমে। ক্ষোভের বিকিরণে ক্রোধ, বদলের আস্তিনে বদলা, হিংস্রতার মোকাবেলায় নৃশংসতা। একদল ভূমিহীন কৃষক। সঙ্গী সশস্ত্র বিপ্লবের আগুনে দীপ্ত এক ঝাঁক শিক্ষিত মধ্যবিত্তও। রাষ্ট্র ও তার শক্তি। এবং ‘খতম লাইন’।

 

স্নেহলতা মুখোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বলছি ...

 

“একজন বিখ্যাত হার্ট সার্জেন যিনি ১৯৭২ সালে পিজি হাসপাতালের সাথে যুক্ত ছিলেন। কাছাকাছি কেউ কোথাও নেই দেখে ডাক্তারবাবু মর্গে ঢুকে পড়লেন। ঢুকে দেখলেন সম্পূর্ণ বডিটা ছিন্নভিন্ন। মুখ চোখ ফোলা। অত্যাচারের চিহ্ন সারা দেহে। কাকাবাবুর পায়ের দিকে তার হাত নিজের অজান্তে চলে গেল। যারা বেঁচে আছি, তাদের হয়ে তিনি যেন কাকাবাবুর পায়ের ধুলো নিয়ে নীরব মন্ত্র উচ্চারণ করলেন।”

 

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের কোন অবকাশ আমার হাতে নেই। তবে ওই খর্বকায় জরাগ্রস্থ মানুষটির মধ্যে যে আশ্চর্যজনক জন-সন্মোহনী ক্ষমতা ছিল এবং তা নিয়ে যে যথেষ্ট গবেষণার পথ প্রশস্ত আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় যে মানুষটা গোগ্রাসে অজস্র বই পড়ে ফেলতেন, যে মানুষটা সংগীতের মূর্ছনায় আত্মমগ্ন হয়ে থাকতেন, সেই মানুষটাই কোন ‘রাহুর কোপে’ শুধুমাত্র ‘খতম লাইন’কে আঁকড়ে ধরে মানব মুক্তি ঘটাতে চাইলেন! প্রচলিত সত্যের অন্তরে যে অকপট সত্য লুকিয়ে থাকে, তা কি আমরা কখনো ‘খুঁড়ে’ দেখতে চেয়েছি? তার চেয়ে বরং অনেক সহজ পন্থা আমাদের জানা ছিল। শুধুমাত্র ‘খতম লাইনের’ জনকের মুকুট অনায়াসে পড়িয়ে দিয়েই আমাদের দায়টুকু ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি। আমরা ... মানে, আমাদের সৃষ্ট ইতিহাসের হলুদ পাতা। হ্যাঁ, কাকাবাবু নামে পরিচিত তিনিই চারু মজুমদার।

 

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষের গতানুগতিক ধ্যানধারণার একেবারে বিপরীত মেরুতে বিরাজ করা এক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের ঐকান্তিক চেষ্টা (সেই চেষ্টার প্রয়োগে নিশ্চয়ই বিস্তর ভুল ছিল)
, রাজনৈতিক মতবাদকে আমৃত্যু নিষ্ঠা ভরে আঁকড়ে থাকা, ব্যক্তিজীবনের উচ্চাকাঙ্খা ও স্বাচ্ছন্দ্যকে অবলীলায় অবদমিত করে সমষ্টিগত ভাবনার কাছে নিজেকে নিবেদন করা ... যা আজকের রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগে হয়তো মূল্যহীন ধূসর পাণ্ডুলিপির মতো পরিত্যক্ত বাক্সে তালাবন্দী হয়েই থাকার কথা! রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে বাঁচা (তা সে ঠিক না ভুল, সে বিতর্কের পরিসর এখানে নেই) এবং আপোষহীন মনোভাবকে একনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থেকে জীবনকে ছাপিয়ে মৃত্যুকেও তুচ্ছ করা, স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে এমন ব্যতিক্রমী নিদর্শন তো শেষ দেখা গিয়েছিল নকশালবাড়ীর অশীতিপর এক নকশালেরই কৃতকর্মে। ‘সেজ পাবলিকেশন’ থেকে দ্য ফার্স্ট নকশাল নামে যার জীবনী ছাপা হয়েছে। দুরারোগ্য ব্যাধির করাল ভ্রুকুটি যার অশীতিপর শরীরকে যখন তিল তিল করে গিলে নিচ্ছে, এমনই এক সংকটকালে নকশালবাড়ীর সেই ভূমিপুত্রের চিকিৎসার ব্যয়ভার তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকার গ্রহণ করতে চেয়েছিল তিনি তা নির্দ্বিধায় কেবলমাত্র প্রত্যাখ্যানই করলেন না, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন যে, “যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার আজীবন লড়াই-সংগ্রাম, সেই রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যে তাঁর বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়েও মর্মান্তিক”। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন তাই তাঁর মৃত্যু তো জীবনের পরাজয় নয়; মরণের কাছে জীবনের গর্বিত নিবেদন হয়ে ইতিহাসের পাতা জুড়ে জ্বলজ্বল করে থাকবে হ্যাঁ, এই দ্য ফার্স্ট নকশাল-ই হলেন কানু সান্যাল। 

 

কিংবা বালাসন নদীর প্রান্তে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া নির্লিপ্ত শান্তি মুণ্ডা! ১৯৬৭-র সেই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের’ দিনগুলোর কাছে গচ্ছিত রাখা অস্থির সময়কে আগলে রাখতে রাখতে আজ যিনি দীর্ণ, নিঃস্ব, অশীতিপর! তবু তো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা ... আজন্মের বিশ্বাস, হতাশার নির্মম তীরে বিদ্ধ ক্ষীণকায়া আশার অন্তরের স্নায়ুর ঝিলিক। আজও যিনি গর্জে উঠতে পারেন “সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে” ... আবার কোন এক বজ্রনির্ঘোষের কালান্তরি অপেক্ষায়। অথবা ক্ষুদন মল্লিকের মতো নিঃস্পৃহ মানুষরা! বিশ্বাসকে যারা আঁকড়ে রেখেছেন ‘রক্তমনির হারে’! চীনের ‘পিপলস হলে’ মাও সে তুং আর চৌ এন লাই-এর হাতে মেলানো হাতটায় শক্তির অনুভব যে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শক্তির থেকে অনেক গুন বেশী। ভারতবর্ষে ‘ইয়েনান’ গড়ে তুলতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু সেই বজ্রনির্ঘোষের প্রবল শক্তির কাঁধে ভড় করে গড়ে ওঠা হাতটার দিকে চেয়ে ক্ষুদন মল্লিকের মতো মানুষেরা যখন বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ... “বিশ্বাস নষ্ট হয় নাই। মানুষের মুক্তি হবে। শোষণের শেষ হবে”...... রক্তের প্রতিটি বিন্দু যেন এক জায়গায় জড়ো হয়ে আর্তনাদে ফেটে পড়ে। ক্ষোভে, অপমানে, রাগে, দুঃখে। অপেক্ষার পাহাড় যেন প্রবল শক্তিশালী দৈত্যের মতো আগলে থাকে মুক্তির দরজা। আর এক বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের শব্দের প্রতীক্ষায় কান পেতে     

 

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


২০১৭ সাল ছিল নকশালবাড়ী আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ ছিল এবং ২০১৮ ছিল চারু মজুমদারের জন্ম শতবার্ষিকী! এই পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা কখনই বুঝতে বা বোঝাতে চাইনি
, পরবর্তী প্রজন্মেকে জানাতেও চাইনি ... কে ওই চারু মজুমদার? কেই বা কানু সান্যাল? জঙ্গল সাঁওতালই বা কে? নকশালবাড়ী আন্দোলনই বা আদতে কি ছিল? কেনই বা তা বজ্রনির্ঘোষের মতো আছড়ে পড়েছিল? কোথায় ছিল তার আঁতুড় ঘরের নাড়ি? সেই আন্দোলন কিই বা কেড়ে নিল এই সমাজজীবন থেকে? কতটুকুই বা দিয়ে গেল এই সমাজজীবনকে? আজকের যুব সমাজকে আমরা জানিয়ে দিতে পারিনি সেই রক্তক্ষয়ী ‘কালবেলা’র কতটাই বা সাদা আর কতটাই বা কালো ছিল সেই আন্দোলন কতটাই বা আমাদের পথ আটকালো, কতটাই বা পথ দেখালো। আমাদের ডিজিটাল হাতে সেইসব কাঁটাছেঁড়ায় যাওয়ার মতো কতটুকুই বা সময় আছে স্মার্ট ফোনের গোগ্রাসকে অগ্রাজ্য করে! ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন সাইটগুলোতে কতবারই বা আজ পর্যন্ত টাইপ করা হয়েছে ‘নকশালবাড়ী’ শব্দটা! 

তাহলে, খতম লাইনের কুখ্যাত বীজটা কি প্রোথিত হয়েই রইলো আমাদের সমাজজীবনের গর্ভগৃহে? নাকি আমাদের এই নাগরিক সমাজ মুল্য দিতে চাইলো সেই সকল অদম্য প্রাণগুলোকে, যাদের মায়ের প্রেতাত্মা আজও খুঁজে চলেছে হাজার হাজার লাশের স্তূপের মাঝখানে ‘হাজার চুরাশি নম্বর’ লাগানো তাঁর দামাল ছেলের দলা পাকানো লাশটা? আজ এই ডিজিটাল দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের কারো কি কখনো মনে হয়েছে যে, ঐ একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যেখানে বাঙালি মনন হয়তো শেষবারের মতো ‘আমাদের’ নিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল! ব্যক্তিগত সীমারেখাকে অতিক্রম করে, সমষ্টিগত ভাবনার তরে। পরবর্তী সমাজজীবন তো শুধু ‘আমি’ নিয়েই তোলপাড়! সেদিনের সেই অস্থির সময় কি আমাদের দিয়ে গেল শুধুই খতম লাইনের দুঃস্বপ্নের ইতিহাস? শুধুই আবেগসর্বস্ব বজ্রমুষ্টির দিশাহীন আস্ফালনের ব্যর্থ প্রয়াসের ‘কালবেলা’? নাকি কোথাও আমরা শুনতে পেয়েছি অদম্য সাহসের কাঁধে হৃদয় গচ্ছিত রেখে উদ্দাম যৌবনের ‘হোক কলরব’-এর ঐকান্তিক কলতান?  সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সমাজের পিছিয়ে পড়া শোষিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার প্রয়াসে সাম্যের সংগ্রামে। আজ আমাদের হাতে আদৌ ভাববার মতো সময় আছে কি? জীবনের মূল্যবোধ। রাজনীতির নীতিকথা। সমাজজীবনের সহমর্মিতা। নাকি সব খুঁইয়ে আজ আমরা একে একে সকলে এসে জড়ো হয়েছি আত্মকেন্দ্রিকতার আস্তাকুঁড়ে!  

 

সমকাল কখনো ‘এই সময়কে’ সঠিক মূল্যায়ন করতে শেখেনি। কিন্তু উত্তরকাল? উত্তরকালের দায় কিন্তু থেকেই যায়, অতিতের ‘কালবেলা’ নামে খ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) ‘সেই সময়কে’ লাশকাটা ঘরে চিরে তার ডিএনএ-এর প্রকৃত নির্যাস খুঁড়ে বের করার। সমাজের তরে। সমাজজীবনের তাগিদে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে অবিকৃত ইতিহাসের পাতা অক্ষত রাখার স্বার্থে। উত্তরকালের যে বড় দায় ছিল লাশকাটা ঘরে পুরে সময়কে ছিন্নভিন্ন করার!  

   

 

ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ । এই অ্যাকাডেমিক পরিচয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তিনি এমন একজন লেখক যিনি সময়ের রোজনামচাকে লেখকজীবনের আঙ্গিকে সাজিয়েছেন । তিনি নিয়মিত নানা দৈনিক সংবাদপত্রে, যেমন - আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান একদিন ও পুবের কলম ইত্যাদি, লিখেছেন, লিখে চলেছেন বহু মূল্যবান সমাজ-দলিল । বিবক্ষিতর পাতায় এটি তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ।