লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
![]() |
Source: Internet |
লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
![]() |
Source: Internet |
লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
![]() |
ছবিঃ ইন্টারনেট |
চলচ্চিত্র পরিচালনায় শুধু মেধা বা চিন্তাশক্তিই নয়, দরকার হয় শারীরিক শ্রমেরও। বয়সের কাছে মাঝে মাঝে হার মানতে হলেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মনে করতেন, একজন পরিচালক কখনও অবসর গ্রহণ করেন না। আজ তিনি চলে গেলেন চির অবসরের দেশে। ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি( দ্য কন্টিনেন্ট অফ লাভ) দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন বুদ্ধদেব।অর্থনীতির ছাত্র(স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং শিক্ষক(বর্ধমান ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) হওয়ায় ভারতীয় আর্থ সামাজিক অবস্থার বিস্তর দূরত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত আর্থ সামাজিক অবস্থার তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে, মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার করেন তিনি।
অন্য সব বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর একটা মৌলিক তফাৎ ছিল। তিনি কখনও কোনও নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে ছবি তোলেননি।তাই তাঁর ষাটের দশকের নির্মানগুলি আজও আধুনিক। সময়ের সঙ্গে বদলানো ভাবনার ছোঁয়া লেগেছে তাঁর প্রায় সব ছবিতেই। সত্যজিৎ, মৃনাল, ঋত্বিকের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি একধরনের যথেচ্ছাচারে বিশ্বাসী। আমি খারাপ অর্থে যথেচ্ছাচার বলছি না। ক্রিয়েটিভ হওয়া দরকার, এটা না হলে ওই চারপাশের ট্র্যাডিশন মধ্যেই আটকে পড়তে হয়।" এই উক্তির যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর তোলা 'গৃহযুদ্ধ', 'কালপুরুষ','ফেরা', 'উড়োজাহাজ' - প্রভৃতি ছবিতে। তিনি নিজের চিন্তা শুধু নয় চেতনাকেও মেলে ধরতেন তাঁর ছবিতে, নির্ভীকভাবে। তাঁর প্রবলপ্রতাপ পূর্বসূরিদের মত শুধু বাস্তবতাকে ভর করে তিনি হাঁটেন নি, সঙ্গী করেছিলেন মানবমনে লুকিয়ে থাকা দিবাস্বপ্নগুলোকেও।
যেখানে মানুষ কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মন খুলে ঘুরে বেড়াতে পারে। তাঁর ছবি ছিল স্বপ্ন,জাদু ও বাস্তবতার এক অদ্ভুত মিশেল।স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন তিনি, চেয়েছিলেন বাস্তবতার মাঝেই বেঁচে থাকুক আমাদের স্বপ্নরা। ২০১৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর শেষ ছবিতে (উড়োজাহাজ) তিনি শিল্পের স্বপ্নের কথা বলেছেন।ওই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন একজন শিল্পীর স্বাধীন চিন্তাভাবনায় কিভাবে হানা দেয় শাসক গোষ্ঠীর প্রভাব। একটা এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি নিয়ে তৈরি এই ছবি অবশ্যই পুরোটা বাস্তব নয়। তাঁর এই বাস্তব ও জাদুর মিশ্রন তিনি রপ্ত করেছিলেন এই কারণে যে কবিতা থেকে শুরু করে শিল্পের নানা গলিতে তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। ষাটের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি তিনি।তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে অন্যরকম ঘ্রাণ, তেমনই তাঁর ছবিতে রয়েছে অন্য স্বাদ। তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব কথনভঙ্গি দরকার। এই উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল কবিতা লিখতে গিয়ে। সমাজের চলমান অবক্ষয়ী মনোভাবের প্রতি বারবার গর্জে উঠেছে তাঁর ছবি ও কবিতা।
বুদ্ধদেব ভালোবাসতেন চ্যাপলিন, কুরসওয়া, ডি সিকা, আন্তোনিয়নি ও তারকেভস্কির ছবি। বাস্তবধর্মী ছবির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিতের কাছে। নিজের সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, "আসলে আমি খুব প্যাশনেট মানুষ।সিনেমাকে পাগলের মত ভালোবাসি। আমি প্রেমে ডুবে থাকা একজন মানুষ।এই প্রেম কবিতার জন্য, সিনেমার প্রতিও।" তাঁর 'কালপুরুষ' ছবিতে দেখান নায়কের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক এতটাই হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল যে বহু মানুষ তাঁকে ফোন করে তাঁদের বাবার কথা বলতেন, আর কাঁদতেন, কথা বলতে বলতে রাত গড়িয়ে যেত।তাঁর কোনও ছবিই আত্মজীবনীমূলক নয় , তবে তাঁর জীবনমিশ্রিত অনুভূতির ছোঁয়া থাকত তাঁর ছবিতে, যেমন 'বাঘ বাহাদুর'। ছোটবেলার কয়েকটা বছর তিনি কাটিয়েছিলেন একেবারে বাঙালি সংস্কৃতির বাইরে তেলেঙ্গা জাতির সঙ্গে। এই তেলেঙ্গারা বাঘের মত সেজে, নাচত, গাইত, উৎসব করত। সেই ধারণা থেকেই নির্মিত হয় 'বাঘ বাহাদুর'।
তাঁর সিনেমা চিন্তা এই উপমহাদেশেই সীমিত ছিল না, বিশ্ব সিনেমায় তিনি রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সিনেমা তাঁর কাছে ছিল ক্ষুধার মত। ক্ষুধা নিবারণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দৌড়ে বেড়াতেন।সিনেমা তৈরির এই অদম্য ক্ষুধা তিনি বজায় রেখেছিলেন তাঁর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের যাত্রা জুড়ে।বুদ্ধদেব অর্জন করেছিলেন বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার।খুব কম বাঙালি তাঁর মত এত পুরস্কার পেয়েছেন। সেরা নির্দেশক, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা চলচ্চিত্রকার, এসবের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন সমালোচকদের পুরস্কার। সেই সব আজ শুধুই স্মৃতি। থেকে যাবে তাঁর কাজ।
![]() |
শোভনলাল চক্রবর্তী |
লিখেছেন
আ বি র্ভা ব ভ ট্টা চা র্য
সেইসব চিত্রমালা অখণ্ড আয়ুর মতো জেগে বসে আছে
নিদ্রামগ্ন পর্বতের গোপন গুহায়
আর তাকে ঘিরে আছে প্রণয় বাতাস।
ক্ষয়গুলি বয়ে যায় নদীর ঘনিষ্ট স্রোতপথে।
নিজে নিজে নিঃস্ব হয়ে ফিরে চলে আসা
যতটা সহজ বলে ভাবা হয়ে থাকে
ঠিক তত অনায়াসে
স্রোতপথে কামনা ভাসানো
সহজ কথা না।
রিপু, তুমি কাগজের নৌকা!
সেইসব চিত্রমালা ছায়া দিক তোমার প্রবাহে!
পর্বত ও নদীখাতে
এই মর্মে করুক ঘোষণা—
নিজেকে নিঃস্ব করে কাগজ নৌকায়
সর্বস্ব ভাসিয়ে দেওয়া
সহজ কথা না!
লিখেছেন
স ন্মা ত্রা ন ন্দ
![]() |
ছবি ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ |
গল্প, উপন্যাস মুখ্যত কল্পনার সৃজন। কিন্তু কল্পনার সৃজন
হলেও সে-কল্পনা বাস্তববিমুখ আকাশকুসুম কল্পনা
নয়। সেই সৃজনশীল কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো বিরোধ নেই। বাস্তব পৃথিবী
থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কল্পনায় তাদের সাজিয়ে তোলেন গল্পকার। অবশ্য এই সূত্রে একটা
কথা বিশেষভাবে বলে রাখা দরকার। সেই কথাটি হচ্ছে এই: বাস্তবতার সংজ্ঞা ও পরিসরও
কিন্তু ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন। শিশুর কাছে রূপকথার জগতই বাস্তব, যোগী বা
মিস্টিকের কাছে তাঁর ভাব-জগতই বাস্তব, আবার আমার আপনার মতো মানুষের কাছে এই আটপৌরে
সংসারের টুটা-ফাটা ছবিটাই বাস্তব। শিকারির কাছে শিকার ধরার আনন্দই বাস্তব,
শিকারের কাছে শিকারির তির এড়িয়ে সভয়ে পালিয়ে যাওয়াই বাস্তব। এখন গল্পকার কোন ধরনের
বাস্তবতা থেকে তাঁর কাহিনির উপাদান গ্রহণ করবেন কিংবা কোন ধরনের বাস্তবতা থেকে
কাহিনির উপাদান তাঁর সংগ্রহ করা উচিত, সে-ব্যাপারে কোনো অমোঘ নির্দেশ দেওয়া সঙ্গত
হবে না কারও পক্ষেই। তেমন নির্দেশ দেওয়া খুবই অহংকারী মনের কাজ হবে। কথাকার কোন
বাস্তবতা থেকে তাঁর কাহিনির উপাদান চয়ন করবেন, সেটি নিতান্তই নির্ভর করছে কথাকারের
মানসিক প্রক্রিয়া ও স্বাধীন অভিরুচির উপর। সচেতন পাঠক ইচ্ছে করলে লেখকের সেই
মানসিক প্রক্রিয়া বা অভিরুচি কীদৃশ, তা
নিয়ে তলিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। তাতে লাভ হবে এই যে, লেখকের সাহিত্যভুবনটিকে আরও
একটু চিনে নেওয়ার একপ্রকার আন্তরিক প্রয়াস অন্তত করা যাবে।
কথাসাহিত্যে ‘ঐতিহাসিক কাহিনি’-অভিধায় পরিচিত এক বিশেষ
শ্রেণির রচনা রয়েছে। এই ধরনের গল্পও বস্তুত সৃজনশীল কল্পনা থেকেই উৎসারিত হয়, যদিও
সেই কল্পনা ইতিহাসবিরোধী হয়ে উঠলে চলে না। এসব গল্প ইতিহাসকে ‘আশ্রয়’ করে, কিন্তু
ইতিহাস তার ‘বিষয়’ নয়। গল্পকার পাঠককে যে-অনুভূতিতে পৌঁছে দিতে চান এসব গল্পে, সেই
অনুভূতি বা বোধ-ই এসব গল্পের বিষয়। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে ‘আশ্রয়’ হল সেটিই,
যার উপর সমস্ত দিক থেকে আখ্যায়িকাটি নির্ভর করে। আর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে ‘বিষয়’
হচ্ছে সেটিই, যা বিশেষভাবে পাঠকের কান্তিময় মনকে কাহিনির সঙ্গে বেঁধে দেয়।
ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্য দিয়ে লেখক পাঠককে যা দেখিয়ে দিতে চান, যা পাইয়ে দিতে চান,
সেই বোধ বা অনুভূতিই এসব কাহিনির বিষয়। সেই বিষয়ে পৌঁছোনোর জন্য লেখক এজাতীয়
কাহিনি রচনার কালে ঐতিহাসিক কোনো পটভূমিকার উপর নির্ভর করেন মাত্র।
ঐতিহাসিক গল্প বা উপন্যাস ফিকশনাইজড হিস্ট্রি নয়। ঐতিহাসিক
গল্প বা উপন্যাস আসলে হিস্টোরিকাল ফিকশন। এখন প্রশ্ন হল, ইতিহাসের বয়ানও কি
একরকমের? যদি একরকমের হত, তাহলে ঐতিহাসিকদের ভিতর
এত মতভিন্নতা থাকত না কিংবা ইতিহাসের এতগুলো স্কুল অব থটস গড়ে উঠত না। একেক ঐতিহাসিকের আছে
একেকরকম বয়ান। সেই ভিন্নতা শুধু ঘটনার ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য নিয়েই নয়, ঘটনার
বিবরণেও ভিন্নতা রয়েছে ইতিহাসের নানান
স্কুলের নানান বয়ানে। এবং সেই বয়ানগুলির প্রতিটিতেই যথেষ্ট যুক্তি লক্ষ করা যায়।
সেক্ষেত্রে ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনি যিনি লিখছেন, তিনি কোন বয়ানটিকে অসন্দিগ্ধ চিত্তে
গ্রহণ করবেন?
এখানেও জড়িত থাকে লেখকের অভিরুচি ও রুচির প্রশ্ন।
ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পের কথাকারের দায় নেই অভ্রান্ত ইতিহাস রচনার। কারণ, তিনি ইতিহাস
লিখতে বসেননি। ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছেন কেবল তাঁর গল্পের বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার
জন্য একটি উপযুক্ত আবহ রচনার তাগিদে। তাঁর অভিরুচি অনুযায়ী যথাসম্ভব মান্য
বয়ানটিকেই তিনি একাজের জন্য বেছে নেন— যদি সব কিছুর পরে সাহিত্যরচনাই তাঁর মুখ্য
উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, যদি কোনো বয়ানবিশেষের প্রতি আনুগত্যপ্রদর্শন তাঁর সাহিত্যরচনার
প্রধান অভিপ্রায় না হয়।
কোনো না কোনো সামাজিক আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ইতিহাসের
এইসব বয়ান আবিষ্কৃত ঘটনাসমূহের লিপিবদ্ধ নথি হয়ে ওঠায় (এমনটাই হওয়া উচিত, তা
কিন্তু বলছি না), সেই নথিতে অন্তর্ভুক্ত বহু ঘটনার মধ্যে ফাঁক দেখা যায়। তথ্যের
অপ্রতুলতা তার একটা কারণ। বহু ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না নানা অনুমান প্রয়োগের
পরেও। ওই ফাঁকগুলো ইতিহাসাশ্রয়ী কথাকারের পক্ষে স্বর্ণখনিস্বরূপ। ইতিহাসের কোনো না
কোনো মান্য বয়ানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ থেকে কিংবা মোটামুটিভাবে অবিরোধী থেকে
লেখকের সৃজনশীল কল্পনা ওই সব ফাঁকের ভিতর দিয়েই স্বাধীনতার আকাশ খুঁজে পায়। রচিত
হয় ইতিহাসাশ্রয়ী একেকটি কাহিনির স্মৃতিধার্য আদল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রণীত ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনিগুলির
ক্ষেত্রে উপরের আলোচনা কম বেশি প্রযুক্ত হতেই পারে। দেখা যাবে, ইতিহাসাশ্রয়ী
কাহিনি রচনায় বিভূতিভূষণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কোনো চরিত্রকে তাঁর
গল্পের মুখ্য আশ্রয় করে তোলেননি। ইতিহাস তাঁর কাহিনির চালচিত্র রচনা করেছে মাত্র। সেই ঐতিহাসিক
চালচিত্রে তিনি যাঁদের কাহিনি লিখেছেন, তাঁরা আমার আপনার মতই সাধারণ মানুষ। অন্তত
বেশিরভাগ গল্পেই তাঁরা কেউ ইতিহাসপ্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব নন। দুয়েকটি ব্যতিক্রম
অবশ্যই আছে। তাঁর ‘শেষ লেখা’ গল্পে প্রধান
চরিত্র বুদ্ধ, কিংবা ‘নব বৃন্দাবন’ গল্পে কবি কর্ণপুর, ‘প্রত্নতত্ত্ব’তে অতীশ
দীপংকর। কিন্তু এ ধরণের উদাহরণ সংখ্যায়
কম। আর একথাও মনে রাখতে হবে যে, বুদ্ধের তুলনায় কর্ণপুর বা দীপংকর অনেক কম আলোচিত
চরিত্র। বস্তুত তাঁর ঐতিহাসিক গল্পের সিংহভাগ জুড়ে আছে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় সাধারণ
মানুষেরই রোদন-বেদন, প্রণয়-বিরহ, উল্লাস-পরিতাপের আখ্যান। এই বৈশিষ্ট্য এতটাই প্রবল
যে, পড়তে পড়তে মনে হয় এসব গল্প কোনো দূর কালের ছবি নয়, এরা যেন আমাদেরই কালের কোনো
না কোনো আখ্যান, যেন আমাদেরই জীবনপথের পরিচিত ধুলো আর ফেনা দিয়ে গড়া এদের
অবয়ব।
তাই যদি হল, তাহলে আদৌ ইতিহাসের আশ্রয়ে এসব কাহিনি রচনা
করতে গেলেন কেন বিভূতিভূষণ? তাঁর বক্তব্য তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তাঁর অতি
প্রসিদ্ধ ‘হিঙের কচুরি’ বা ‘অরন্ধনের নিমন্ত্রণ’-এর মতো অজস্র বহুবন্দিত,
সাম্প্রতিক কালের পটভূমিকায় রচিত, উচ্চ মানের গল্পের মধ্য দিয়ে। আদৌ কেন লিখতে গেলেন
বিভূতিভূষণ ইতিহাসাশ্রয়ী আখ্যানসমূহ? এই জরুরি প্রশ্নটির একটা সম্ভাব্য উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করতে পারি আমরা এবার।
গল্প কেমন করে আসে গল্পকারের কাছে? কিংবা গল্পকার কেমন করে
গল্প পান তাঁর মনোলোকে? সেই মানসিক প্রক্রিয়াটিকে প্রথম প্রথম গল্প লিখতে এসে
চিনতে পারা যায় না। কিন্তু বেশ কিছু গল্প লেখা হয়ে যাওয়ার পর গল্প আসার সেই মানসিক
প্রক্রিয়ার একটা অস্পষ্ট আদল গল্পকার টের পেতে শুরু করেন। কেমন একটা আবছা ছাপছোপ,
কয়েকটা আলগোছে বলা কথা কারও, শেষ না হয়ে থমকে যাওয়া কোনো সুর, দিনানুদৈনিক
অভিজ্ঞতার ঢেউ ভেঙে জেগে ওঠা ক’টা ছবি কিংবা একেবারেই নিরবয়ব কোনো থমকে থাকা
চিন্তা, এইসব বা আরও অন্য কিছু মনের ভিতর
জেগে উঠে গল্পকারকে টেনে নিয়ে যেতে চায় অতল জলের দিকে। এমন যখন হয়, গল্প লেখার
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখক টের পান একটি গল্প আসছে, ‘তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে
ঝিলমিল’ এক আশ্চর্য ভুবনের দিকে টিলাপাহাড় পেরিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হয়
গল্পকারকে, তখনও তিনি জানেন না কোথায় তিনি চলেছেন...কিছু পরে একটা অব্যর্থ ইশারা
এসে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় নিশিডাকের মতো... সম্মোহিত পদক্ষেপে গল্পকার সেই ডাক শুনে
এগিয়ে চলেন গল্পটির অন্তিম বাক্যটির দিকে, তাঁর আর অন্য উপায় থাকে না।
এই যে মানসিক প্রক্রিয়া গল্প আসার, সেটি গল্পকারভেদে ভিন্ন
ভিন্ন। এবং এই প্রক্রিয়াটিকে সাধারণত গল্পকাররা লুকিয়ে রাখেন মন্ত্রগুপ্তির শপথের
মতো। এবিষয়ে প্রকাশ্যে কখনও মুখ খোলেন না তাঁরা। আসলে এই অভিজ্ঞতাটি গল্পকারের কাছে
এত পবিত্র; আর পবিত্র বলেই তা গোপন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই ক্ষেত্রে
ব্যতিক্রম, এই প্রক্রিয়াটিকে গোপন করে রাখতে হবে এমন অভিনিবেশ তাঁর নেই। সম্ভবত,
তাঁর ক্ষেত্রে যা পবিত্র, তা গোপন হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তিনি অনুভব করতেন না।
ফলত, গল্প লেখার গল্প তিনি লিখেছেন সোজাসুজি, হয়ত তাতে মিশিয়ে দিয়েছেন কল্পনার রঙ।
দিনলিপিতে তিনি লিখে চলেছেন তাঁর গল্প বা উপন্যাসের পরিকল্পনা, ইঙ্গিত দিয়েছেন
কীভাবে গল্প আসে তাঁর কাছে, সেই প্রক্রিয়ারও। সেসব ছাপার অক্ষরে প্রকাশিতও হয়েছে
তাঁর জীবদ্দশায়। তাতে অস্পষ্টতা আছে, আড়ালও আছে কিছু কিছু। কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে
তাঁর গল্প লেখার পদ্ধতির কথা অন্তত একবার তিনি মুখ ফুটে বলেছিলেন একটি
আলাপচারিতায়। সেই পদ্ধতিটিকে বুঝতে গিয়ে
আমরা পেয়ে যাই আমাদের পূর্বে উত্থাপিত প্রশ্নের অন্তত একটা মোটামুটি সন্তোষজনক
উত্তর—সেই অনুমেয় হেতু; কেন তিনি তাঁর কতগুলি গল্পে মানবসম্পর্কের আয়াতটিকে ধরতে
চেয়েছেন ঐতিহাসিক পটভূমিকায়— তারই একপ্রকার সম্ভাব্য কারণ।
ওই আলাপচারিতাটি ধরা আছে একটি বইতে। বইটি হিন্দি ভাষায়
রচিত। বইটির নামঃ ‘পথের পাঁচালী কে বিভূতিবাবু’। লেখক যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। মূল
হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ড. তারাপদ ভৌমিক। অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছে ‘বাঙলার
মুখ’ প্রকাশনী থেকে। জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও বাঙালি সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা
বিভূতিভূষণের এই ঘনিষ্ঠ অনুরাগী যোগেন্দ্রনাথ সিংহ ছিলেন ঘাটশিলায় ডিভিশনাল
ফরেস্ট অফিসার। প্রথম দর্শনে তিনি
বিভূতিভূষণকে একজন সাধারণ মানুষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রকৃত পরিচয় তখনই
পাননি। পরে ধীরে ধীরে পরিচয় প্রগাঢ় হলে তিনি বিভূতিভূষণের প্রকৃত পরিচয় পান। বইটি
সেই বিভূতিসান্নিধ্যেরই স্মৃতিলিপি। নানাবিধ কারণেই বইটি বিশেষ মূল্যবান, এখানে
কিন্তু আমরা আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে যাব বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে, যেখানে
জিজ্ঞাসু যোগেন্দ্রনাথকে বিভূতিভূষণ গল্প লেখার পদ্ধতির কথা বলেছেন।
এই প্রসঙ্গে বইটির ৩৮-৪৪ পৃষ্ঠায় বিভূতিভূষণ গল্পসাহিত্যের
অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ কতগুলি কথা সূত্রাকারে বলেছেন, যার থেকে তাঁর মনে গল্প
কেমন করে আসত, সেই মানসিক প্রক্রিয়ার হদিস পাই। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য
প্রাসঙ্গিক অংশটুকু এখানে উৎকলন করব। বিভূতিভূষণ বলছেনঃ
“আধুনিক গল্প অনুভূতি আর কল্পনার প্রতিমূর্তি মাত্র। অনুভূতি যত গাঢ় হবে, কল্পনা যত তীক্ষ্ণ হবে গল্প ততই সফল হবে। এতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, যে বিষয় নিয়ে আপনি লিখছেন সে বিষয়ে আপনার পুরো জ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকা চাই। ... যে ভাবনাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি গল্প লিখতে বসবেন তাকেই মোমেন্ট বা চরম অনুভূতি বলে। এই জন্যই প্রত্যেক গল্পের একটি মোমেন্ট থাকা দরকার। এই মোমেন্টই আপনার গল্পের হাল বা পথনির্দেশক। বাস্তবিক পক্ষে এই বলা যায় যে, এই মোমেন্টই আপনার গল্পের স্রষ্টা। মোমেন্ট আপনার (অর্থাৎ নিজের) দরকারে পাত্রপাত্রী গড়ে নেয় ও ঘটনাকে আবিষ্কার করে। গল্পে সেই পাত্র ও ঘটনার স্থান থাকবে যা সেই মোমেন্টকে মূর্ত করতে সহায়তা করবে। সেই জন্য গল্পে পাত্র ও ঘটনাকে পরিবেশন করার আগে ভেবে দেখতে হবে যে এরা মোমেন্টের কোন অংশকে পূর্ণ করছে। পাত্র যতই ভালো হোক, বিষয়বস্তু যতই বিলক্ষণ হোক, তারা যদি চরম মোমেন্টের কোনো অঙ্গই পূরণ করতে না পারে তবে তাদের থাকা নিরর্থক।”
লক্ষ করুন, বিভূতিভূষণ এখানে বারবার ‘মোমেন্ট’ শব্দটি
ব্যবহার করছেন। এই ‘মোমেন্ট’এর বাংলা অনুবাদ মুহূর্ত নয়। এটি আসলে সনাতন বলবিদ্যা
বা ক্লাসিকাল মেকানিকসের পরিভাষা। এই ‘মোমেন্ট’এর অর্থ হচ্ছে ‘the product of a force and
the perpendicular on its line of action from the point of application.’ যাঁরা পদার্থবিদ্যার পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁদের জন্য সহজ করে এই ‘মোমেন্ট’
শব্দের অনুবাদ করা যেতে পারে ‘ভ্রামক’। অর্থাৎ যা বস্তুকে গতি দেয়,
প্রেরণা দেয়, তাকেই এখানে ‘মোমেন্ট’ বলা হয়েছে। এই মোমেন্ট থেকেই গল্পটি মোমেন্টাম
বা ভরবেগ পায়। বিভূতিভূষণ বলেছেন, ‘যে ভাবনাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি গল্প লিখতে
বসবেন তাকেই মোমেন্ট বা চরম অনুভূতি বলে।’ অর্থাৎ গল্প আসার প্রাক্লগ্নে লেখকের
মনে যে বস্তুটি এসে পৌঁছোয়, তা হচ্ছে একটি বিমূর্ত ভাবনা বা অনুভূতি। একেই ‘মোমেন্ট’
বলা হচ্ছে। এই বিমূর্ত প্রেরণা বা মোমেন্টকে প্রাণবন্ত ও মূর্ত করে তোলার জন্যই
গল্পের অবতারণা।
শুধু এটুকুই নয়। এর পর বিভূতিভূষণ যোগেন্দ্রনাথ সিংহের কাছে
তাঁর নিজেরই লেখা দুটি গল্পের রীতিমতো কেস স্টাডি করে দেখিয়েছেন, তিনি ‘মোমেন্ট’
বলতে কী বোঝাচ্ছেন, ওই দুটি গল্পের ‘মোমেন্ট’ কী ছিল এবং ওই গল্প দুটি তাদের ওই ‘মোমেন্ট’-কে কীভাবে এবং
কতটা মূর্ত করে তুলতে পেরেছে। এর মধ্য থেকে শুধু দ্বিতীয় গল্পটি ‘কিন্নর দল’-এর
মোমেন্ট কী ছিল এবং সেই মোমেন্ট কীভাবে গল্পটির পরিবেশ, চরিত্র ও আখ্যানভাগকে
স্থির করে দিয়েছে বা এককথায় গল্পটিকে সর্বার্থে নিরূপণ করেছে, তা খুব সংক্ষেপে
বলতে চাইছি। পাঠক একবারের জন্যেও যেন না ভাবেন, আমরা ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি।
এই আলোচনাটুকুর বড়ই প্রয়োজন শুধু সেই প্রশ্নটির উত্তর দেবার জন্যই; কেন বিভূতিভূষণ
তাঁর বিশেষ এক ধরনের গল্পে আমাদের
দিনানুদৈনিক সুখ-দুঃখ, রোদন-বেদন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা লিখবার জন্য ঐতিহাসিক
পটভূমিকার আশ্রয় নিয়েছেন? শুধু সেই উত্তরটুকু বের করবার জন্যই এই আলোচনার বিশেষ
প্রয়োজন। অতএব, হে পাঠক! হে পাঠিকা! অনুগ্রহ করে আর সামান্য ক্ষণ ধৈর্য ধারণ
করুন।
এলাহাবাদ সঙ্গীত সম্মেলনে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ গাইবেন।
বিভূতিভূষণ ছিলেন শ্রোতার আসনে। মাঝরাতে ফৈয়াজ খাঁ ভৈরবী রাগিনীর আলাপ আরম্ভ
করলেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। একজন বলেই ফেললেন, ভৈরবী তো ভোরের রাগিনী।
ওস্তাদজি! আপনি মাঝরাতে ভৈরবী ধরলেন কেন? স্মিতহাস্যে ফৈয়াজ খাঁ বলেছিলেন, আপনাদের
কথা ঠিক। ভৈরবী ভোরেই গাওয়া নিয়ম। কিন্তু মাঝরাতে ভৈরবী গেয়ে যদি শ্রোতাদের মনে ভোরের ছবি
তৈয়ার করতে না পারি, তবে আমি কীসের ওস্তাদ? এরপর সেই মধ্যরাত্রে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর
কণ্ঠনিঃসৃত ভৈরবী রাগিনী শুনে শ্রোতাদের সত্যিই মনে হয়েছিল, ভোর হয়ে গেছে।
সঙ্গীতের প্রভাবে মানুষের মন প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বাস্তবকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণ
ভিন্ন বা একেবারে বিপরীত অবস্থায় চলে যেতে পারে, এটি বিভূতিভূষণ সেদিন নিজে
সাক্ষাৎ অনুভব করেছিলেন। এই অনুভবটিই তাঁর ‘কিন্নর দল’ গল্পের মোমেন্ট বলে তিনি
জানিয়েছেন।
সেই মোমেন্টের প্রেরণায় তাঁর মনের মধ্যে ফুটে উঠল পাড়াগাঁর
এক গণ্ডগ্রাম। যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ কূপমণ্ডূক, কেচ্ছাপ্রিয় ও কুচুটে। সেই
গ্রামের ছেলে শ্রীপতি, পশ্চিমে চাকরি করে। কালেভদ্রে তারা গ্রামে আসে। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সে শ্রীপতি
বিয়ে করে ও বউ নিয়ে গ্রামে আসে। বউয়ের বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, সেকালের পক্ষে মেয়ের
বিয়ের বয়স হিসেবে সেটা বেশিই, উপরন্তু মেয়েটি শ্রীপতিদের থেকে তুলনায় নিম্নজাতীয়।
এ নিয়ে পাড়ার মেয়েমহলে গালমন্দ, পরচর্চা ও পরনিন্দার বান ডাকে। পরে মেয়েটিকে
চাক্ষুষ দেখে ধীরে ধীরে এই নিন্দামন্দ স্তিমিত হতে শুরু করে। মেয়েটি সুশ্রী এবং
তার মিষ্টি ব্যবহার। সে খুবই গুণী মেয়ে, এস্রাজ বাজিয়ে গান করে। এই শ্রীপতির বউয়ের
চরিত্রপ্রভাবে এবং তার গানে ক্রমশ পাড়াগাঁর বউ-ঝিরা প্রভাবিত হয় এবং তাদের
স্বভাবসিদ্ধ পরশ্রীকাতরতার ভাব পাল্টাতে শুরু করে। গাঁয়ের শান্তি ও কমলা নামের
দুটি মেয়ে বউদিদির অত্যন্ত ন্যাওটা। শ্রীপতির বউ কিন্তু কাউকে বলেনি তার আসল
পরিচয়। সে কলকাতার একজন গুণী সঙ্গীতশিল্পী। শান্তির বিয়ে হয়ে যায় অন্য গ্রামে
কিন্তু তার বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। ইতোমধ্যে শ্রীপতির বউ কলকাতায় যায় এবং
অসুস্থ হয়ে সেখানে মারা যায়। তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গাঁয়ের মেয়েবউরা খুবই
শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে শান্তিও শ্বশুরবাড়ির বিড়ম্বনায় বিব্রত হয়ে নিজ গ্রামে
ফিরে আসে। তারপর একরাত্রে শ্রীপতি গ্রামের
বাড়িতে ফিরে এসে গ্রামাফোন রেকর্ডে শ্রীপতির বউয়ের শেষ গাওয়া একটি গানের
রেকর্ড বাজায়। গ্রামের মেয়েরা নৈশ আবহে বসে সেই গান শুনতে পেয়ে অবাক হয়ে যায়—মনে
হয় শ্রীপতির বউ আবার তাদের মধ্যে ফিরে এসেছে। শান্তির মনে হয়, ফিরে এসেছে তার
আইবুড়ো বেলার সুখের মুহূর্তগুলি। তাদের সকলের সময় ভুল হয়ে যায় গানের প্রভাবে এবং
কিছুক্ষণের জন্য তাদের মন স্বভাবসিদ্ধ সঙ্কীর্ণতা থেকে উত্তীর্ণ হয় এক অন্যতর
ভুবনে।
এই হচ্ছে মোমেন্ট আর এই তার ফলীভূত গল্প। এই মোমেন্টটিই
গল্পটিকে গড়ে নেয় একটি বিশেষ আবহে, নির্মাণ করে একের পর এক চরিত্র, বয়ন করে গল্পের
আখ্যানভাগ ও সংলাপ। বিমূর্ত ভাবনাটি মূর্ত হয়ে ওঠে গল্পটির ভিতর দিয়ে।
এখন ওই মোমেন্ট বা প্রাথমিক বিমূর্ত ভাবনাটি যদি
প্রকৃতিগতভাবেই এমন হয়, যার যথাযথ বিকাশ একালের পটভূমিকায় একেবারেই সম্ভব নয়? যদি
ওই মোমেন্ট বা বিমূর্ত চিন্তাটিকে মূর্ত করে তুলতে হলে প্রয়োজন পড়ে অতীত কালের
কোনো পরিবেশের বা আবহের, তাহলে তখন সেই কাহিনী ইতিহাসাশ্রয়ী না হয়ে পারে না।
অত্যধিক শাস্ত্রচর্চায় মন শুষ্ক হয়, প্রেমের কথা ভুলে গিয়ে
মন বিশুষ্ক জ্ঞানের পথ ধরে। শুকিয়ে যাওয়া সেই মন জীবনের সকল পরমতাকে অস্বীকার করে
ধীরে ধীরে নাস্তিবাদী হয়ে ওঠে। যার ফল বিনাশ। এবং বিনাশের পরে হয়তো বা জীবনের নূতন
আবর্তন, শূন্যতার টিলাপাহাড় পার হয়ে গিয়ে হয়তো পরমতার প্রতি কোনো নবীনতর বিহ্বল
জিজ্ঞাসা উদিত হয়। এই বিমূর্ত চিন্তাটি একটি গল্পের মোমেন্ট বা প্রেরণা।
এই প্রেরণাকে রূপ দিতে গেলে দরকার হয়েছিল অতীত যুগের এমন
একটি পর্বের যখন জিজ্ঞাসা বা নাস্তিকতা ধর্মবিশ্বাসের মতনই পবিত্র এক সুমহান
উচ্চতায় উঠেছিল। দরকার হয়েছিল এমন একটা যুগের যখন কেবলমাত্র জ্ঞানের অন্বেষণের
জন্য সমাজের কোলাহল থেকে দূরে সম্পূর্ণ নির্জন অবস্থায় কোনো তপোব্রতী মানুষ
নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পারতেন। সেই যুগ বৌদ্ধ জৈনদের যুগ, ভারতের প্রাচীন যুগ।
সমকালের আবহাওয়ায় এই মোমেন্ট বিকশিত হতে পারত না। তার বিকাশের জন্যই বিমূর্ত
চিন্তাটি অতীত কালের আবহ বেছে নিয়েছে। বিভূতিভূষণের সেই গল্প ‘নাস্তিক’। এই জন্যেই তা একালের
কোনো গল্প হয়ে উঠতে পারেনি, ইতিহাসাশ্রয়ী গল্প হয়ে উঠেছে।
অতএব প্রকৃতিগতভাবেই কোনো কোনো গল্পের মোমেন্ট এমন যে তা
অতীত কালের আবহ দাবি করে। মোমেন্ট বা
বিমূর্ত প্রেরণাটিই যদি এমন হয় যে যার বিকাশ একালের পরিবেশে ঘটালে তা নিতান্তই
অসম্ভব ঠেকবে, তাহলে একমাত্র সেক্ষেত্রেই ‘মেঘমল্লার’-এর মতো ঐতিহাসিক গল্প সৃজিত
হতে পারে। জ্ঞান ও সৌন্দর্য কামনার দ্বারা
সাময়িকভাবে বশীকৃত হতে পারে; কিন্তু তরুণ চিত্তের আত্মদানের ভিতর দিয়েই সেই
কুক্ষিগত জ্ঞানের মুক্তি ঘটে। হৃদয়াবেগই হৃদয় দিতে উদ্বুদ্ধ করে, প্রাণের সংবেগই
প্রাণদান করতে প্রেরণা জোগায়—প্রেমিকের প্রাণ প্রেমের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে
পাথর হয়ে যেতে পারে এক লহমায়। এই বিমূর্ত চিন্তা বা মোমেন্ট নিজেকে ফুটিয়ে তোলে
তান্ত্রিক বৌদ্ধযুগের পটভূমিকায় ‘মেঘমল্লার’ গল্পে। অন্তিমে বন্দিনী সরস্বতীকে
সম্মোহন থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে প্রদ্যুম্ন পাথর হয়ে যায়। এই যে পাথর হয়ে যাওয়ার
ঘটনা কিংবা এমন চরম আত্মদানের কাহিনি আজকের যুগের পটভূমিকায় বিকশিত হলে, তা
নিতান্ত অসম্ভব ঠেকত না কি? এর জন্যেই দরকার পড়েছে একটা প্রত্ন-আবহের, শত
পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-ধোওয়া অবসিত যুগের চালচিত্রের, যা গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে
তুলতে পেরেছে।
বিজাতীয়ের প্রতি ঘৃণা, স্বজাতীয়দের প্রতি সংকীর্ণ অনুরাগ
ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে পারে সুন্দরের আকর্ষণে। প্রেম নিয়মিত করে দেয় বিশৃঙ্খল
জীবনকে। এতদূর পরিবর্তন আসতে পারে যে, একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ নিজ জাতের
গৌরব পরিত্যাগ করে নতজানু হতে পারে প্রেমাস্পদ বা প্রেমাস্পদার সাংস্কৃতিক বৈভবের
কাছে। এই বিমূর্ত ভাবনা বা মোমেন্টকে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন দুটি ভিন্ন জাতির
পরস্পর সংঘর্ষ এবং সহাবস্থানের কালিক পটভূমিকার। এক গ্রিক যুবক সেখানে এক হিন্দু
রাজকন্যাকে ভালোবেসে প্রেমিকার উপাস্য বিষ্ণুর শরণাগত ভক্ত হয়ে ওঠে। রচিত হয় ‘স্বপ্নবাসুদেব’-এর
মতো একটি ঐতিহাসিক গল্প উপরের মোমেন্টটিকে রূপ দিতে গিয়ে।
যে বিদেশিরা অত্যাচার করতে এসেছিল, কালক্রমে শোষণ ও
লুণ্ঠনের পর তাদের উত্তরপুরুষেরা এ দেশের পলল মৃত্তিকার সঙ্গে মিশে যায়, এদেশের
সংস্কৃতি হয়ে ওঠে তাদেরও সংস্কৃতি। পূর্বপুরুষের রক্তের দাপট আজও ঝাপটা মারে তাদের
শিরায় ধমনীতে, তবু সেই দাপটও শীতল হয়ে আসে ধীরে ধীরে। এই হচ্ছে গল্পের মোমেন্ট, যা
রূপ নেয় ‘নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব’ গল্পে। এ গল্পের পাত্রপাত্রী অতি সাধারণ, তারা
কেউ ইতিহাসপ্রখ্যাত নয় একেবারেই, তাদের রোদন-বেদন আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষেরই
রোদন-বেদন, কিন্তু পশ্চাদ্বর্তী এই মোমেন্টটি এমন যেখানে একটা যুগাবসান দেখাতে
হবে। সাধারণত ঐতিহাসিক গল্পে আমরা যাত্রা করি বর্তমান থেকে অতীতের দিকে,
বিভূতিভূষণের এই গল্পটি কিন্তু যাত্রা করেছে অতীত থেকে বর্তমানের দিকে। সেই
হিসেবেও গল্পটি ঐতিহাসিক গল্পের পর্যায়ে একেবারে ব্যতিক্রমী চরিত্রের।
মানুষ মানুষকে শিকার করে, নিমন্ত্রণের অছিলায় টোপগাঁথা
মাছের মতন মানুষ মানুষকে হত্যা করতে চায়। আবার মানুষই স্নেহের আকর্ষণে বন্দী
মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। মানুষের ভিতর জিঘাংসা ও করুণা দুই-ই আছে। জিঘাংসার
প্রবৃত্তি কখনও বা প্রবল হয়ে উঠে করুণার কণ্ঠরোধ করে। তখন জিঘাংসা চির অভিশাপের
বৈতরণীতে ডুব দিয়ে চলে যায় অবচেতনার গাঢ় অন্ধকারে; সেই প্রেতলোকেই তার
চির-নির্বাসন। এই চিন্তাটিকে গল্পে রূপ দিতে হলে দেখাতে হবে ক্ষমতাদর্পী
স্বেচ্ছাচারী একটা সময়ের। সেই ক্ষমতাদর্পী সময় হতেই পারত সাম্প্রতিক কোনো কাল,
কিন্তু অবচেতনার ওই পাতালঘর, ওই প্রেতলোক বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত হতে হলে
একালের পরিসরে তা আঁটত না। তার জন্যই দরকার পড়েছে বারো ভুঁইয়ার আমল,
ক্ষমতা-করুণা-হননের ত্রিকোণ সম্ভব হতে পেরেছে এক অতিপ্রাকৃত অথচ ঐতিহাসিক
পটভূমিকার ভিতর। ‘অভিশপ্ত’ সেই গল্প।
এ জগৎ প্রলোভনময়। কিন্তু সেসব প্রলোভনের মধ্যেও আছে
উচ্চ-নীচ ভেদ। মানুষ তার বর্তমান অবস্থান থেকে এক লাফে সকল প্রলোভনহীন ভানহীন কোনো
সত্যে আরূঢ় হতে পারে না। তার মনকে আরোহণ করতে হয় ধাপে ধাপে। নিম্নতর প্রলোভনকে জয়
করতে হয় উচ্চতর প্রলোভনের আকর্ষণে। তারপর সে যখন সকল লোভশূন্য, বাসনাশূন্য অবস্থায়
উপনীত হয়, তখন দেখে নিম্ন থেকে উচ্চ সমস্ত প্রলোভনই কল্পিত ছিল, যাকে সে প্রাণপণে
এতদিন সত্য বলে জেনে এসেছে। এই নির্মোহ ভাবনাটি একটি বিমূর্ত মোমেন্ট, যা গতি
দিয়েছে একটি অসামান্য গল্পকে। মোমেন্টটির সমুচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবই লেখককে হাত পাততে
বাধ্য করেছে অলোকসামান্য কোনো চরিত্রের কাছে। সে চরিত্র একালের হতে পারেন না, আবার
একান্তভাবে পুরাকল্পের কোনো পুরুষোত্তমও হতে পারেন না তিনি, কেননা তা হলে তত্ত্বটি
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। এ জন্যেই ইতিহাসপুরুষ বুদ্ধের কাছে গেছেন বিভূতিভূষণ। রচিত
হয়েছে ‘শেষ লেখা’র মতো গল্প।
সাহিত্যিক ও কবিদের ভিতর প্রায়শই নিজ রচনার প্রতি শ্লাঘাবোধ
থাকে। নিজ রচনাকে তাঁরা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতার্থে কালাতিক্রমী
কিছুই হতে পারে না। বিপুল কাল অতিক্রান্ত হলে শ্লাঘনীয় রচনাও বিস্মৃতির অতলগর্ভে
হারিয়ে যায় কিংবা বিকৃতির শিকার হয়। এমনকি মূল রচয়িতার নামটুকুও হারিয়ে যায়
মানুষের মন থেকে অথবা নামমাত্র বেঁচে থাকে পণ্ডিতের স্মৃতিকোষভাণ্ডারে। যদি
বিভিন্ন যুগের প্রখ্যাত কবিকুল কোনো না কোনো উপায়ে একবার ধূসর অতীত থেকে বর্তমান
কালের মধ্যে টাইম-ট্রাভেলের সুযোগ পান, তাহলে আপন
কাব্যগৌরব যে কত হাস্যকর, তা তাঁরা বুঝতে পারবেন। তাঁরা দেখবেন এই
কবিখ্যাতি ইতিহাসের অরণ্যে যজ্ঞডুমুর খোঁজার মতই প্রায় অসম্ভব। ডুমুরকে সংস্কৃত
ভাষায় বলা হয় উদুম্বর। উদুম্বরেরই পাঠভেদ উড়ুম্বর। এই মোমেন্ট বা বিমূর্ত ভাবনাটিকে রূপ দিতে হলে
নানা যুগের চরিত্রদের মধ্যে দেখা করিয়ে দিতে হবে। শুধু একালের গল্প বললেই চলবে না।
ব্যাস, ভাস, কালিদাস, ভবভূতি, বাণভট্ট, গ্যেটে প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন কালের চরিত্রকে
অতএব বিভূতিভূষণ পরস্পরের মুখোমুখি করিয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে নামিয়ে
এনেছেন কলকাতার ‘প্রদীপ’ সিনেমাঘরে,
যেখানে ‘মেঘদূত’ নামে একটা টকি শো হচ্ছে, কালিদাসের মেঘদূত নয়, আজকের কোনো
খ্যাতিমান লেখক অতীন ঘোষের লেখা অন্য কোনো মেঘদূত। সব দেখে তাঁরা মহা বিরক্ত! এই
বিশিষ্ট মোমেন্টটিই বাধ্য করেছে নানা কালসঞ্চারী এক ঐতিহাসিক গল্প রচনায়। সেই গল্প
‘উড়ুম্বর’।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাবে, এই গল্পগুলির চরিত্রসমূহের
প্রবণতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষারাশি আমাদের সময়েও সমানভাবে বহমান। বহু চরিত্র আমাদেরই মতো
সাধারণ। কিন্তু যে সমস্ত ‘মোমেন্টস’ গল্পগুলির ভরকেন্দ্র, তারা এমনই প্রকৃতির ছিল
যে, তাদের রূপদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হলে অতীতকালের পটভূমিকা ব্যবহার করা ছাড়া
লেখকের গত্যন্তর ছিল না। বিভূতিভূষণের অন্য ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পগুলি নিয়েও আলোচনা
করলে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যাত হয় না। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেন বিভূতিভূষণ
ঐতিহাসিক কাহিনি রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, কিংবা সাধারণভাবে কেন একজন লেখক
ইতিহাসাশ্রয়ী আখ্যান রচনায় অভিনিবিষ্ট হন।
পরিশেষে দুটি ‘বলাই বাহুল্য’ যোগ করা দরকার। এদুটিকে
সতর্কবার্তাও বলতে পারেন আপনারা।
প্রথমত, এই প্রবন্ধে বর্ণিত গল্প লেখার পদ্ধতিটি একান্তই বিভূতিভূষণের নিজস্ব পদ্ধতি। তার সঙ্গে অন্য লেখকদের গল্প-লেখার বা তাঁদের কাছে গল্প-আসার মানসিক প্রক্রিয়া এক হতেও পারে, নাও হতে পারে। প্রত্যেক কথাকারের আছে নিজস্ব প্রকরণ, লেখকভেদে তা ভিন্ন হতেই পারে। কেউ যেন বিভূতিভূষণ-বর্ণিত প্রক্রিয়াটিকে একমাত্র অমোঘ প্রক্রিয়া বলে ভুল না করেন।
দ্বিতীয়ত, উপরে যা আলোচিত হয়েছে, তা যদি কোনো পাঠক নাও পড়েন, কিংবা পড়ে ভুলে যান অথবা উপরের আলোচনা পড়বার পর তাকে মনের একপাশে সরিয়ে রেখে বিভূতিভূষণের ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পগুলি পড়তে বসেন, তাহলেও তাদের রসাস্বাদনের পথে অণুমাত্র বাধা তৈরি হবে না, মনে করি। এসব তত্ত্বকথা সাহিত্যামোদীদের বৌদ্ধিক বিলাসের উপকরণ কিংবা গল্পলিখিয়েদের টেকনিকচর্চার উপাদান মাত্র, প্রকৃত পাঠকের তাতে কিছু যাবে আসবে না। বিভূতি-সাহিত্যের মর্মবাণী রয়েছে ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রে। মানবাত্মার যে-জার্নির কথা বিভূতিভূষণ বলেন শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে পরিণত বয়সের দিকে তাঁর ‘পথের পাঁচালী’তে, নাগরিক জীবন থেকে বনেচর জীবনের দিকে তাঁর ‘আরণ্যক’-এ, অতীত থেকে সাম্প্রতিকের দিকে তাঁর ‘ইছামতী’তে কিংবা ইহলোক থেকে পরলোকের দিকে তাঁর ‘দেবযান’ উপন্যাসে, সেই চলার গানই তাঁর ঐতিহাসিক গল্পগুলির মধ্যেও বিধৃত রয়েছে। সেই চলমান জীবনস্রোত এত প্রবল যে, তার প্রবাহপথে আমাদের এসব তত্ত্বকথা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। এই প্রবাহই বিভূতিভূষণের নিজস্ব আধ্যাত্মিকতা। মন যত বড়ো হতে থাকে সেই প্রবাহপথে, ততই তা গ্রহিষ্ণু হয়ে ওঠে, চলার পথের পাশে পড়ে থাকা জীবনের আপাত-তুচ্ছ শাখাপল্লবগুলিকেও পরম মমতায় সেই পথিক দেবতা কুড়িয়ে নেন তাঁর ঝুলিতে। চলতে চলতে পথিপার্শ্ব হতে এই পত্রপুষ্পচয়ন কারও কারও কাছে ‘ফিরে আসা’ মনে হতেও পারে, কিন্তু ফিরে আসা তা নয়, তা এক বিরতিবিহীন অভিযাত্রিকের জীবনসঙ্গীতেরই মীড় বা মূর্ছনা। আমরা যতই কেন না বারবার কাতর কণ্ঠে বিভূতিভূষণের উদ্দেশে বলি, পায়ে পড়ি, ঠাকুর! আমাদের যেন সাম্প্রতিক ইহলোকেই ফেরা হয়...
অজেয় কথাকার বিভূতিভূষণ সহাস্যে উত্তর দেন—মূর্খ বালক, পথ
তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের পরিচিত জীবনের বৃত্তে, তোমাদের ইহসর্বস্বতার ভিতর কিংবা
সাম্প্রতিকের আখ্যানসর্বস্বতায়। তোমাদের তত্ত্বের প্রাসাদ ভেদ করে, অধ্যাপনাকে
বিচূর্ণ করে, তোমাদের মুগ্ধতার অতিসরলীকরণকে পাশ কাটিয়ে, কালের ইতিহাসের খেয়ায়
পাড়ি দিয়ে পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে... ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছেড়ে
ইন্দ্রিয়াতীতের দিকে, বর্তমান ছেড়ে অনাগতর দিকে, জ্ঞাতসত্যের গণ্ডী এড়িয়ে
অপরিজ্ঞাত সত্যের উদ্দেশে...
... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা-ছাতার দলে
ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না...
চল এগিয়ে যাই।
![]() |
সন্মাত্রানন্দ |
Jesbin Skariah Thomas
![]() |
Kerala Covid19 |
Why Kerala, a small state in
India, is getting so much attention in the context of
Covid Management? We know Kerala leads all
other states with regards to human development and any given demographic indicator. The state has the best health care
system with state of the art infrastructure and doctors
accessible to people at the primary level. The doctor-to-patient ratio in Kerala is 25 to 10,000, much, better than the 10:10,000 recommended by the World
Health Organization. Nevertheless, Covid cases in Kerala are on the rise,
though the state’s health department is handling it quite efficiently.
Here, we need to discuss some of the challenges unique to Kerala, not faced by the other Indian states.
- The state's old-age population is more than any other state in the country -- at 14%, it is 5% above the national average living over 60 years. Thus, the elderly with less immunity and high disease burden is undoubtedly the major contributing factor to fatality.
- The state has the highest morbidity burden of lifestyle diseases, with one in every four adults having diabetes and nearly one-third of the adult population suffering from blood pressure.
- Every third household in Kerala has a migrant, and also another 2.5 million guest labourers residing within the state. The steady inflow of international and national migrants poses a serious challenge in containing the virus. During the first wave, the state had achieved ‘zero’ cases reported as the after-effect of lockdown imposed. But since then, it has opened up borders, the consequences of which are reflected in the surge of Covid-positive patients.
- Owing to its high population density (859 per sq km), the probability of any contagious disease spreading rapidly in the state, remains at the upper end of the spectrum.
Despite all these adversities, the
state has proven its mettle in containing the virus and bringing down the
fatality numbers. Therefore, not much chaos, panic or confusion is visible, though
persistent and strenuous efforts are underway at all the levels of the Covid
management system. District-level control cells connect every healthcare
facility to the available logistic resources. These control-cells monitor daily
activities to ensure that there is no shortage of bed, oxygen, ventilators and
the likes. The state has also ramped up its Covid care infrastructure by adding
more hospital beds, ventilators, ICUs etc., in addition to its already existing
notable investment in public health. Expecting the second wave, the state had
put in extensive efforts to boost its oxygen production from 73 metric tons to
219 metric tons a day. Besides all these, the most crucial practice Kerala has
been following is to report the actual data which helps in an accurate forecast
of expected cases and estimation of resources required to tackle the situation.
The priority is to control the number of deaths regardless of the positivity
rate, which even if spiraling is not something to worry about unless the healthcare
system collapses, running out of beds, oxygen and ventilators. So far, the
healthcare system in Kerala has succeeded in extending necessary medical services
to all those who got infected with the novel Corona virus and thereby kept the
death rate at its minimum.
Unlike the first lockdown (which
was sudden and unplanned, leading to unexpected loss of livelihoods for many
and the grave migrant crisis), the Center did not take any initiative in the
second wave to restrict people's movements but left the same at the liberty of
the state governments! If the first lockdown worked as a preparatory phase,
Kerala’s motto in the second wave is to slow down the spread of the virus so
that the system does not fall apart by an overwhelming number of cases.
Vaccination: As per the Covid dashboard of the
Kerala government, nearly one-third of the state’s 18+ population has received
at least one dose of the vaccine so far. Like many other states in India,
paucity of vaccine is still a matter of concern for Kerala. However, the proficient
handling and optimum use of vaccines by the nurses could help give more vaccine
to the people than the allotted amount. Kerala is the only state to have
reported zero wastage of vaccines.
Role of Local government bodies in Covid care: Local government bodies with their task force are at the front
line to deal with the pandemic situation at the micro-level. Ward level Rapid
Risk force has been constituted in all wards with respective ward members, ASHA
workers and ANM and SHG personnel. They are the first to reach out to for
families having a Covid patient or a migrant member. The ASHA workers after
checking on their health status arrange for quarantine facilities, if needed,
to avoid further spread of the virus in the family and the community, at large.
If, however, the household does not have a separate room with attached
washroom, the person is sent to a quarantine facility arranged by the local government.
Community Participation: The state government’s
coordination with local governments ensures that no person is left hungry in
the state. Data suggests that food prepared in the community kitchens run by women
from the SHG served around 8.6 million individuals, till May 17, 2021.
Quarantined people, guest workers (migrants), and destitute had extensively
availed these services, especially during lockdown. Not only the government
officials and health workers, but social volunteers are also working shoulder
to shoulder in the fight against this raging pandemic, supporting local
governments in arranging quarantine facilities for the isolation of Covid
positive patients. As per the Kerala Covid dashboard, till date around 3.7 lakh
volunteers have registered themselves. Nearly 3700 destitute have been
rehabilitated as of 25th April, 2021 and about 340,000 migrant
labourers served in labour camps.
The Kerala model of Covid
management is nothing but a comprehensive care system for citizens with
planning at the micro-level. In both phases of the Covid outbreak, the
preparation and alertness of the government, well equipped with infrastructure
and expertise is certainly outstanding. This has contributed to Kerala’s low fatality
rates -- less than 0.3%, even amidst a multitude of challenges, which undoubtedly
is a great achievement for the government. Necessary preparations to address the
forthcoming challenges of the pandemic are also continuing at the same time.
Reference
________________________________________________________________
(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ)
পশ্চিমবঙ্গের বিধি (তৃতীয় পর্ব)
লিখেছেন
অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য
![]() |
ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত |
এমনতর এক আবহে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থা নিয়ে খানিক আলোচনা করতে পারি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ব্যতিরেকে আর যে সমস্ত বাম দলগুলিকে আমরা এ রাজ্যে দেখতে পাই, তারা সকলেই কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারী। ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল ঘোষিত ভাবে সমাজতন্ত্রের অনুসারী কিন্তু কখনই তারা মার্কসবাদ বা লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া বাকী দলগুলির প্রত্যেকটিই নানা ভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তাদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছে, যদিও স্টালিন ও মাও প্রসঙ্গে অনেকের নানাবিধ ওজর-আপত্তি বা অনুরাগ আছে।
এ ছাড়াও আমাদের দেশে রামমনোহর
লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের নেতৃত্বে এক ধরনের ভারতীয় সমাজতন্ত্রের ঘরানা
গড়ে উঠেছিল যেখানে মার্কস-লেনিন’কে আদর্শ হিসেবে মানা হয়নি। কিন্তু সেই ঘরানা
পশ্চিমবঙ্গে তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি। এ রাজ্যে বরং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের
রকমফের কদর অনেক বেশি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল। সিপিআই থেকে সিপিআইএমএল, আরএসপি থেকে
এসইউসি(আই), মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আরসিপিআই- এমন বিবিধ মার্কসবাদী দলের
কম বেশি শক্তির ওপর নির্ভর করেই স্বাধীন-উত্তর এ রাজ্যের বিরোধী ও শাসক রাজনীতির
আবর্ত চলেছে। এই প্রথমবার ২০২১’এ এসে দেখা গেল, বাম-শূন্য এক বিধানসভা ও চলমান রাজনৈতিক
সমাজে এমন এক শাসক ও প্রধান বিরোধী পক্ষ যাদের যথাক্রমে মধ্যপন্থী ও চরম
দক্ষিণপন্থী বলে কেউ কেউ অভিহিত করছেন। আবারও বলি, নামে কী বা এসে যায়, কিন্তু
অন্তত ঘোষিত ভাবে যারা নিজেদের বামপন্থী বলে, তারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে যে জনসমর্থনের
কোন তলানিতে এসে তারা পৌঁছেছে। অতএব, প্রশ্ন হল, হচ্ছে টা কী?
এই লেখায় আগেই বলেছি,
বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ও সমাজ-অর্থনীতির বিকাশের সম্ভাব্যতার কথা।
সে সম্ভাব্যতায় কঠিন-কঠোর স্টালিনপন্থী একটি দল সিপিএমের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বে
বামফ্রন্ট এ রাজ্যে ৩৪ বছর একটানা সরকার চালাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম দিকে খানিক
অসুবিধা ও আশঙ্কা থাকলেও বামফ্রন্ট সরকার ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে কখনই বিপজ্জনক হয়ে
ওঠেনি যে এই সরকারকে জোরজবরদস্তি ফেলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ, দেখা
গেল, বিবর্তনের ধর্মে একটি মার্কসবাদী দলকেও নির্বাচনে জিতে সরকার চালানোর সুযোগ
দেওয়া সম্ভব। এটা তাহলে কীসের
বিবর্তন? কোথা থেকে কোথায় বিবর্তন হল? কেন এমনতর সম্ভব হল? একটি পুঁজিবাদী (অথবা
আধা-পুঁজিবাদী) রাষ্ট্র কীভাবে ও কেনই বা একটি মার্কসবাদী দলকে নির্বাচনে জিতে
সরকারে বসতে ও তা দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে সুযোগ দিল? তার কি এমন কোনও আশঙ্কা বা
সন্দেহ ছিল না যে এই ধরনের দলের সরকার আরও ‘গোলযোগ’ সৃষ্টি করে পুঁজিবাদকেই হটিয়ে
দিতে পারে অথবা পুঁজিবাদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে? সে আশঙ্কা যে
ছিল না, তা নয়। ১৯৫৯ সালে সেই আশঙ্কা থেকেই কেরালার নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে বরখাস্ত
করা হয়েছিল। চিলিতে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলেন্দে মন্ত্রীসভাকে সামরিক অভ্যুত্থান
করে ১৯৭৩ সালে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্য একটা প্রবণতাও বেশ জোরালো ভাবে সচল
ছিল। তা হল, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর ‘সামাজিক সুরক্ষা’র নিদান সহ সংসদীয় গণতন্ত্রের এক কল্যাণমূলক উদারবাদী
আবহের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ যে পথকে ‘ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস’ নাম দিয়ে নতুন পথে যাত্রা
শুরু করল, সে পথে ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বিষয়ক একটি শক্তিশালী
উপাদান সুপ্ত ছিল। এই পথ নির্মিত হয়েছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের
কল্যাণমূলক অংশগ্রহণে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনে উন্নয়নের চিহ্ন দেখে। তাই,
সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের যে সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত, তা পুঁজিবাদী দেশে একটি
আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে হলেও গ্রাহ্য হল।
পাশাপাশি, ১৯১৭ সালে
প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেও একটি একদলীয়, একনায়কতন্ত্রী ও
গণতন্ত্রহীন ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে প্রদর্শিত হচ্ছিল। বিপ্রতীপে,
ইউরোপ ও অন্যান্য সদ্য স্বাধীন দেশে বহুদলীয় নির্বাচনমূলক ব্যবস্থায় জনগণের
দাবি-দাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলি যেন একটি সেফটি-ভাল্ব’এর মতো বহু কিছু আদায়ের
পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠল। অন্তত চৈতন্যের জগতে
এমন একটা প্রভাব নিশ্চয়ই কাজ করল যে, শুধু খাওয়া-পরার নিশ্চিন্তিই বড় কথা নয়,
ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন চলাচল, মতামত ও শাসককে বদলে দেবার ক্ষমতা (ভোটাধিকার)-
এগুলোও বেঁচে থাকার পরম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমি মনে করি, এখানেই কমিউনিস্টরা রাজনৈতিক
ভাবে হেরে গেল। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অনুশীলনে বাস্তবিক তারা ব্যর্থ হল। গোড়ার দিকে বুর্জোয়া
শ্রেণির একনায়কত্বের বিপরীতে তাদের শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই যখন পরবর্তী
কালে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সমাজতান্ত্রিক (বা শ্রমজীবী মানুষের) গণতন্ত্রে
রূপান্তরিত করার লড়াইয়ে পর্যবসিত হল, তখন কার্যত তারা নতুন ও উন্নততর কোনও সূত্রায়ন
বা অনুশীলনে পৌঁছতে পারল না। আশ্চর্যের হলেও, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট
পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলেও তেমন কিছু ছিল না।
অর্থাৎ, কিঞ্চিৎ মজার হলেও
বিবর্তনটা হল এমনতর যে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অনুশীলনের সদর্থক দিকগুলিকে
পুঁজিবাদী দুনিয়া নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করার স্বার্থে গ্রহণ করল।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তারই অঙ্গ ছিল। তাই
পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে
অন্তর্ভুক্ত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আর এইভাবে সমাজতন্ত্রের অনুষঙ্গগুলিকে অঙ্গে
নিয়ে পুঁজিবাদের যে বিবর্তন তাতে সে প্রথম প্রথম ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবের’ ভয়ে খানিক
আশঙ্কিত থাকলেও পরে আর তেমন বড় করে ভয় পায়নি। কারণ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র বহু
মানুষের কাছে তার যাথার্থ্য প্রমাণে এতদূর এগিয়ে গেছে যে ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’
সে তুলনায় একেবারেই প্রায় অস্তিত্বহীন ও পশ্চাদপদ একটি সত্তা হিসেবে বিরাজমান
থেকেছে। তাই, এ আস্থা পুঁজিবাদের অল্প হলেও ছিল (পরে আরও বিধৃত হয়েছে) যে,
নির্বাচনের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেও তারা সংসদীয় ব্যবস্থার পরিসীমা
ডিঙোতে পারবে না। কারণ, সে ডিঙোবার জন্য তাদের কাছে যথার্থ বা আরও উন্নত কোনও
গণতান্ত্রিক কারুকৌশল নেই যার আদর্শ ও আকর্ষণে ব্যাপক মানুষ অমন কোনও ব্যবস্থার
দিকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যেতে চাইবে। যা আছে, তা দিয়ে অল্প কয়েক দিনের জন্য খুব সংকটাপূর্ণ
পরিস্থিতির উদয় হলে জোর লড়াই দেওয়া যেতে পারে বড়জোর।
এই যে এইভাবে সমাজতন্ত্রের
উপাদানগুলি পুঁজিবাদের গহ্বরে অন্তর্লীন হয়ে গেল, তা এমন এক বাস্তবতা নির্মাণ করল
যে কমিউনিস্ট নামধারী অথবা কার্যসূচি বহনকারী যে কোনও রাজনৈতিক শক্তি পুঁজিবাদী
ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দিনাতিপাত করতে পারে। আর কমিউনিস্ট শক্তি যেহেতু একটি দেশে
একটি মাত্র পার্টিতেই সংগঠিত নয়, বহু ধরনের পার্টিতে তারা বহুতর, অতএব, এই গোটা
শক্তিটা যখন কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এক জায়গায় এসে জড়ো হয়, সঙ্গে আরও
প্রতিবাদী শক্তি বা পার্টিকে পাশে পায়- তখন এই গোটা মহলটাকেই এক কথায় ‘বামপন্থী’
বলে সাব্যস্ত করা হয়। হতে পারে, এই সমগ্র শক্তিটা কোনও কোনও দেশের বা কোনও অঞ্চলে
তাদের রাজনৈতিক কাজের নিরিখে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে নির্বাচনের মাধ্যমে
স্থানীয় বা জাতীয় ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু ক্ষমতা দখল করে তারা কি আমূল
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পথে এগোতে পারে? এই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত। এখন
পর্যন্ত যে কটি দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে আমূল পরিবর্তনের পথে এগিয়েছে,
সেইগুলি কিন্তু বহু পুরাতন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জিত (যেমন, সোভিয়েত
ইউনিয়ন, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি)। অবশ্য, সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন
করে পুঁজিবাদের পথেই আবার হাঁটতে শুরু করার অভিযোগ কিন্তু এই দেশগুলির বিরুদ্ধে
আছে।
তাহলে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে
পরপর সাতবার নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুতির
এত অল্প সময়ে জনপ্রতিনিধিত্বের গুনিতকে একেবারে শূন্যে নেমে গেল কেন? এ রাজ্যে
বামপন্থার ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বা নব-উত্থান বলতে কি সেই সিপিএমেরই গোয়ালে আবার ফিরে
যাওয়া বোঝাবে? এই প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বসে
বামপন্থীরা যেমন তাদের শক্তি সঞ্চয় করে, আবার দুর্বলও হয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, ফ্রান্স ও আরও কিছু দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কেরা ও
পুঁজিপতি শ্রেণি কমিউনিস্ট বিপ্লবের শঙ্কায় এতদূর পর্যন্ত ভীত ছিল যে আমেরিকা
চার্লি চ্যাপলিনের মতো প্রতিভাধরকে শুধুমাত্র ‘কমিউনিস্টদের প্রতি
সহানুভূতিসম্পন্ন’ অভিযোগে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। সেইসব দেশে কমিউনিস্টরা
আক্ষরিক অর্থেই জনসমর্থনের ভিত্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং যে কোনও সময়ে ক্ষমতা
দখলের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ইতিহাস অবশ্য সে পথে হাঁটেনি।
পশ্চিমবঙ্গেও ৬০’এর দশক থেকেই
বামপন্থীরা প্রবল ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনে উত্তরোত্তর তাদের সমর্থন ও
সাফল্য আসতে থাকে। ১৯৭৭ সালে এই সমর্থন একটি কার্যকরী রূপ পায় এবং তারা ক্ষমতায়
আসীন হয়ে কিছু যুগান্তকারী কর্মসূচিও রূপায়ন করে (যেমন অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েতি
ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি)। এর আগে ৬০’এর দশকের শেষে ও সত্তর দশকের গোড়ায় নকশালপন্থী
(সিপিএম থেকে ভেঙে আসা ও সিপিআইএমএল নামে সংগঠিত হওয়া) কমিউনিস্টরা নির্বাচন ও
সংসদীয় পথকে বর্জন করে সশস্ত্র বিপ্লবের (‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত
করুন’) ডাক দেয়। সারা দেশ জুড়ে এক ব্যাপক আলোড়ন ওঠে। কিন্তু প্রস্তুতির অভাব ও
নানান রাজনৈতিক কারণে সেই বিপ্লবের আহ্বান ১৯৭২ সালেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যু ও দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় তাদের অবশিষ্ট কর্মীরা নানা
গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নতুন ভাবে কাজকর্ম শুরু করে। এই ধারা এখনও বহমান
আছে, যদিও তাদের অধিকাংশই এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশভাক হয়েই নিজেদের কর্তব্যকর্ম
চালাচ্ছে। তাহলে তারাও কি উপলব্ধি করেছে যে সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন এক ভার ও
গ্রহণযোগ্যতা দেশের মাটিতে তৈরি হয়েছে যে তাকে অস্বীকার করার কোনও জো নেই? এতে
অসুবিধার কিছু নেই। বাস্তবতা হল, সংসদীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ নানা ভাবে এতটাই
সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন যে একে বাদ দিয়ে আজ ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক কর্তব্যকর্মই
সমাধা হতে পারে না। সে পথে কীভাবে, কতটা এগোলে বামপন্থীদের পক্ষে রাজ্য বা জাতীয়
স্তরে সাফল্য আসতে পারে সে অন্য আলোচনার বিষয়। তা ব্যতীত, বস্তুগত পরিস্থিতির
আনুকূল্যের জন্য অপেক্ষা করতে জানতে হয়।
যে কথা এই লেখায় হয়তো ঘুরে
ফিরে কয়েকবার উল্লেখ করেছি, সংসদীয় ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ একদিকে যেমন চাইবে তার মতো
করে তার বিরুদ্ধ শক্তিগুলিকে আত্মসাৎ করে নিতে, একইভাবে অন্যদিকে পুঁজিবাদ বিরোধী
শক্তিরাও চাইবে পুঁজিবাদ সংকটাগ্রস্ত হয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে
দিক। কিন্তু বিবর্তনের নিয়মে সম্ভবত তেমন সোজাসুজি- হয় এটা নয় সেটা- কোনও পথ আজ আর
নেই। বলতে চাইছি, পুঁজিবাদও তার সংকটের (বারবার সে সংকটে পড়ে) উপায় হিসেবে
বামপন্থাকে যতটা সম্ভব ধারণ করতে অপটু নয়। অর্থাৎ, প্রয়োজন পড়লে বামপন্থার বহু
কিছুকে আত্মস্থ করে পুঁজিবাদ তার প্রাণবায়ুকে সচল রাখবে। ফলে, উল্টো পথে এমনও ঘটা
অস্বাভাবিক নয় যে বামপন্থী কোনও শক্তি নিজেদের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে
ধরে রাখতে পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া উপাদানগুলিকেও ফিরিয়ে আনতে উদ্গ্রীব। এ
রাজ্যে সিপিএম ও বামফ্রন্টের শরিকদের দীর্ঘকাল ক্ষমতা ভোগের কারণে কতকটা তেমন দশাই
হয়েছে। আর মূলত সে কারণেই তাদের ভোটের জনসমর্থন আজ ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাশাপাশি,
এই সরল কথাটাও তারা বুঝল না যে, পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া অনুশীলনকে তারা যখন নির্মম
ভাবে ধরতে চাইছে, তখন খুব স্বাভাবিক পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কোনও
শক্তি নতুন পথে এগোনোর চেষ্টা করে পুঁজিবাদকে প্রাণবায়ু দেবে।
বলার এই, যা সাম্প্রতিক
বিধানসভা নির্বাচনেও বোঝা গেল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ও আন্দোলন থেকে সিপিএম
কোনও শিক্ষাই নেয়নি। এই শতকের প্রথম দশকে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যখন উত্তুঙ্গে এবং
পুঁজি পাগলের মতো নিজেকে স্ফীতকায় করার বাসনায় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে,
তখন স্বভাবতই তা পুঁজির বাজারের ফাটকা কারবারে ও আরও নানাবিধ এমন সব কাজেকর্মে অতি
সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়বে যেখান থেকে সম্পদ ও তাৎক্ষণিক মুনাফা খুব দ্রুত হস্তগত হতে
পারে। তেমনই একটি ক্ষেত্র ছিল জল-জঙ্গল-জমি অধিগ্রহণ করে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও
তৎপ্রসূত অতি-মুনাফার বাণিজ্য করা। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কর্পোরেটরা শিল্পের
নামে বিশাল জমি অতি স্বল্পমূল্যে সরকারি সাহায্যে বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে তা বেশ
কয়েক বছর ফেলে রেখে হয় সেখানে আবাসন গড়েছে বা চড়া দামে আবার হাতবদল করেছে। সে এক
বিশদ কাহিনি। আর সে কাহিনিরই অংশ ছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে শিল্প গড়ার নাম করে জোরজবরদস্তি
জমি অধিগ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মযুক্ত মানুষকে উচ্ছেদ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে
দেওয়া। আর তা হচ্ছিল দীর্ঘকাল এ রাজ্যে অধিষ্ঠিত বামফ্রন্টেরই হাত ধরে বামপন্থার
নাম করেই।
২০০৬ সালের ২৫ মে টাটার এক
প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা যখন চুপিসারে দুপুরবেলা সিঙ্গুরে জমি
দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন খবর পেয়ে কৃষক রমণীরা হাতে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে রাস্তায়
নেমে এসে সে দলকে তাড়িয়েছিলেন। সে খবর চাউড় হতেই অসুস্থ জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস
করেছিলেন, ওখানে কৃষক সভাকে না জানিয়ে টাটার দল গেল কেন? প্রশ্নটি খুবই অর্থপূর্ণ।
তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একটি বামপন্থী দলের স্থানীয় কৃষক সংগঠনের অজান্তেই কৃষিজমি
সম্পর্কে নতুন কোনও প্রস্তাবের রূপরেখা কেন ভাবা হয়েছিল? এই মত স্পষ্টতই, একটি
বামপন্থী দলের স্বাভাবিক গণভিত্তি যে কৃষক সমাজ, তার গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে বলে।
কিন্তু পুঁজিবাদের মায়ামোহে তদানীন্তন বামফ্রন্টের নেতারা এতটাই মশগুল যে নিজ
পার্টির শ্রেণি ভিত্তি বা কর্তব্যকর্ম তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। এর পরের
ঘটনাবলী আমরা জানি।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক
আন্দোলনের সমর্থনে সারা রাজ্য জুড়ে এক তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে আন্দোলনের
ভাষা তাঁরা পড়ে উঠতে পারেননি। বিরোধী দলনেত্রী তাঁর সংসদীয় রাজনীতির কারুকৌশলে
অচিরেই এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকায় চলে আসেন এবং ২০১১ সালের
নির্বাচনের রায়ে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘকালীন সরকারের পতন ঘটে। বামফ্রন্ট
বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী শক্তি এই আন্দোলনে থাকলেও তাদের নানা ধরনের জড়তা ও
মতান্ধ চিন্তাভাবনা থাকার ফলে তারা এই আন্দোলনের দায়ভাগকে শেষাবধি বহন করতে ব্যর্থ
হয়। এই ব্যর্থতার অন্যতম
কারণ, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের এক অবিমৃশ্যকারী
আচরণ।
মুশকিল হল, বামফ্রন্ট বা
সিপিএমের তরফে এই বিচ্যুতিটা তারা আজও বুঝে উঠে পারল না। এবারের নির্বাচনের
প্রাক্কালে তাদের প্রার্থী সিঙ্গুরে গিয়ে ‘শিল্পের শিলন্যাস’ করে এলেন। আর ভোটের
ফলাফলে আবারও তাদের ভরাডুবি হল। সচ্ছল মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে বামপন্থাকে
দেখার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম, তা তাদের কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হল। তবুও তাদের হুঁশ নেই।
শ্রেণি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত তাদের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নিঃশব্দে নিজেদের
দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে ফেলেছেন যে! তাঁরা ভাবলেন, একরের পর একর জমি পেয়ে
কর্পোরেটরা এসে সুবোধ বালকের মতো শিল্প গড়ে তুলবে আর সেই শিল্পে রাজ্যের বেকার
যুবকদের কর্মসংস্থান হবে! কী বিপদ! সাধারণ খবর রাখা একজন সচেতন মানুষও জানেন যে,
প্রথমত, সস্তায় জমি পেয়ে কর্পোরেটরা যে সেখানে শিল্প গড়ে তুলবেই তার কোনও নিশ্চয়তা
নেই (এ হল বিগ মিডিয়া নির্মিত একটি মিথ); দ্বিতীয়ত, যদিও বা সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে
তা হবে এতটাই অত্যাধুনিক যে সেখানে খুব সীমিত সংখ্যক দক্ষ বেকারেরই কর্মসংস্থান
হতে পারে; আর তৃতীয়ত, সব থেকে মূল্যবান কথাটি হল (যা আমাদের শীর্ষ আদালতও তুলে
ধরেছে) যে, উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি হবে, তা
নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থেকে অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ, নতুন শিল্প,
সহায়ক-শিল্প মিলিয়ে সর্বমোট যারা কাজ পাবেন তাঁদের থেকে যারা কাজ হারাবেন তাঁদের
সংখ্যাটা অনেক পরিমাণে অধিক।
এও মনে করে দেখুন, সিঙ্গুরে
যে জমিটি নিয়ে এত লড়াই, সেই জমির উল্টোদিকে (হাইওয়ের ওপারে) সমপরিমাণ ঈষৎ নিচু
একটি প্রায়-পরিত্যক্ত জমি ছিল, যে জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষজনের কোনও আপত্তিও
ছিল না, সেখানে টাটাদের প্রস্তাবিত শিল্প গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা
সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কেন? কারণ, জমিটি যেহেতু অল্প নিচু ছিল, তাই সেখানে কিছু
পরিমাণে মাটি ফেলে ভরাট করার দায় পড়েছিল তাদের ওপর। টাটারা সেই সামান্য ব্যয়টুকুও
করতে রাজী ছিল না মুনাফার কিয়দংশে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে ভেবে। আর বামফ্রন্ট সরকার
এমন নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের পক্ষে দাঁড়াল যে, তারা টাটার সামান্য ব্যবসায়িক ব্যয়
বৃদ্ধিকে পর্যন্ত কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় করে
দেখল।
শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের
সোচ্চার প্রতিধ্বনি হয়ে যে বামপন্থী দলগুলির উত্থান ও বিকাশ, সেই তারাই এইভাবে হাতে
লাল পতাকা নিয়ে ও মার্কসবাদের নাম করে প্রকারান্তরে শ্রমিক-কৃষকের বিপক্ষে গিয়ে
রাজনীতির অতল জলে ডুবে গেল। অন্যদিকে, ভারতের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের থেকে
নিজেদের আলাদা করে যে আঞ্চলিক নতুন দলটি
রাজ্যে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়, তারাই কৃষকদের স্বার্থে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে,
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র কঠিন লড়াই চালিয়ে এক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে রাজ্যের
ক্ষমতায় আসীন হল। অথচ, এই দলের তেমন কোনও ঘোষিত মতাদর্শ নেই। দু’ দফায় সরকার
চালিয়ে তৃতীয় বারের জন্যও তারা নির্বাচিত হল বেশ প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে। তার অর্থ
অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল সরকারের কোনও ব্যর্থতা বা অসাফল্য ছিল না। অবশ্যই ছিল। কিন্তু
এমন একটা আস্থা তারা রাজ্যের মানুষের থেকে আদায় করতে পেরেছে যে এক বড় সংখ্যক মানুষ
বিশ্বাস করেছেন, অন্য সব দলের থেকে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের পাশে তৃণমূল সরকার আছে।
দুর্ভাগ্যের হলেও বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা দলের মতোই তৃণমূলও নিজ
দলীয় ক্ষমতা জাহির করতে পিছপা হয়নি, স্থানীয় স্তরে আগের জমানাগুলোর মতোই অনেক
জায়গাতেই গায়ের জোর দেখিয়েছে। দুর্নীতিও কম করেনি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এমন একটি
সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণ তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ভিত্তিতে মানুষ
তাদের অপকর্মগুলিকে সার্বিক বিচারে কম গ্রাহ্য করে সুকর্মের ভিত্তিতে তাদের ওপরে
আস্থা রেখেছে। উপরন্তু, এবারের নির্বাচনে বিজেপি নামক এমন এক ফ্যাসিবাদী শক্তি এ
রাজ্যের নির্বাচনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার বিরোধিতায় তৃণমূলও এক
অটল লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছিল, তা দেখে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও
নেতৃত্বের ওপর কুণ্ঠাহীন আস্থা জ্ঞাপন করেছে।
এই যে নবতর এক
সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগের কাণ্ডারী তারা হতে পেরেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক
আস্থাভাজন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছে, বহু প্রকল্প ও জনমুখি অনুশীলনের দ্বারা
প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে কল্যাণমূলক কার্যধারাগুলিকে পৌঁছে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে
মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। দেখে মনে হবে, তারা বোধহয় কোনও বাম মতাদর্শ
দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে তাদের অগ্রাধিকার পিছিয়ে পড়ে মানুষদের প্রতি। লক্ষণীয়,
ঘোষিত ভাবে তারা কোনও মতাদর্শের অনুসারী নয়। বামপন্থীদের যে দাবিগুলি চারপাশে
বারবার উচ্চারিত হতে শোনা যায়, তারা সেইগুলিকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হতে পারে
তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, হতে পারে তা নির্বাচনে জেতার জন্য। এতে সমস্যা কোথায়?
বরং, এ তো বেশ ভাল ব্যাপার যে, সংসদীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতায় জনগণের
আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ও বহু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর সে কারণেই
সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত ও উদার করা অতীব জরুরি। আর এইভাবেই তো চাপে পড়ে সংসদীয়
গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরও বৈধতা পায় ও মানুষের আস্থা অর্জনে বেশি বেশি করে সক্ষম
হয়ে ওঠে। আর যতই তা হয়, সাবেকি ও সনাতন বামপন্থীরা যেন পিছিয়ে পড়তে থাকে। দেখা
যায়, নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করে বামপন্থার
কর্মসূচিগুলিকেই আরও উন্নত স্তরে ধারণ করে। সে অর্থে বলাই যায়, এ রাজ্যে সংসদীয়
ব্যবস্থার দৌড়ে তৃণমূলিরা সাবেকি বামপন্থীদের একেবারে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ এক
অভিনব প্যারাডক্স। বামপন্থাকে অন্তঃস্থ করেই সংসদীয় গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র
যেন আরও সবল হয়ে উঠছে। অথচ সেখানে বামপন্থী নামধারীদের কোনও ঠাই নেই। কারণ, তারা চিন্তা-চেতনা
ও কর্মে পড়ে আছে কয়েক দশক পিছনে। আর সে জন্যই আজ এই একুশ শতকের বিশের দশকের গোড়ায়
এসে আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশধারা কোন পানে এগোচ্ছে আর সংকটের
সূত্রগুলি কোথায় আবর্তিত হচ্ছে ও সুপ্ত আছে, তা বোঝার আদৌ কোনও এলেম তাদের নেই।
কারণ, বহুদিন হল তারা রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চাকে সমূলে বিসর্জন দিয়েছে। বামপন্থী
নামধারী যাদের বলি (কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসীদেরও সে তালিকায় ফেলে) তাদের আজকের
সংকট ঠিক এইখানটাতেই (তবে অবশ্যই অন্য কিছু বামপন্থী শক্তি নতুন ভাবে এগিয়ে আসছে)।
অথচ যারা বামপন্থী নামধারী নয়, তারা ঘোর বাস্তবে বেমালুম ধাক্কাটাক্কা খেয়ে বামপন্থীদের
সম্ভাব্য ইস্যুগুলিকে নিয়েই বেশ এগিয়ে পড়েছে। এই ‘ধাক্কাটা’ ওই তথাকথিত
‘অ-বাম’পন্থীদের আরও গায়ে লাগে কারণ, সংসদীয় রাজনীতিই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের
অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। তাদের পক্ষে তা বেশ আয়াসসাধ্যও, কারণ তাদের অত মতাদর্শের
পিছুটান নেই। তাই বলি, নামে কী বা আসে যায়!
এই যে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি
সম্পর্কে সাবেকি বামপন্থীদের অজ্ঞতা, তার আলোকেই নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে এখন তাঁরা
সামাজিক ন্যায়-প্রকল্পগুলিকে ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে বক্রোক্তি করছেন। কারণ, তাঁরা
জানেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে যে বহু কথিত
‘গিগ অর্থনীতি’র জমানা শুরু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী ও যথেষ্ট কর্মসংস্থানের কোনও
আয়োজন নেই। আধুনিক যন্ত্র এখন আয়েসেই বহু মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম দুইই বেশ
দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম। অতএব, আগামী দিনে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা
ক্রমেই আরও সংকুচিত হবে। যে কারণে, ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর আলোচনা এখন কান
পাতলেই সর্বত্র শোনা যায়। অর্থাৎ, বহু সংখ্যক মানুষের হাতে টানা কাজ থাকবে না, প্রযুক্তি
ও তার আনুষঙ্গিক দক্ষতা বহুল পরিমাণে খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে, কাজের বাজারে
এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে
সমাজকল্যাণ মূলক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা শত গুনে বেড়ে যাবে। তাই, ‘ভিক্ষার ঝুলি’ বলে
সেইসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে অবজ্ঞা করাটা আসলে অজ্ঞতার দিকচিহ্ন। শিল্প স্থাপনা
ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির যে বড়াই সাবেকি বামপন্থীরা করে থাকে তা অশ্বডিম্ব বৈ
আর কিছু নয়। কারণ, সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা শিল্প আর
কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নয়, যা কিছু নতুন গড়ে উঠছে তা সব মেঘের আড়ালে
(ক্লাউড প্রযুক্তি)। এই নতুন ভার্চুয়াল শিল্পে বিশেষ ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের
চাহিদা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাজের অধিকাংশ পরিসরটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার
হাতে। এই সামগ্রিক উত্থানটাকে কি বামপন্থীরা বুঝতে পারছেন? বিপদটা সেখানেই।
তাহলে কি বলব যে, পুঁজিবাদী
রাষ্ট্র বাধ্যত ক্রমেই বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠছে? অর্থাৎ, নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির
অভিসারে তা কি আরও কল্যাণমূলক অবস্থান গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গভীর ভাবে খতিয়ে
দেখার বিষয়। এর উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে কিছু হয় না। আমরা ডোনাল্ড
ট্রাম্প, বোলসোনারো, এর্ডোগান, নরেন্দ্র মোদির মতো চরম দক্ষিণপন্থী ও মতান্ধ
শক্তিকেও নির্বাচনের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসতে দেখছি। তা নিয়ে এ লেখায় বিশেষ
কিছু বলার নেই। বরং বলা যাক- যারে তুমি বাম দেখ সে কি বাম নয়/ যারে তুমি পর ভাবো
সে কি বাম হয়’। অতএব, এ এক জটিল ধাঁধাঁ।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখায়
শেষ কথাটি হল, যারা নামে ও কাজে বামপন্থী বলে নিজেদের মনে করেন (নানাবিধ কমিউনিস্ট
সহ) তাদের আজ সময় হয়েছে একুশ শতকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সম্পূর্ণত নতুন উত্থানকে
সম্যক অনুধাবন করে তাকে এমন ভাবে উপলব্ধি করা যাতে একটি যথার্থ সমাজ বদলের
(পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে) কার্যসূচি আবারও নির্মাণ করা যায়। বলাই বাহুল্য,
পুঁজিবাদ তার নিজ জোরেই টিকে থাকছে, দরকার পড়লে সে বামপন্থাকেই যতটা সম্ভব আত্মসাৎ
করছে, আর সেই সুবাদে নামধারী বামপন্থীদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির
কালবেলায় পুঁজিবাদকে অতিক্রমণের মহামন্ত্র নামধারী বামপন্থীদের এখনও জানা নেই,
কারণ, তারা রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় আপাতত বাঁধা পড়ে আছে।
(সমাপ্ত)