লিখেছেন পুরুষোত্তম সিংহ
|
সব বানানো গল্প (বই-সম্বন্ধীয় অন্যান্য তথ্য লেখার শেষে) |
[আমাদের সময়টা নানাভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এক আগ্রাসী
ভোগবাদী মানসিকতা বাঙালির সমস্ত কিছু গ্রাস করেছে। সামাজিক অবস্থান নানাভাবে
ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শ্রেণি বারবার শ্রেণিচ্যুত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তার
প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রাজনীতির কোন্দলে সাধারণ মানুষের ত্রাহি-ত্রাহি রব চারিদিকে। ধর্ষণ, খুন, জখমে দিন আনা দিন খাটা মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। মিথ্যাকথার ফুলঝুড়ি নিয়ে মিডিয়া উচ্চস্বরে
প্রচার চালাচ্ছে। একটি সত্যকে চাপা দিতে একাধিক মিথ্যার মিশ্রিমালা বুনেছে। ভদ্র বাঙালি
সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে এক দূষিত অপসংস্কৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমারা, আমাদের
প্রজন্ম। এইসব দেখে একজন সচেতন লেখক কি চুপ করে থাকতে পারেন?]
না, পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ও পারেননি। এইখানে বলে নেওয়া
প্রয়োজন বাংলা বাজারে সচেতন অসচেতন দুইপ্রকার লেখকই আছে। সচেতন অপেক্ষা অসচেতন
লেখকেরই বাজার রমরমা। যিনি সেক্সের কেচ্ছা ফেঁদে বসেছেন, কাহিনির স্বর্গ নিয়ে
প্রেমের রোমান্সজালে বাঙালি পাঠককে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছেন তার বাজার চরম শীর্ষে।
মাঝে থেকে বাঙালির সব হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের দায়বদ্ধতা।
বিগত পঁচিশ বছরের যাপনের ফসল ‘সব বানানো গল্প’। আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে যে গোলকধাঁধা,
নানা রহস্য, শাসকের দুর্নীতি, অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা, চোরবালি ও ভণ্ডামির মুখোশ তা
উন্মোচিত হয়েছে এই গ্রন্থের বারোটি আখ্যানে।
পুষ্পল মুখোপধ্যায়ের ‘লাটাই’ (যুবমানস, ১৯৯৩) গল্পে দুই
শ্রেণির দ্বন্দ্বের চিত্র চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে
নিম্নবিত্ত শ্রেণির। উচ্চবিত্ত শ্রেণি এখানে লড়াইয়ে নামেনি। নামার প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু শ্রেণিশত্রুদের বিরুদ্ধে যেন এক ক্রোধের জন্ম হয়েছিল ন্যাড়ার মনে। নিম্নবিত্তের
ন্যাড়া বস্তির ছেলে। বস্তির ওপারে গড়ে উঠেছে সম্রাট অ্যাপার্টমেন্ট। কোনদিন
ন্যাড়াদের বস্তিও উঠিয়ে দেওয়া হবে। ন্যাড়া কাজ করে কানাইয়ের সাইকেলের দোকানে।
সম্রাট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ঘুড়ি ওড়ায় উচ্চবিত্তের সন্তান বাবলু। বাবলুর প্রতি এক
জাত ক্রোধ রয়েছে ন্যাড়ার। কেন এই ক্রোধ তা সে নিজেই জানে না। দুজনই প্রায় সমান
বয়সের। কিন্তু পৃথক অবস্থানের চিত্রই যেন এক ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। বাবলুর ঘুড়ি থাকলেও তার নেই। ঘুড়ি না থাকার
জন্যই কি ক্রোধ? তবে তো বস্তির কেষ্ট, কানুর ওপরও হত। কেননা তাদের ঘুড়ি আছে। এমনকি
বাবলুকেই সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। বাবলুকে সে বলে কেবলু। সে জানে এই
বাবলুরাই তাদের সমস্ত ছিনিয়ে নেয় বা নেবে। এই বাবলুদের পরাজিত করতে হবেই।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন অন্যের ঘুড়ি চুরি করে ঘুড়ি যুদ্ধে নেমেছে ন্যাড়া। এমনকি শেষ
পর্যন্ত যুদ্ধে জয়ীও হয়েছে। শুনে নেওয়া যাক লেখকের বর্ণনা—
"অনেক উঁচুতে, ছোট্ট একটু পা রাখার জায়গায় দাঁড়িয়ে
ন্যাড়া ঘুড়ি ওড়ায়, প্যাঁচ খেলে, যুদ্ধ করে ন্যাড়া। টানি থেকে ঢিলিতে চলে যায়। ঠিক
তখনই ন্যাড়ার ভারসাম্য বলে আর কিছুই থাকল না, ওর পা পিছলে গেল। ভীষণ টানে লাটাই
হাতে নিচে নেমে আসছিল ন্যাড়া, সেই টানেই বুঝি কেটে গেল বাবলুর ঘুড়ি, ভোকাট্টা।
কিন্তু ন্যাড়া সেটা দেখতে পেল না, ন্যাড়াকেই দেখা গেল না আর। খালে জলের থেকে পাঁকই
ছিল বেশি, সেই পাঁকেই তলিয়ে গেছে ন্যাড়া। শুধু ওর বাঁ হাতটা দেখা যাচ্ছিল। হাতের
মুঠোয় তখনও ধরা ছিল সুতো শেষ না হওয়া লাটাই। আপন মনে উড়ছিল খবরের কাগজে তৈরি বেঢপ
ঘুড়িটা। যুদ্ধ তখন আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল। ন্যাড়াকে বাঁচাতে ঠিক সৈনিকের মতো
খালে ঝাঁপিয়ে পড়ল খালপাড়।"
(লাটাই, সব বানানো গল্প, বিবক্ষিত, প্রথম
প্রকাশ ২০১৮, পৃ. ১২, ১৩)
উচ্চবিত্তের ওপরে থাকার আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি
ন্যাড়া। বস্তি থেকেই সে লড়াই দিতে চেয়েছিল। এমনকি জয়ীও হয়েছে। ইচ্ছে ছিল বাবলুর ঘুড়িকে
দুমরে মুচড়ে দেবে। পেরেওছে। গল্পের শেষ দৃশ্যে মুষ্টিবদ্ধ বাঁ হাতই যেন সে সত্যের
জানান দিয়ে যাচ্ছে। নিম্নবিত্তের লড়াই, শ্রেণি সংগ্রামের চিত্র শেষ হতে পারে না,
তারা জয়ী হবেই— এই সত্যই যেন লেখক জানান দিয়ে যান। তাই গল্প শেষে দেখি বস্তিবাসী
খাল পাড়ে এসে বাঁচাতে উদ্যত হয়েছে ন্যাড়াকে। গল্প হিসেবে ‘লাটাই’ বেশ উচ্চমানের।
বিধ্বস্ত সময়ে, অধঃপতিত সমাজ ব্যবস্থায় ন্যাড়ারা কীভাবে হারিয়ে যায় এবং জেদের
বশবর্তী হয়ে সংগ্রামে ফিরে আসে সেই চিত্রই লেখক প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। জীবনের
ছেদ-বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্নতা সব অতিক্রম করেও মানুষ বাঁচে, বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
জীবনের পথে বহু ঘটনা ঘটে যায়, কিছু স্মৃতিরেখায় আঁকা থাকে, কিছু মুছে যায়। কিছু
কিছু স্মৃতি মানুষকে প্রবলভাবে নস্ট্যালজিক করে তোলে, আবার কিছু ঘটনা নিছকই
মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। এ সমস্ত নিয়েই গড়ে উঠেছে পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের ‘ফল্গু’
(রবিবারের প্রতিদিন, ১৯৯৬) গল্প। গল্প আখ্যানে রয়েছে দুই নারীর জীবনের ভাঙা-গড়া,
প্রেম-প্রেমহীনতা, ভালোবাসা ও সংসারের গল্প। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বহু চরিত্র।
তবুও হাসনুদি, বিদিশা বিবাহ করেছে, সংসার গড়েছে। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় গল্প আখ্যানে
বহু বিমূর্ত চিত্র, সংকেত রেখে যান। কখনও সেতারের তার ছিঁড়ে গেছে বা শাড়ি উড়ে
গেছে। রাহুল, বিদ্যুৎরা হারিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা সময় চিত্রই যেন বড় হয়ে ওঠে।
বিদিশাদের কলেজবেলা, সারজা কাপ, রাহুলের আত্মহত্যা, বিদ্যুতের প্রমোটারি ব্যবসায়
এগিয়ে যাওয়া সময়ের যাপনচিত্রকেই যেন বড় করে তোলে।
‘পরির কার্টুন’ অসাধারণ গল্প। কোথা থেকে গল্প শুরু হল আর
কোথায় গিয়ে পাঠক হিসেবে থামতে হল ভাবতে গিয়ে বারবার মুগ্ধ হই। মোদ্দা কথা তিনি
গল্প নির্মাণ করতে জানেন। এমনকি গল্প নির্মাণে যে সিদ্ধহস্ত তা আর বলার অপেক্ষা
রাখে না। গল্পটি শুরু হয়েছে আপাতত লঘু ভাবে। এরপরেই লেখক ডুব দিয়েছেন যুদ্ধ,
সন্ত্রাসবাদ কবলিত সময়ে। লাদেনের সন্ত্রাসবাদে আমেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে
আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। বাসুদেব মনে মনে যুদ্ধকে সমর্থন করে, সে আমেরিকার পক্ষে।
একদিকে যুদ্ধে অন্যদিকে কন্যা পরির অ্যাডমিশন টেস্ট। স্ত্রী ঝর্ণার ইচ্ছা কন্যাকে
মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি করার। বাসুদেব ধরেছে কালোদাকে। কালোদা বলেছে পরিকে যেনতেন
প্রকারে মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি করে দেব। বাসুদেবের অফিসে বোমের ভুল খবরে গতকালই
কিছু মানুষ আহত হয়েছে। সে যুদ্ধ দেখার জন্য রঙিন টিভি এনেছে ঘরে। একজন সার্থক
গল্পকার আখ্যানের মধ্যে বহু স্তর আবিষ্কার করেন। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় এই গল্পে
বহুমাত্রিক স্তরে পাঠককে নিয়ে গেছেন। বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন ভাবনা। আছে
মূল্যবোধের অবক্ষয়। বাসুদেবের যুদ্ধ সমর্থন, বাচ্চা পরিও জেনে গেছে মেধা ছাড়াই
মাদারমেরি স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে। স্ত্রী ঝর্ণার রয়েছে দেবদেবী বিশ্বাস, সিরিয়াল
বা বচ্চনের ক্রড়পতির প্রতি ঝোঁক। পরির ঝোঁক কার্টুন দেখার প্রতি, বাসুদেব মত্ত
যুদ্ধে। আসলে ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতি মধ্যবিত্তের প্রবল আগ্রহ। ব্যতিক্রম নয়
বাসুদেবও—
"যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বোমার সঙ্গে সঙ্গে খাবারও ফেলেছে আমেরিকা।
খাবারের রঙ বোমার রঙের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে, বোম নয়, আমেরিকা রঙ বদলে দিচ্ছে
খাবারের। বুশ সারা বিশ্বকে বলছে, হয় তুমি আমাদের দলে, তা না হলে সন্ত্রাসবাদী, এ
যুদ্ধে নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই।
না, বাসুদেব একটুও নিরপেক্ষ নয়, বাসুদেব মনে মনে আমেরিকার দলে। আক্রমণের
পক্ষে বাসুদেব, যুদ্ধের পক্ষে, ওয়্যার এগেনস্ট টেরোরিজম। সন্ত্রাসের ভয়ে অমরনাথ
যায়নি বাসুদেব, কাশ্মীর যেতে পারেনি, শালা দিকে দিকে শুধু সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদী,
আমেরিকা পারে যদি সব ধ্বংস করে দিক।"
(পরির কার্টুন, তদেব, পৃ. ২৫)
পরের দিন পরির অ্যাডমিশন টেস্ট। পিতা-মাতা, কন্যা চলেছে
স্কুলের পথে। পথে আজ চলছে যুদ্ধ বিরোধী মিছিল। যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বরং মিছিলে
হেঁটেই যেতে হবে স্টেশনের পথে। লেখক অনবদ্য কৌশলে যুদ্ধ সমর্থনকারী ব্যক্তিকে
নামিয়ে দিলেন যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে। গলা না ফাঁটালেও, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে
না ছুড়ে দিলেও পা মেলাতে হয়েছে। গল্পের পরিণতি আরও বিস্ময়কর। মিছিলে নিজেকে মিলিয়ে
নিয়েছে বাচ্চা পরি। অ্যাডমিশন টেস্ট অপেক্ষা মিছিলের প্রতিই তার লক্ষ্য বেশি। সে
কিছুতেই যুদ্ধ বিরোধী মিছিল থেকে আসতে চায় না। শেষে জানা যায় যুদ্ধ থেমে গেলে
টিভিতে পিতা আর যুদ্ধ দেখবে না ফলে কার্টুন দেখতে পাবে। শুনে নেওয়া যাক গল্পকারের
বয়ান—
"মেয়ে বলল, ‘বুঝি তো, যুদ্ধ মানে তুমি যা দেখো রোজ টিভিতে অফিস থেকে ফিরে,
আর বিরোধী মানে এই আঙ্কেল বলেছে আমায়।'
মিছিল থেকে বেরিয়ে আসছিল বাসুদেব পরিকে কোলে করে। পেছন থেকে লোকটা বলল,
‘যেতে যেতে একটা কথা বলে যাও তো মামনি, তুমি এত করে যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে হাঁটতে
চাইছ কেন?’
কেঁদে ফেলল পরি। মিছিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল ‘আমার কার্টুন দেখতে
ভাল্লাগে তাই।"
(তদেব, পৃ. ২৯)
পারিবারিক যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, যুদ্ধ-যুদ্ধ
বিরোধীতা, ব্যক্তির অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের ভোগাকাঙ্ক্ষী জীবনের মধ্যেও নতুন স্বপ্নের
বীজ কীভাবে গড়ে উঠতে পারে তা লেখক দেখিয়েছেন। পরির যুদ্ধ বিরোধীতার মধ্যে আপাত
কার্টুন প্রিয়তা হয়ত আছে তবে যুদ্ধই যে শেষ সত্য নয় তা লেখক দেখিয়ে দেন। যুদ্ধ
বিরোধী মানুষই যে জয়ী হবে তা ফুটে ওঠে। লেখক এক অনন্ত দক্ষতায় এই আখ্যান নির্মাণ
করেছেন। ঘটনা অপেক্ষা বক্তব্য পরিস্ফুটনেই লেখকের লক্ষ্য বেশি। আর কাহিনির
চোরাস্রোতে ভেসে যায় সময়ের একাধিক ক্ষত-বিক্ষত বিন্দু। সেই বিন্দুগুলির তিনি আভাস
দিয়ে যান। পাঠক হিসেবে বুঝে নিতে হয় সময়ের চোরাস্রোত কীভাবে মানুষকে, মানুষের
মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। সেই ধ্বংস মূল্যবোধের মধ্যে জাগ্রত বিবেককে জাগিয়ে তুলতে
চান পুষ্পল মুখোপাধ্যায়। ‘চন্দ্রাবতী’ ( অথ ধরিত্রীকথা ২০০৫) প্রেমের গল্প।
সমষ্টির ঘাত-প্রতিঘাতে ব্যক্তি প্রেমের জয়ের গল্প। ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’
শব্দবন্ধটাই মনে এল গল্পের চরিত্রগুলির কথা পড়তে গিয়ে। চার লাল (মতিলাল, হীরালাল,
পান্নালাল, লালচাঁদ) মজেছিল চন্দ্রাবতীর প্রেমে। সবাই চন্দ্রাবতীকে পেতে চেয়েছিল।
চন্দ্রাবতী নানা পরীক্ষা নিয়েছে, জয়ী হয়েছে মতিলাল। চন্দ্রাবতীর শেষ খেলার আহ্বানে
মতিলাল অংশ নেয়নি। হীরালাল, পান্নালাল, লালচাঁদরা খেলায় অংশগ্রহণ করে কেউ মৃত
হয়েছে, কেউ আহত। খেলায় অংশ না নেওয়া মতিলাল জয়ী হয়েছে চন্দ্রাবতীকে পেয়ে। ইতিমধ্যেই
তাদের খেলায় মৃত হয়েছে বহু পাখি, বাসা ভেঙেছে, ব্যক্তিরও মৃত্যু হয়েছে, কিছু পাখি
ঘর ছেড়েছে, কেউ প্রেম জিতে নিয়েছে।
‘হিটকা’ (জলার্ক, ১৯৯৯) অনবদ্য গল্প। যে ক্যানভাসে ও
বয়ানে তিনি গল্পটি নির্মাণ করেছেন তা মুন্সিয়ানার দাবি করে। একাধিক ঘটনা, রাজনৈতিক
প্রসঙ্গক্রম, সময়ের গোলকধাঁধা, পার্টি রাজনীতি ও ব্যক্তির উত্থান-পতনকে একটা
চরিত্রের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। শ্রীপতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুমুখে
এগিয়ে গিয়েছিল। প্রেমিকাকে হারিয়ে, সম্পত্তি থেকে বিচ্যুত হয়ে ফাঁসি নিতে চেয়েছিল।
সেই ফাঁসির রাতে শ্রীপতিকে বাঁচিয়েছিল হিটকা। মাত্র একশ টাকার বিনিময়ে। বলা ভালো
হিটকার জন্যই সেদিন আত্মহত্যা করা হয়নি শ্রীপতির। হিটকাই শ্রীপতিকে বাঁচার স্বপ্ন
দেখিয়েছিল। সেখানে ছিল মিথ্যা বুজরুকি। তবে মিথ্যা বুজরুকিই শ্রীপতির জীবন ফিরিয়ে
দিয়েছিল মূল স্রোতে। আসলে এক মিথ্যাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময়,
রাজনীতি ও ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত। গল্পের ঘটনাক্রমে এসেছে বাম আমলের ক্ষমতার
আধিপত্যের কথা। বিরোধীপক্ষকে কীভাবে দুমরে দেওয়া হচ্ছে সেইসব কার্যকম। পার্টি
রাজনীতি, দলীয় রাজনীতি, লোকাল লিডার শ্রীপতিকে বারবার ব্যবহার করেছে। হিটকাই যেহেতু
শ্রীপতিকে বাঁচিয়েছিল তাই অগাধ বিশ্বার হিটকার প্রতি। সেই সুযোগ নিয়েছে হিটকা।
বারবার ঠকিয়েছে। নানা সময় গান্ধিজির চশমা, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, চন্দনকাঠের
লেনিন, সূর্যসেনের পিস্তল, চারু মজুমদারের ডায়েরি বিক্রি করেছে। এমনকি প্রতি
পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গান্ধিজির চমশা দিয়ে রাতে শ্রীপতি অরিজিনাল
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার চেষ্টা করেছে। ভারতবর্ষ মহান ঐতিহ্যময় দেশ। নানা
বিপ্লবী ও দেশনেতার নানা রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শ ছিল। স্বাধীনতার পর তাঁতে ফাঁক
ধরেছে। তেমনি রয়েছে মূল্যবোধহীন এক সময়ের কথা। যে কালগ্রাসী সময়ে বাঙালির সমস্ত
গৌরব হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। চুরি হয়ে গেছে গান্ধিজির চশমা থেকে রবীন্দ্রনাথের
নোবেল। চলছে প্রোমোটার রাজ। স্বপনের বারবার লক্ষ্য শ্রীপতির পুকুরের দিকে। আসলে
বিধ্বস্ত সময় পর্বকেই লেখক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সেই বিধ্বস্ত সময়ের কথা লিপিবদ্ধ
করতে তিনি কাহিনির কোলাজ গড়ে তোলেন। শেষে শ্রীপতির বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকতরা দেখে
পূর্বে যত বাড়িতেই ডাকাতি করেছে এই নকল নোবেল, লেনিন, সূর্যসেনের পিস্তল, ডায়েরি
দেখেছে। ডাকাতদের লক্ষ্য সোনা, টাকার দিকে। আসলে হিটকা এইভাবে সবাইকে প্রতারিত
করেছে। লেখকও তো হিটকা কাহিনিই গড়ে তুলতে চান। গল্পের প্রথমেই তা স্পষ্ট হয়ে
উঠেছিল। শুনে নেওয়া যাক লেখকের বয়ান থেকে গল্প সূচনার সামান্য অংশ—
"এ গল্পে হিটকা বলে একজন আছে, কিন্তু হিটকা কে, হিটকা কেন, এসব আমরা কিছু
জানি না। হিটকাকে আমরা প্রথম দেখি মিত্তির বাগানে, মিত্তির বংশের শেষ সলতে
শ্রীপত্তি মিত্তির সেদিন মাঝরাত্তিরে একগাছা দড়ি হাতে একা একা মিত্তিরবাগানে মরতে
এসেছিল। ফাঁস তখন তৈরি হয়ে গেছে, ডালে দড়ি ঝোলানো শেষ, নিজেকে শুধু ঝুলিয়ে ফেলা
বাকি। ঠিক এই রকম একটা সময়েই প্রথমবার আমরা হিটকাকে দেখি, দেখি মানে ভাঙা চাঁদের
ছেঁড়া জ্যোৎস্নায় খানিকটা আন্দাজ করে নিতে হয় আমাদের, লম্বা রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া
চুল, প্যান্ট শার্ট পরা একটা লোক।"
(হিটকা, তদেব, পৃ. ৩৫)
তবে শ্রীপতির মতো সবাইকে রক্ষা করেছিল কি না বা রক্ষা
করার সুযোগ পেয়েছিল কি না তা আমরা জানি না। তবে অনুমান করা যায় না বাঁচালে হিটকার
এই মিথ্যা বুজরুকি কে বিশ্বাস করবে? তবে হিটকা জানে কেউ কেউ এই বুজরুকি বিশ্বাস
করবে। তাই প্রতিবারেই সে বলেছে ‘আমার অন্য কাস্টমার আছে’। আসলে সময়টাই একটা
প্রতারিত হবার ফাঁদ পেতে রেখেছে। সেখানে ব্যক্তি নানা ভাবে প্রতারিত, বঞ্চিত,
শোষিত হবে। সেই শোষণের ধাপ ব্যক্তিভেদে পাল্টাবে। যুগে যুগে গান্ধিজি আসবেন,
লেলিনের সাম্যবাদ আসবে, চারু মজুমদারের লড়াই সংগ্রামের ডাক আসবে। সেই সমস্ত
প্রক্রিয়ার মধ্যেও থাকবে মানুষকে শোষণের, প্রতারিত করার ও হবার বাসনা, আকাঙ্ক্ষা,
চোরাবালি। আর যে সময়টা লেখকের যাপনচিত্র ও গল্পের পটভূমি সেই সময়টা নানাভাবে নষ্ট
হয়ে গেছে। সেই বিনাশবেলার যন্ত্রণা নানাভাবে উঁকি দেয় পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের
কাহিনিবিশ্বে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি
তোমাদের লোক’। বঙ্গীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শব্দটি কীভাবে ব্যবহার হয়েছে তা
কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমাদের লোক’ (জলার্ক ২০০৫) গল্পটি।
রবিদাস বারবার কুশল সম্পর্কে জানিয়েছে—‘স্যার আমাদের লোক’। গল্পের আখ্যানে
রাজনীতির ছোঁয়া আছে। তখন বঙ্গে বাম রাজনীতির আধিপত্য। স্বভাবতই কলেজের কর্মচারী
রবিদাস সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমনকি বিশ্বাস করে সেই রাজনীতির আদর্শ। ঘরে
লেনিন, কাকাবাবুর ছবি সেই সত্যই জানান দেয়। লেখক এক বহুস্তরীয় বিন্যাসের মধ্য দিয়ে
আখ্যান এগিয়ে নিয়ে যান। আছে প্রমোটার রাজ। জলা বুজে দিয়ে চলছে ফ্ল্যাট নির্মাণের
কাজ। রবিদাস কুশলের কাছে জমি বিক্রি করে। কিন্তু একটি শর্ত ছিল বট গাছকে যেন না
কাটা হয়। আসলে গাছে ছিল বহু পাখির আশ্রয়। কিন্তু স্থানীয় কাউন্সিলার সে কথা
শোনেনি। রবিদাসের অনুপস্থিতে তা কাটা হয়ে গেছে। বহু পাখির বাসা ও ডিম ভেঙে পড়েছে।
রবিদাস তখন চলেছে প্রেমিকা রেবাকে সুন্দরবনে পৌঁছে দিতে। কেননা সেখানে আজ
উপনির্বাচন। রেবাও হয়ত তাদের লোক। রবিদাস জমি প্রমোটারদের হাতে তুলে দিতে চায়নি।
কেননা প্রমোটাররা বট গাছটিকে রাখবে না তা সে জানতো। গাছকে কেন্দ্র করে এক ট্যাবু
ছিল রবিদাসের। ছিল এক বিশ্বাস—“ওই গাছটাকে আমি মাছেমধ্যেই স্বপ্নে দেখি স্যার,
বিশ্বাস করুন, স্বপ্নে ওই গাছ আমাকে নজরুল ইসলাম হয়ে গান শুনিয়ে যায় এক একদিন,
এক-একদিন পরিস্কার কাকাবাবু হয়ে এসে বলে, রবিদাস তুই আমাকে বাঁচা। বলে, আমি বড় হব,
আরও বড় হব—এখন আপনিই বলুন স্যার, বৌদি বলুন, ওই গাছ কি কেটে ফেলা যায়?” (আমাদের
লোক, তদেব, পৃ. ৫২) একদিকে রাজনীতিক বিশ্বাস, সাম্যবাদী আদর্শ, পার্টির প্রসার
অন্যদিকে পাখির আশ্রয়। পার্টি কীভাবে নিজেদের শেকড়-বাকড় জনমূল স্তরে পৌঁছে
দিয়েছিল, তেমনি আমাদের লোককে কীভাবে দলে টানা যায়, পার্টির প্রসার ঘটনা যায় তা
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে এইসব আখ্যানের মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশের এক বিশেষ সময় পর্বই
স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখক সচেতন ভাবেই তা লিপিবদ্ধ করেছেন। বট গাছের মতো পার্টিও যেন
মাটি আঁকড়ে থাকতে চাইছে—“শেকড়গুলো কিরকম আঁকড়ে আছে দেয়াল, স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স।
বেশ আর্টিস্টিক।“ পার্টি নিজের আধিপত্য ছড়িয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু বটগাছ কাটা হয়েছে
স্থানীয় কাউন্সিলার মারফত। বাম পার্টির পরিণতিও যেন সেখানেই চিহ্নিত হয়ে যায়।
|
জয়া মিত্র ও পুষ্পল মুখোপাধ্যায় |
অসম্ভব ভালো গল্প ‘কবুতর কথা’ (ভাষাবন্ধন, ২০০৮)। রূপকের
মধ্য দিয়ে শোষণ, রাজতন্ত্র, অত্যাচার, প্রজানাশ, ক্ষমতা ভোগ ও শেষে নিজেই ধ্বংসের
পথে এগিয়ে যাওয়া বড় হয়ে ওঠে। রাজনীতির পাঠ হিসেবে আখ্যানটি পড়া যেতে পারে। সময়
পরিসরের ব্যবধানে গল্পটি আরও সত্য হয়ে ওঠে। ক্ষমতা আছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে ক্ষমতার
বদল ঘটে গেছে। মাননীয় পাঠক মহাশয় যেসময় (২০০৮) গল্পটি প্রকাশিত সেইসময়ের
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চিত্র মনে মনে কল্পনা করুন। গল্পের বয়ানে পাই—“ক্ষমতা হাত
বদল হয়ে গেছে তলে তলে”। আবার সেনাপতি বলে—“দেশের রাজা যখন বেপথু হয়ে যায়, পায়রারা
এরকম মরে”। এইরকম নানা ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। ইতিহাসেও ক্ষমতাভোগী, অত্যাচারী
রাজার পতনের জন্য সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, আজকের স্বাধীন দেশেও যেকোন
অত্যাচারী রাজনৈতিক দলের পতনের জন্য প্রাণ দিতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত সাধারণ মানুষ
যখন গর্জে ওঠে তখন দিন বদলের পালা শুরু হয়। রাজা আজ দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের
বিদ্রোহের মুখে। কবুতর খেকো রাজা আসলে ছিল প্রজা নাশক। মন্ত্রী সেনাপতিরাও সাধারণ
মানুষের বিক্ষোভ দেখে দেখে নিজের অবস্থান পাল্টে ফেলেছে। সবাই হয়ে উঠেছে রাজার
বিরোধী। পুষ্পল মুখোপাধ্যায় গল্প অপেক্ষা সময় যাপনের যে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা তাই
চিত্রিত করে তোলেন। সামান্য কাহিনিকে সামনে রেখে কীভাবে শিল্পে উত্তীর্ণ হতে হয় তা
তিনি জানেন। আমাদের সময়টা ধ্বংস হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। সময়ের বুকে অজস্র পলি জমা
হচ্ছে। সেই ‘অজস্র’কেই একটা একটা আস্তরণ হিসেবে তিনি খুলে ফেলেন। এইসব গল্পে
কাহিনি অপেক্ষা সামাজিক ইতিহাসটা বড় আকার নেয়। যেমন ধরা যাক ‘হেবি পালাচ্ছেন, না?’
(জলার্ক, ২০১১) গল্পের কথা। এই আখ্যানে গল্প আছে, কিন্তু গল্পের পরতে পরতে তিনি
রাষ্ট্রের যাবতীয় ছলচাতুরির হিসাব নিকাশ যেমন ভেঙে দেন, তেমনি মানুষের রুচিবোধ,
সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির পালাকীর্তন, ভণ্ডবাজ মধ্যবিত্ত চরিত্রের যাবতীয় ন্যাকামি
স্পষ্ট করে তোলেন। পৌলমী ও অর্জুন চলেছে
পৌলমীদের গ্রামের বাড়ি পূজা উপলক্ষে। তাঁরা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ, বিবাহ বা রেজিস্ট্রারি
হয়নি। আজকের বাঙালির পূজা মানেই মদ্যপান। এই রুচিহীন বাঙালিকে ব্যঙ্গ যেমন করেন
তেমনি ধনঞ্জয়ের ফাঁসির প্রসঙ্গ এনে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক অবস্থান কোন পর্যায়
থেকে কোন পর্যায়ে নেমে গেছে তা স্পষ্ট করেন। ধনঞ্জয়ের ফাঁসি দ্বারাও ধর্ষণ রোধ করা
যায়নি বা যাবে না। শিক্ষিত অর্জুনদের মধ্যে যৌনসর্বস্ব ভোগবাদ প্রবৃত্তি রয়ে গেছে।
তেমনি কালিপূজা উপলক্ষে নন্দ লাইটিং এ দেখিয়েছে ধনঞ্জয়ের ফাঁসি। যা মেনে নিতে
পারেনি ঝণ্টু। কেননা দৃশ্য যৌনতার বহু প্রসঙ্গ ছিল। ঝন্টু থানায় গিয়েছিল। ইতিমধ্যে
থানায় মাওবাদী পোস্টার পড়েছে। ঝণ্টুকেও মাওবাদী ভেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। পুলিশ
প্রশাসন এখন মাওবাদী নিধনে ব্যস্ত তাই অন্য কেস নেয়নি। ডাকা হয়েছে পঞ্চায়েত।
পঞ্চায়েত নন্দের লাইটিংয়ের ওপর কিছু শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে। যেখানে রয়েছে রাজনীতির
রঙের খেলা, তেমনি মানুষের রুচিবোধকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে
ওঠে—
"শর্ত চাপিয়েছে, বলে লিঙ্গ দেখানো চলবেনি, কোমরদুলুনি বাদ, সবুজটুনির
বিচারককে লাল কত্তে হবে, লালটুনির গান্ধিকে সবুজ। এ ছাড়াও ফাঁসির দড়ির রং, পুলিশের
রং, পাটাতনের রং সব সবুজ পালটে লাল কত্তে হবে। সে-সব নয় করলাম লিঙ্গও নয় বাদ দিলাম
কেটে, কিন্তু কোমরদুলুনি? তা আমি ছাঁটি কেমন করে! পঞ্চায়েত বললে পাঁচের জায়গায়
একবার দেখাও, যে বোঝার সে ঠিক বুঝে নেবে।"
(হেবি পালাচ্ছেন, না?, তদেব, পৃ. ৮১)
এই ভণ্ড সভ্য সংস্কৃতির বার্তা যখন নির্দেশিত হচ্ছে ঠিক
আগের রাতেই অধ্যাপক অর্জুন যৌন হেনস্তা করেছে শালিকা পূজাকে। পূজা যৌন হেনস্তার
শিকার হয়েছে তবে কৌশলে বাঁচিয়েছে অর্জুনকে। সে প্রতিবাদ করেছে ব্যক্তিগতভাবে, বাড়ি
বা প্রতিবেশী কাউকে না জানিয়ে। ধনঞ্জয়দের ফাঁসি দিয়েও প্রবৃত্তি সর্বস্ব, কামুক
সর্বস্ব মানুষের রুচিবোধ, অতৃপ্ত যৌনবাসনাকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় নি। তেমনি নন্দের লাইটিংকে আমরা দেখতে পারি
দৃশ্য দূষণের অংশ হিসেবে। যা অর্জুনের মধ্যে এক অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল।
এইরকম দৃশ্যদৃষণ, বিজ্ঞাপনের আঁতলামি মানুষকে ক্রমেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
রুচিবোধ বিপন্ন বাঙালির মুখে ইংরেজি শব্দচয়ন, মদ্যপানের প্রবল আকর্ষণ ও হৃদয়ে
যৌনবাসনা এই নিয়ে গোটা সমাজটাই আজ ভয়ংকর বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়ংকর
পঙ্কিল স্রোতগুলিই পুষ্পল মুখোপাধ্যায় দেখতে পান ও তাঁর আখ্যানে ভেসে যায়।
|
রামকুমার মুখোপাধ্যায় ও পুষ্পল মুখোপাধ্যায় |
একজন লেখক গল্পের মধ্যে বহুস্তরে ভেসে যাবেন সেটাই
আমাদের প্রার্থিত। সেই স্তরের মধ্যে
সমসাময়িক সময়ের যন্ত্রণা, অত্যাচার, শোষণ, রাজনৈতিক চক্রান্ত, মানুষের
অন্ধবিশ্বাস, ধূর্ততা সব সমান্তরাল স্রোতে ভেসে যাবে। মুখোশধারী মানুষের যে বিবিধ
প্রবণতা, লোভ, নিজেকে সৎ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, অথচ সেই চেষ্টার আড়ালে লুকিয়ে
থাকা অসৎ প্রবৃত্তি যা ব্যক্তি মানুষ মুছে দিতে চান কিন্তু সমষ্টি প্রত্যক্ষ করে।
এইসব গোলকধাঁধাকে সামনে রেখেই মানুষ বাঁচে, বাঁচার স্বপ্ন দেখে। পুষ্পল
মুখোপাধ্যায়ের ‘ভয় করে’ (চতুষ্কোণ, ২০১৩) গল্প পড়তে গিয়ে উপরিউক্ত কথাগুলি মনে এল।
মধ্যবিত্ত মানুষ চায় আরও ক্ষমতা, ভোগবাদী জীবন, অর্থ। এই ভোগবাদী জীবন ও বড়লোক
হবার বাসনা তাঁকে করে দেয় বিবেকশূন্য, মূল্যবোধহীন, চেতনাহীন। এই গল্পে বহুস্তর,
বহু চরিত্রের নষ্টামি প্রাধান্য পায়। আসলে নষ্ট সময়টাকেই লেখক নানাভাবে প্রতিপন্ন
করতে চেয়েছেন। গল্পলেখক, অধ্যাপক মৃদুল মুখোপাধ্যায় যিনি ‘ভয় করে’ গল্প লিখেছেন তিনিও
অর্থের জন্য সত্যকে চাপা দিতে চেয়েছেন। শ্রীলেখা স্বপ্ন দেখেছে অন্ধ ভিখিরিকে বহু
অর্থ ও দান দিলে স্বামী সুস্থ হবে ও ভোটে অবশ্যই জয় লাভ করবে। গল্পে আছে ভিখিরি
ভূতো ভট্টাচার্যের কথা। যিনি জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অন্ধ। মামা বলেছিল অন্ধ
হবার ভান করলে ভিক্ষা ভালো জুটবে। কিন্তু অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হয়? ভূতো দেখেছে
শ্রীলেখাদের অবিশ্বাস, ভিখিরি অন্ধ কি না তা প্রমাণের চেষ্টা। সেখানেও সে জীবনকে
বাজি রেখে অন্ধত্বের পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিন্তু লালমোহন কর্তৃক ধর্ষণে আর নিজেকে
অন্ধ বলে গোপন রাখতে চায়নি। পুলিশ, মিডিয়াকে জানাতে চেয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত
অধ্যাপক মৃদুল না করেছে। কেননা ভূতো সেসব ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়ে অন্ধ নয় প্রমাণিত হলে
শ্রীলেখার দেওয়া টাকার অর্ধেক (দশ লক্ষ) হাতছাড়া হবে। ধর্ষণ দেখে যিনি ‘ভয় করে’
শব্দবন্ধে মিডিয়াকে স্টেটমেন্ট দেন, লিটল ম্যাগাজিনে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে
‘ভয় করে’ নামে গল্প লেখেন তিনিও একটি ধর্ষণের প্রকৃত আসামীদের আড়াল করে গেলেন
শুধুমাত্র অর্থের জন্য। হয়ত এই মৃদুলরাই আবার মোমবাতি মিছিলে নামবেন, মোমবাতি
শিল্পের প্রসার ঘটাবেন, গল্পে আবার লিখবেন—
"সব পুরুষই শালা প্রাক ধর্ষণ সংখ্যার সহ সম্পাদক, চান্স
পেলেই সম্পাদক হয়ে যাবে ধর্ষণ সংখ্যার।"
(তদেব, পৃ. ১০১)
যে মানুষ জীবনে খেতে পারে না, বাঁচতে পারে না তাদের
কতটুকু দোষ দেওয়া যায়? তাই ভূতো ভট্টাচার্যের দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। যে জীবনে
কোনদিন অর্থের মুখ দেখেনি, একবার সুযোগ পেয়েছে তা কি আর হাতছাড়া করা যায়? তবুও সে
ধর্ষণের সত্য প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিল অর্থের তোয়াক্কা না করেই। অথচ এই মৃদুলরা?
এঁরাই সমাজের আজ বড় প্রতরাক। এই মিডল ক্লাসই সমাজকে বিরাটভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে
যাচ্ছে এবং যায়। অথচ দোষ চাপিয়ে দেয় অন্যের ঘাড়ে। সেই ভণ্ড মিডল ক্লাসকে লেখক
তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন। শাণিত গদ্যে ভেকধারী মধ্যবিত্তের আপাত
সুখী জীবনযাত্রা ও সভ্যবেশের মধ্যে কোথায় ভণ্ডামি, আঁতলামি লুকিয়ে আছে খুঁজে বের
করেছেন। যা গল্পকে পৌঁছে দিয়েছে পৃথক মূল্যে।
‘দ্বিচিত্র’ (জলার্ক, ২০১৫) জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প। এক
নারী দুই পুরুষ। সময়ের জটিলতা যে নেই তা
নয়। আছে সূক্ষ্মভাবে। পাপিয়ার জীবনে দুই পুরুষ, বন্ধু অরিত্র, প্রেমিক
ইন্দ্র। নিম্নবিত্ত পাপিয়ার রাজরানি হবার স্বপ্নের গল্প। আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশার
গল্প। আছে ঠাকুমা ক্যাতায়নীর জীবনস্বপ্নের কাহিনি। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের
শ্রেণিচরিত্রের যে প্রভেদ তা স্পষ্ট হয়েছে। জীবনস্বপ্ন ও ভোগাকাঙ্ক্ষায় দুই শ্রেণির চিত্র লেখক অত্যন্ত সচেতনভাবে বুনে
চলেন। ইন্দ্র শুধু অর্থের প্রত্যাশী, অরিত্র শিল্পী মানুষ। ইন্দ্র পাপিয়াকেও
রাজনীতিতে নামাতে চেয়েছিল কিন্তু শেষে সে পড়াশুনায় ফিরতে চেয়েছে। সময়ের মন্থনজাল
থেকেই উঠে এসেছে লেখকের আখ্যান, আখ্যানে রূপায়িত চরিত্রগুলি। যে সময় বিভাজিকা
মানুষকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকারবোধ কেড়ে নিচ্ছে তাই
লেখককে ভাবিয়েছে। পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল সেটাই একজন লেখকের প্রকৃত কাজ।
আর সে কাজটাই তিনি করেছেন সচেতনভাবে। ‘নাটকীয়’ (জলার্ক, ২০১৭) গল্পে পশ্চিমবঙ্গের
একটা ভয়ংকর সময় প্রাধান্য পেয়েছে। মাওবাদী হামলা থেকে পাঠ্য তালিকায় গীতা
মহাভারতের অন্তর্ভূক্ত ঘটনা পর্যন্ত আখ্যান এগিয়ে গেছে। সরকার গণতন্ত্রের নামে
চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ মুখে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক
পদ্ধতি, মানুষের সেবা সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষিত হচ্ছে। এই গণতান্ত্রিক ঢ্যামনামি
প্রচারিত হচ্ছে দালাল মিডিয়ার দৌলতে। মানুষের নাটক করার অধিকার, সরকারের ভুল ধরার
অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আছে সুযোগ বুঝে বদলে যাওয়া মানুষ। যে মহাদেব কাকারা
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পথনাটক রচনা করেছিল সেই মহাদেবরাই সরকারের গুণকীর্তনে যাত্রা
করে চলেছে। গল্পের বয়ানে এসে উপস্থিত হয় পল পট (যিনি কৃষি সংস্কারের নামে
কম্বোডিয়ায় কুড়ি লক্ষ কৃষককে হত্যা করেছিলেন) থেকে হিটলার, মুসোলিনি। সেদিনের
‘রক্তকরবী’র রাজার অত্যাচার আজও চলছে। শুধু চরিত্রগুলি পাল্টে গেছে। তবে সব কিছু
নষ্ট হয়ে যায়নি। শৈবাল ফ্যাসিজম নিয়ে লিখছে, রঞ্জনদারা ফ্যাসিজম নিয়ে সংখ্যা করছে।
নবীন প্রজন্মের রামেশ্বর মহাতো, নিলেন রায়, তারক মণ্ডলরা এগিয়ে এসেছে। প্রত্যেকেই
নিজেদের কাজ করেও শোষণ, দূর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছে। অথচ
ফ্যাসিস্ট সরকার তো ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা বিরোধীতা করা লোক রাখতে চায় না। সে শুধু
বলে আমার পাশে থাকো। কিন্তু সচেতন মানুষ তো ফ্যাসিবাদ বা দুর্নীতিকে আপস করে নিতে
পারেনা। অবধারিত পরিণাম মৃত্যু। রামেশ্বর, নিলেন, তারকরা মৃত্যুর কবলে পড়ে।
সরকারের দূর্নীতির পাশাপাশি প্রতিনয়ত চলছে ধর্ষণ, খুন, চিট ফান্ডে মন্ত্রীর
কেলেঙ্কারি, চাকরিতে ঘুষ, বন্ধ, ধর্ণা, সাধারণ মানুষকে টুপি পড়ানো, জনহিতকর
প্রকল্পের নামে জনতোষণ, জনশোষণের নানা ফাজলামি। সরকার ও রাষ্ট্রের কী করা উচিত ছিল
আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই দুই বিন্দুর
মধ্যবর্তী পরিসরকেই পুষ্পল মুখোপাধ্যায় অঙ্কন করেছেন নানা আখ্যানে, নানা মাত্রায়।
কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নয়, সমর্থন-অসমর্থন নয়, রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত নয় নষ্ট
সময়টাই লেখককে বারবার আঘাত করেছে। আসলে গোটা সমাজব্যবস্থাটাই কীভাবে ধীরে ধীরে
ক্ষয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা তিনি টের পেয়েছেন। সেই যন্ত্রণা থেকেই, যেই
যাপনচিত্র থেকেই উঠে এসেছে এইসব আখ্যান।
নিজের পরিচয় কীভাবে দিতে হয় তা আমার জানা নেই। রবি ঠাকুরের মতো
তো আর বলতে পারি না আমি পৃথিবীর সন্তান। আমি মায়ের সন্তান। আত্মগত পরিচয়ের ঢাক-ঢোলের
মধ্য দিয়ে লেখক(অলেখক) হয়ে ওঠার যে বাসনা তা আমার ধাতে নেই। তবুও যখন আপনার একটা পরিচয়
চাই নইলে আপনি লেখা পড়বেন না, তবে বলা যেতে পারে এক বিধ্বস্ত সময়ের সন্তান আমি। বাঙালির
যখন সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নিজের বলে আর কিছুই থাকছে না সেই ধ্বংসকালে বড়
হওয়া অকালপক্ব যুবক আমি। এই পরিচয়ও শুনবেন না? তবে বাদ দিন। জরুরি সত্য +তথ্যের
ভিত্তিতে জানানো যেতে পারে পাঁচটি গ্রন্থ (নিজের লেখা তিন+সম্পাদনা দুই) ও একশোরও অধিক
প্রকাশিত প্রবন্ধের মালিক আমি।
সব বানানো গল্প
বিশ বছর ধরে প্রকাশিত
দিনবদলের দলিলগাথা এই বই। সামাজিক পরিসরের অন্তরে থেকেও যেন এক স্বাধীনজীবীর বৈঠকখানা । পাঠকের জন্য অবশ্য
সংগ্রহযোগ্য ।
- পৃষ্ঠাসংখ্যা - ১২৮ (বোর্ড
বাঁধাই, বুকমার্কার সহ)
- বিনিময় - ২২৫ টাকা (প্রিন্টেড)( নিজস্ব দপ্তর থেকে কিনলে ১৬০টাকা)
।। বইটি সংগ্রহ করুন
।।
- নিজস্ব পত্রিকা দপ্তর
- বইবাসনা (বর্ধমান) (যোগাযোগ - ৮৯১০৩২৩৫৬২)
- ইতিকথা বইঘর (কলেজ স্ট্রিট ও অনলাইন)
- ধ্যানবিন্দু (কলেজ
স্ট্রিট)
- কল্যাণ ঘোষের স্টল
(রাসবিহারি অ্যাভিনিউ)