Thursday, September 9, 2021

‘প্রথম প্রবাহ’: একজন নারীর হাতে নির্ণীত ভরতবংশের প্রাগেতিহাস

  লিখেছেন

সু ম ন   ব্যা না র্জি

ছবিঃ- ইন্টারনেট

মহাভারতের সত্যবতী চরিত্রটি পরিচিত হলেও অকর্ষিত। বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যে মহাভারত নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে অদ্যাবধি। কিন্তু মহাভারতের আদিপর্বের সত্যবতী চরিত্রটি নিয়ে এমন গভীর অন্বেষণ একালের বিশিষ্ট কথাকার সৌরভ মুখোপাধ্যায় বিরচিত 'প্রথম প্রবাহ' উপন্যাসের আগে বাংলা সাহিত্যে কখন দেখা যায়নি। 

মহাভারত মানেই শুধু কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে অভূতপূর্ব ও রোমাঞ্চকর যুদ্ধ , শ্রী কৃষ্ণের রণনীতি নয়। মহাভারতের মত, যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য, এত জটিল, গহন একটি কাব্যের মহিমা ও গতিপথকে অনুধাবন করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহাকাব্যের উৎসে। মহাভারত হল মহাকাব্য -- এই 'মহা' উপসর্গটি বিশেষ ব্যঞ্জনাবহ। বলা বাহুল্য যে, এটি ব্যক্তিক সুখ দুঃখের অনুভূতি বিজড়িত কাব্যকথা নয়, স্রষ্টার (স্রষ্টাদের) অনন্য নৈর্ব্যক্তিকতার গুণে এখানে সমাজ, ধর্ম, নীতি, নৈতিকতা, দর্শন সর্বোপরি রাজনীতির নানা পরত রয়েছে। সনাতন ভারতীয় পরম্পরার সমস্ত পদচিহ্নই মহাভারতে পাওয়া যায়।   

মহাভারতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক গ্রন্থ বললেও তা অমূলক বা অনৈতিহাসিক হয় না। কেন হয় না? বস্তুত সেই উত্তরকে অনুসন্ধান করাই এই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট। মহাভারতীয় রাজনীতির একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব হলেন সত্যবতী। এই চরিত্রটির গুরুত্বকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে সে নারী বলেই। ভারতীয় রাজনীতিতে যে নারীর ভূমিকা কতখানি সক্রিয় ছিল তা এই উপন্যাসটি (যার কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যবতী) পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

উপন্যাসটি মোট ষোলোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম দুই অংশে চেদিরাজ উপরিচয় বসু ও স্বর্গ গণিকা অদ্রিকার কথা রয়েছে। কিন্তু এখানেই রয়েছে তথ্যগত বিরাট ভ্রান্তি। মহাভারতের কাহিনি অনুসারে চেদি রাজের বীর্য শ্যেন পক্ষী নিয়ে যাবার সময় তা নদীতে পতিত হয় এবং তা পান করেই গর্ভবতী হন মৎস্যরূপা অদ্রিকা। অদ্রিকাকে গর্ভবতী অবস্থায় ধীবররাজ দাশরাজ পেয়েছিলেন।

বাস্তবিক পালিত পিতা হলেন ধীবররাজই। কিন্তু উপন্যাসে পাচ্ছি যে - মৃগয়া কালে রাজা বসু প্রেমাসক্ত ও কামমোহিত হয়ে পড়েন। এবং অদ্রিকারই গর্ভজাত সন্তান হল সত্যবতী। উপন্যাসকার কল্পনার আশ্রয়েই তাঁর মূল উপজীব্য বিষয়কে প্রকাশ করবেন এটাই খুব দস্তুর কিন্তু তথ্যগত এমন বিভ্রান্তি থাকাটা কাম্য নয়। 

এই উপন্যাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও কৌতুকপূর্ণ দিক হল গণেশ ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মধ্যেকার কথোপকথন। মহাভারত রচনাকালে অনুলেখক গণেশ ও কথক বেদব্যাসের পারস্পরিক শর্তের কথা মহাভারতের সব পাঠকরাই অবগত। বেদব্যাস যখন চেদিরাজ ও অদ্রিকার (উপন্যাস অনুযায়ী) কামকেলির বর্ণনা দিচ্ছেন তখন কিছুটা বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েই গণেশ জিজ্ঞাসা করছেন ব্যাসদেবকে যে - 

“এই আপনার মহান ভারতবৃত্তান্ত, কবীশ! ধর্মপরায়ণ নরপতি ইন্দ্রিয়ের ফাঁদে পড়ে বেশ্যাগমন করছেন - শ্লোকের পর শ্লোক জুড়ে এই কামতাড়িত অধঃপতনের কাহিনি শোনাচ্ছেন, হায়! ... কামই যে ধর্ম- অর্থ- মোক্ষ সব আচ্ছন্ন করে ফেলল দেখতে পাই।”

 প্রত্যুত্তরে বেদব্যাস বললেন যে - 

“এই ভরতবৃত্তান্ত বাস্তবিকই ব্যাপ্ত হয়ে থাকবে নরনারীর বহুস্তরীয় সম্পর্কে - দেহসঙ্গম তাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে - ... এই সঙ্গম থেকেই ভরতকথার জন্য হল...।” 

কামই যে কীভাবে মানবজীবনের আরও বৃহত্তর অর্থে রাজনীতি ও সমাজের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে তারই এক-টুকরো কাহিনি আকারে বিধৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। রাজক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই কাম ও যৌনতা ঘুরেফিরে আসছে নানান মাত্রায়। 

আবাল্য ধীবর গৃহে প্রতিপালিতা হবার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সত্যবতীর শরীর হয়ে উঠেছিল শক্ত ও কর্মক্ষম। যা ঠিক কমনীয় 'লবঙ্গলতিকাতুল্য' সৌন্দর্য নয়, এক রকমের দৃপ্ত ‘ক্ষত্রাণীসুলভ’ মহিমা ছিল শ্যামলী সত্যবতীর। বলাই বাহুল্য যে, সে বহন করছে রাজরক্ত। ঠিক এই কারণেই তাঁর মানসিক গড়নটি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা।  তাঁর গভীর বেদনা নিয়তির অদ্ভুত নিয়ম নিয়ে যে তাঁর সহোদর ভ্রাতা রাজপরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছে। সে পরে যুবরাজ ও রাজা হবে।  কিন্তু তাঁকে প্রতিপালিত হতে হচ্ছে দরিদ্র ধীবর পরিবারে নির্মম কষ্ট ও দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে ! অপ্সরার কন্যা বলেই কি সে ব্রাত্য? সমাজের অদ্ভুত অনুশাসন যে একজন অপ্সরাকে ভোগ করা যায় কিন্তু তাঁর গর্ভজাত সন্তানকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।  ঔপন্যাসিক এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই শকুন্তলার প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন দাসরাজের বয়ানে যে - শকুন্তলাও বিশ্বামিত্রের সন্তান কিন্তু অপ্সরার গর্ভজাত বলেই তিনি স্বীকার করেননি। এমনকি সেই শকুন্তলাকে গোপনে দুষ্মন্ত বিবাহ করল অথচ অনেক কষ্ট করে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হল। ধীদীপ্ত সত্যবতী সঙ্গে সঙ্গে বলে যে - শকুন্তলার পুত্র ভরতই আর্যাবর্তের রাজবংশের জনক ছিল।  বর্তমান উত্তরপুরুষ মহারাজ শান্তনুর মধ্যেও সেই অপ্সরাজাত শকুন্তলারই রক্ত বইছে। 

দাসরাজ অনুমান করে সত্যবতীকে বলেন যে - তুই কি চাস না কোন ধীবর-পরিবারে বিবাহিত হতে? আনমনা সত্যবতী বলে যে - 

“আমার কানের মধ্যে কে যেন বারবার বলে, এ জীবন তোমার জন্য নয়...এই যে-জীবন তুমি কাটাচ্ছ ...! তোমার ভাগ্য লেখা আছে অন্যত্র, হয়তো বিশাল বিপুল কোনও রাজপুরীর ছায়াময় অলিন্দে ... জটিল ও মহান কোনও ঘটনার আবর্ত তোমাকে বন্দি করার অপেক্ষায় রয়েছে ... এক আশ্চর্য অবিস্মরণীয় নাটক বহু দূরে স্থির হয়ে আছে, শুধু তুমি গিয়ে পর্দাটুকু ওঠাও!”  

হয়তো এই কারণেই বলা হয় রক্ত কথা বলে। ধীবররাজের অনুমান অমূলক ছিল না। যুবরাজ দেবব্রত'র প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন সত্যবতী। সে তাঁর নিজের জন্ম বৃত্তান্ত অনাবৃত করে দেবব্রতের কাছে।  কিন্তু সে যেহেতু অপ্সরার গর্ভজাত তাই দেবব্রত দ্বিধান্বিত ছিলেন। সে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে আর্য বংশের রীতি নয় ধীবরপল্লি থেকে রাজবধূ সংগ্রহ করা। তৎক্ষণাৎ সত্যবতীও শকুন্তলার দৃষ্টান্ত আনয়ন করেছিল। যদিও দেবব্রতের একথা অজানা ছিল না যে ‘নিম্নবংশজাত’ সুকন্যাকে বধূ করে আনতে শাস্ত্রমতে কোন বাধা নেই। আর গান্ধর্ব বিবাহ তো শাস্ত্রসম্মত। উল্টোদিক থেকে একথাও সত্য যে সত্যবতীর রূপ,গুণ, মর্যাদা, ব্যক্তিত্বের অনন্য গুণে দেবব্রত নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট হয়েছে হয়েছিল। সে প্রকৃতই রাজবধূ হবারই যোগ্য।  কিন্তু দেবব্রতের কাছে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাশীরাজের জ্যেষ্ঠ দুহিতা অম্বার প্রতি তাঁর প্রণয়।  অর্থাৎ সে বাগবদ্ধ। সত্যবতী যখন তাঁর রূপের বর্ণনা চান তখন তা দেয় দেবব্রত। আসলে প্রেমে ব্যর্থ অভিমানিনী ক্রুদ্ধ সত্যবতী তাঁর মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিল।  তাঁর মনে হয়েছিল দেবব্রত তাকে বারবার বিদ্রুপ করছে; প্রথমে বংশ মর্যাদা নিয়ে দ্বিতীয়বার তার শরীরের মৎস্যগন্ধ নিয়ে। 

কিন্তু বাস্তবিক তো দেবব্রতের সেরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যা সত্য সে সেটাই অকপটে ব্যক্ত করেছিল সত্যবতীর কাছে। কোন ছল চাতুরি বা কামমোহিত হয়ে সে সত্যবতীকে গ্রহণ করেনি। এতে তার প্রেমাস্পদ অম্বার বিশ্বাস ও ভালোবাসার চূড়ান্ত অবমাননা হত। সে তো অন্যান্য রাজাদের মত ছিলেন না। এমনকি তার পিতা শান্তনুর মতোও নন। ঠিক এখানেই দেবব্রত অনন্য-সাধারণ।  কিন্তু মহাভারতের সবচেয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত পুরুষ কর্ণ। ভরতবংশের প্রাক্-ইতিহাসে সত্যবতীর সঙ্গে বাধা পড়ে গেলেন তিনিও। এরপর সত্যবতী একের পর এক লোভ ও স্বার্থের নীরব দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন তাঁর সঙ্গে। যার কারণ সেই সময় জেনেছিল শুধু তাঁরা দু'জনেই কিন্তু ছিল অপ্রকাশিত। এখান থেকেই কাহিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিল। 

রপরের ঘটনা প্রবাহকে আমরা মোটের ওপর সংক্ষেপে আলোচনা করব, 

। ক।   পরাশর মুনি ও সত্যবতীর মিলনে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম।  দীর্ঘদিন নারী সঙ্গ বিবর্জিত মুনি সত্যবতীর রূপ দেখে চূড়ান্তভাবে কামমোহিত হয়ে পড়েন। সত্যবতীও নিজেকে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন তাঁর কাছে। এটাই সত্যবতীর প্রথম যৌন ও শারীরিক সংসর্গ হলেও উদ্দেশ্য নিছকই যৌনতৃপ্তি ছিল না।  তিনি একরকম পরাশর মুনিকে ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন। মুনির আশীর্বাদেই তাঁর শরীর থেকে মৎস্যগন্ধ দূরীভূত হয় এবং সুগন্ধের অধিকারীণী হন। বহু দূর থেকে যে গন্ধ পাওয়া যেত।  পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ যৌবনেরও অধিকারী হন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় যে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছিল মুনির আশীর্বাদে বা যোগবলে তা হল ভরতবংশে প্রবেশের অধিকার -

 

“এত শতবার এই যমুনা নদীতে যাত্রীদের পারাপার করিয়েছিল সে -- কিন্তু তার অঙ্গযমুনাতে একটি যাত্রীকে একবার খেয়া পার করিয়েই তো সারা জীবনের পারানি মিলে গেল তার!”  

 সত্যবতীর জীবনতরী এবার এক অভূতপূর্ব বাঁক নেবার মুখে।

 । খ।   সত্যবতীকে দেখে শান্তনুর কামাসক্ত হয়ে পড়া, দাসরাজের অঙ্গীকার যে সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান ভিন্ন কেউ সিংহাসনের অধিকারী হবে না, পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য দেবব্রতের সিংহাসন ত্যাগ, সত্যবতীর কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়ে (কারণ সে আশঙ্কা করেছিল যে ভবিষ্যতে যদি জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রতের পুত্রেরা সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি করে !) দেবব্রতের আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার সংকল্প।

 প্রাথমিকভাবে সত্যবতীর সমস্ত ইচ্ছার বৃত্তই পরিপূর্ণ হল। এখন প্রশ্ন হল এত কিছু করে সত্যবতীর লাভ কী হল? তাঁর তো রাজবধূ হবার পথে তো ভীষ্ম কোন বাধাই দেননি! আসলে এখানে তীব্রভাবে কাজ করেছে সত্যবতীর প্রবল যৌন ঈর্ষা। আসলে মহারাজ শান্তনুকে সে বিবাহ করলেও তিনি তাঁর প্রণয়ীনি নন। তাঁদের বয়সের ফারাক ছিল অনেক। এই বিবাহ ছিল সত্যবতীর কাছে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার একটা হাতিয়ার। ভীষ্ম যখন আমাত্যের মুখে শুনেছিলেন যে তাঁর পিতা কোন এক ধীবর কন্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং বিবাহেচ্ছু তখনই বিচক্ষণ ভীষ্মের সত্যবতীর ভবিষ্যতের রূপরেখা বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

 আসলে সত্যবতী ভালোবেসেছিল (এবং আমৃত্যুই ভালোবেসেছিল) দেবব্রতকেই।  কিন্তু একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি তাঁদের প্রণয়ের সমস্ত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেয়। সত্যবতীর অন্ধত্ব ও একরোখা মনোভাবই এই ঘটনার জন্য ঐকান্তিকভাবে দায়ী। সে তখন থেকেই মনে মনে এই প্রতীজ্ঞায় অবিচল ছিল যে - আমি যেমন আমার প্রেমাস্পদকে পাইনি তেমনই আমিও ভীষ্মের প্রেমকে পরিণত হতে দেবো না।  এবং সে তাইই করে দেখাল। এই ছিল সত্যবতীর নীরব প্রতিশোধ। নিয়তির কী অদ্ভুত লিখন - যার হবার কথা ছিল পুত্রবধূ সে হল রাজবধূ ও ‘রাজমাতা’, প্রেমাস্পদ হল পুত্রতুল্য ! সত্যবতীর রাজবধূ হওয়া ইস্তক ভীষ্ম ‘রাজমাতা’ বলেই দস্তুর মাফিক সম্বোধন করত। আসলে এই ‘রাজমাতা’ শব্দবন্ধটির মধ্যে যে প্রচণ্ড মর্মঘাতী ব্যঙ্গের তীরটি আছে তা আঘাত করত সত্যবতীকে। ভীষ্মের অন্তরে যে পর্বতপ্রমাণ যন্ত্রণা ও বেদনা পুঞ্জীভূত হয়েছিল এবং তাঁর সমগ্র ভবিষ্যতের সমুজ্জ্বল সম্ভাবনা বিনষ্টীভূত হয়েছিল  শুধু এই সত্যবতীর জন্য তার অভিপ্রেত প্রতিশোধটুকু ভীষ্ম এইভাবেই তুলত। আর তা নীরবে সহ্য করতে হত সত্যবতীকে।  শুধু দু'জন নর-নারীর মধ্যে ক্ষমতার এই অসম ও অদৃষ্টপূর্ব প্রতিযোগিতা গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকে এক ক্রান্তিলগ্নে এনে দাঁড় করায়।

 । গ।  কিন্তু এও বাহ্য।  সত্যবতীর লক্ষ্য ছিল যত শীঘ্র সম্ভব পুত্রোৎপাদন।  কিন্তু বয়স্ক রাজার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছিল না।  তাই কবিরাজি গুপ্তৌষধি প্রয়োগ করে দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম দেন সত্যবতী।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু'জনেই ছিল যৌনক্ষমতা রহিত। কবিরাজ বলেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রের যৌনক্ষমতা কুড়ি বছরের পর থেকে কমতে থাকবে।  কবিরাজকে এই কথা গোপন রাখতে বলা হলেও তাকে পরে গুম খুন করা হয়।  কিন্তু সে ভীষ্মকে এইসব কথা বলে গেছিলেন। নিয়ম (অস্যার্থ হিসাব) অনুযায়ী রাজা হন অপরিণত মনস্ক দুর্বিনীত চিত্রাঙ্গদ। হঠাৎ একজন গন্ধর্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।  এই মৃত্যু কি ছিল কিছুটা কাঙ্ক্ষিত এবং একই সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পিত? মূল উদ্দেশ্য কি ছিল রাতারাতি যৌন অক্ষম চিত্রাঙ্গদকে সরিয়ে বিচিত্রবীর্যকে রাজা করে উত্তরাধিকার আনা? কারণ সত্যবতী দ্বিধান্বিত ও শঙ্কান্বিত ছিলেন যে বিচিত্রবীর্য যদি উত্তরাধিকার দিতে না পারে তাহলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এত দিনের লালিত ইচ্ছা সব বিফলে যাবে। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রহস্য ভীষ্মের মনে প্রশ্ন তুলে ছিল। কিন্তু এর উত্তর মহাভারতে পাওয়া যায় না। উপন্যাসকার খুব সুন্দরভাবে এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করে পাঠকের আগ্রহকে উস্কে দিয়েছেন।

 । ঘ।  প্রায় বাল্যাবস্থাতেই বিচিত্রবীর্যের (ইতিমধ্যেই সে সিংসাসনে আরূঢ়। এবং বলাই বাহুল্য সে অযোগ্য ও নামমাত্র শাসক) বিবাহ দেওয়া হল। কাশীরাজের স্বয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে আনা হল তাঁর তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে।  তাঁর ক্ষাত্রোচিত পরাক্রমে মনে মনে তিন কন্যাই অভিভূত হয়েছিলেন।  স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভেবেছিলেন যে ভীষ্ম তাঁদের বিবাহ করবে।  কিন্তু বাস্তবটা তাঁরা তখনও জানতেন না। অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হল।  কিন্তু সন্তান সে দিতে পারল না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত যৌন সংসর্গের ফলে (কিছুটা বিকৃতকামও বটে। তাঁর নাম থেকেই তির্যক ইশারা পাওয়া যায়) তাঁরও অকালপ্রয়াণ ঘটল। গোটা ভারতবংশ এক অভূতপূর্ব ও বিচিত্র সঙ্কটের মুখে পড়ল।  এবার সিংহাসন সামলাবে কে ?

 সত্যবতী যে স্বপ্নের সৌধটি নির্মাণ করেছিল নিয়তি যেন বারবার তা চুরমার করে দিচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা (বস্তুত লোভ), স্বার্থমগ্নতা শুধু তাঁকে নয়, গোটা রাজবংশকে এই বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি করেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের তৈরি করা সমাধি ক্ষেত্রেই। এবার কী হবে? কারণ তখন উপায় একটাই ভীষ্মকে রাজা করে দেওয়া। এক্ষেত্রে সত্যবতী যদি তাঁর শর্ত তুলে নেয় তবেই তা সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি তা হতে দেবে সত্যবতী? কারণ তাহলে তো তাঁর এতদিনকার সমস্ত শ্রমই বিফলে যাবে! সে তা হতে দিল না কারণ --

 

“যে-দেবব্রতর বংশগৌরবে কালিমালেপন করার মানসে সত্যবতী ভরতজাঙ্গালে অনার্য রক্তধারা প্রবাহিত করলেন, সেই দেবব্রতর বীর্যই আবার ফিরিয়ে আনবে আর্য গরিমা? তার আত্মজদের হাত ধরেই আবার স্বপথে প্রত্যাবর্তন করবে বিপথগামী গৌরবমহিমার উত্তরাধিকার?”

 হ্যাঁ ঠিক এটাই ছিল তাঁর অন্তর্নিহিত অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য। তিনি অনার্য রক্ত আরো নির্দিষ্ট করে বললে দাসরক্তকে অনুপ্রবিষ্ট করাতে চেয়েছিলেন ভরতবংশে।

 ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়ানমিক ক্যারেক্টার সত্যবতী ছিল বস্তত তাই।  ভাগ্য বা নিয়তি তাঁকে যতবার কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে সে ততবারই অভিনব এক একটি অভাবনীয় পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেছে। সে যেন কিছুতেই ভাগ্যের কাছে হার মানবে না। সে অংশত হলেও সফল হয়েছে।

 কেন বলছি এ কথা? কেননা এরপর তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন তাঁর কুমারীবস্থায় গর্ভবতী হবার কথা।  তাঁর পুত্র বেদব্যাসের কথা তিনি বললেন।  স্বীয় পুত্রকে প্রতিপালন না করলেও তাঁর অলৌকিক যোগশক্তি ও অতুলনীয় মেধার কথা শুনেছিলেন।  তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর এই কানীন পুত্রই পারে এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ দিতে। এটাই ছিল তাঁর শেষ তূণ, শেষ অস্ত্র।  বেদব্যাসের ঔরসেই গর্ভবতী হয়েছিল অম্বিকা ও অম্বালিকা।  এবং একজন দাসী।  এঁদেরই পুত্র যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর।  এঁদের জন্ম নিয়ে বিস্তারে আমরা যাব না।  শুধু এটুকু স্মরণযোগ্য যে বিদুর বাদে বাকি দু'জনেই ছিলেন শারীরিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। সবচেয়ে লক্ষণীয় শূদ্র দাসীর গর্ভেই জন্ম নিলেন সবচেয়ে প্রাজ্ঞ,ধীমান, দীর্ঘায়ু ও ধার্মিক বিদুর। একথা ঠিক যে সত্যবতী পূর্ণ সফল হলেন না কিন্তু দাসরক্তকে ঘুরে পথে আর্য বংশে প্রবাহিত করিয়েই ক্ষান্ত হলেন। মহাভারতের স্রষ্টা বেদব্যাসের ধমনীতেও তো সেই দাসরক্ত বইছে।  কাজেই এই চরিত্রটি মহাভারতের এক অনস্বীকার্য স্তম্ভ।  একজন নারীর অস্খলিত ধৈর্য নাছোড়বান্দা মনোভাব গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকেই ওলটপালট করে দিল। সরলরৈখিক গতিকে জটিল করে দিল।  প্রস্তুত হল ভবিষ্যৎ কুরু ও পাণ্ডবের দীর্ঘ কুটিল সংগ্রামের ক্ষেত্র।  যার যবনিকাপতন ঘটবে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে।  কিন্তু সে অন্য ইতিহাস !

 শেষ করা যাক উপন্যাসকারের উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও একটি দৃশ্যকল্প দিয়ে,

 । এক। ধীদীপ্ত গণেশ প্রশ্ন করছেন বেদব্যাসকে অম্বিকা ও অম্বালিকা গর্ভবতী হলেন কিন্তু সাধারণ নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছা আবেগকে বলি দেওয়া হল রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে; কার্যত বলাৎকার করাই হল তাঁদের। বেদব্যাস কি নিযুক্ত হলেন না সেই ধর্ষণকারী পীড়কের ভূমিকায়? এর কোন উত্তর তিনি দিলেন না। মহাভারতে এই কূট প্রশ্নের কোন উত্তর নেইও। আরো একটি বিব্রতকারী প্রশ্ন করলেন আপনি জিতেন্দ্রিয় ও কখনো রমণী সংসর্গ না করেই এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে প্রথম সঙ্গমেই গর্ভাধান! বেদব্যাস বললেন অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে রতি শাস্ত্রও আমাকে পড়তে হয়েছে। ঔপন্যাসিক কৌতুককে আর একটু বাড়ানোর লক্ষ্যে গণেশের বয়ানে বললেন যে - নিশ্চয়ই দ্বীপের অধিবাসী কোন রমণী আপনার কাছে এই শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে ‘কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে আর যে-কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য আসুক, শয্যায় তা সম্ভব নয়।’

 । দুই।  উপন্যাসের শেষে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চুরমার হয়ে যাওয়া সত্যবতীকে পাই। একজন নারী নিজের হাতে গড়ে তোলা পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় যেন নিজেই বন্দি হলেন।  সমাজে এক শ্রেণির নারীর স্বাধীনতা, সম্মান এবং এমনকি ক্ষমতাও যে কতখানি ছিল তাঁর স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে সত্যবতীর মধ্যে।  এ যেন এক অন্য সত্যবতীর ছবিকে অনবদ্যভাবে প্রতিকায়িত করেছেন লেখক।  যাঁর হাত ধরে গোটা ভারতবংশের ইতিহাসের এক অপ্রত্যাশিত মোড় ঘুরে গেল।  নির্মিত হবে কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের পটভূমি। যার যবনিকা উত্তোলিত হবে কুরুক্ষেত্রে কিন্তু সে তো অন্য ইতিহাস।

সুমন ব্যানার্জি



Sunday, September 5, 2021

ময়না-বাঈ থেকে যশোদা-মাঈ - একটি উত্তরণের কাহিনি

  লিখেছেন

 সু ম না   সা হা


ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে রাজত্ব করেছেন বহু রাজারাজরা। কেউ কল্যাণ-কর্ম দ্বারা প্রজারঞ্জক রূপে মানুষের হৃদয়-সিংহাসনে স্থান পেয়েছেন, কেউ বা বেহিসেবী ভোগে জীবন অতিবাহিত করেছেন, কেউ বা অত্যাচারী-প্রজাপীড়ক রূপে কালের কষ্টিপাথরে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তবে অধিকাংশ রাজা ও সম্রাটরা ছিলেন গুণগ্রাহী, নৃত্যগীতাদি কলার পৃষ্ঠপোষক। বহু প্রসিদ্ধ গায়ক-গায়িকা, নর্তকী ও কলাকারের জীবন ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না। কিন্তু জীবনে যখন ঘটে মহাজীবনের সংযোগ, তখন সে-জীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। এমনই এক রাজনর্তকীর জীবন ধন্য হয়েছিল পরশমণির ছোঁয়ায়, শিবাবতার স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং যাঁকে ‘মা’-এর আসন দিয়েছিলেন।             

খেতরিরাজের ওয়াকত রেজিস্টার মতে, মহারাজা অজিত সিংহ ১৮৯১ সালের ৪ জুন থেকে ২৩ শে জুলাই পর্যন্ত প্রায় দু’মাস আবুপাহাড়ের খেতরি হাউসে অবস্থান করছিলেন। তারপর স্বামীজীকে সঙ্গে নিয়ে মহারাজা খেতরিতে উপস্থিত হন ৭ই আগস্ট ১৮৯১। পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা জানিয়েছেন (মুনসি জগমোহনলালের কাছ থেকে তিনি যেমন শুনেছেন)— 

“৯ই আগস্ট ১৮৯১, রবিবার রাজকর্মচারীরা মহারাজাকে সেলাম আলম (অভিবাদন) জানাতে জমায়েত হয়। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে রাজাসাহেব এলে রাজস্থানী নিয়মানুসারে রাজকর্মচারীগণ তাঁকে নজরানা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হয়। স্বামীজী মহারাজার সঙ্গে বেলা ২ টা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। মহারাজা বিকালে টেনিস খেলতে যান। সন্ধ্যার সময় তিনি পার্ষদসহ ফিরে দোতলার দেওয়ানখানার ছাদে বিশ্রাম নিতে আসেন। এই দোতলা সংলগ্ন তিনতলার কুটিরটি নির্ধারিত ছিল স্বামীজীর জন্য। তখন সন্ধ্যা সাতটা। মহারাজা স্বামীজীকে আহবান জানালেন। স্বামীজী দোতলার বারান্দায় উপস্থিত হলে উভয়ে শাস্ত্র-আলোচনায় মগ্ন হন। এমতাবস্থায় একদল নর্তকী মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। (ওয়াকতনামা থেকে আরও জানা যায় যে, একদল নর্তকী তথা সঙ্গীতজ্ঞা রাজদরবার কর্তৃক প্রতিপালিত হতো। সকলের নাম পাওয়া না গেলেও রাজবাড়ির নর্তকীগোষ্ঠীর তিনজনের নাম পাওয়া গেছে—ময়নাবাঈ, ভামরিবাঈ ও জানকিবাঈ)। ঐ দলের নেত্রী মহারাজাকে বলেন, তিনি কি মহারাজার কাছে একটি ভজন গান গাইতে পারেন? (পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন, ‘সমাগত নর্তকীয়োঁ কে দল কী এক সুগায়িকা নে জিসকা যৌবন সুলভ চাপল্য প্রৌঢ়তা কী গম্ভীরতা কে রূপ মে বদল চুকা থা, গানা সুনানে কী আজ্ঞা মাগী’, পৃষ্ঠা-৫৮) মহারাজা নর্তকীকে সম্মতি জানালে ময়নাবাঈ বীণা হাতে সুরদাসের ‘হমারে প্রভু অবগুণ চিত ন ধরো’ ভজনটি গাইতে আরম্ভ করেন। স্বামীজী তখন সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। কিন্তু ময়নাবাঈ-এর গানের কলি তাঁর গতি শিথিল করে। তিনি ফিরে আসেন এবং আসর বসে গায়িকার ভজন শোনেন।”

সন্ন্যাসীর পক্ষে ঐরকম নাচগানের আসরে উপস্থিত থাকা অনুচিত, এই যুক্তিতে স্বামীজী গানের আসর থেকে উঠে যাচ্ছিলেন, মর্মাহত হয়ে গায়িকা যেন স্বামীজীর কথার নীরব প্রতিবাদস্বরূপ সুকণ্ঠে গান ধরলেন—‘প্রভু, হমারে অবগুণ চিত না ধরো/সমদরশী হ্যায় নাম তিহারো, অব মোহে পার করো।’ গানের ভাষা রাজস্থানী হিন্দি হলেও স্বামীজী তা ভালোই বুঝতেন, আর সঙ্গীতের তিনি আজীবন রসগ্রাহী। গানের মধ্যে দিয়ে গায়িকা এই কথাই বললেন, 

‘তুমি যে সন্ন্যাসী, সমদর্শীত্ব সাধুর ধর্ম। লোহার বঁটি—তা দিয়ে ঠাকুরঘরে পূজার নৈবেদ্যর ফল কাটা হয়, আবার ব্যাধের ঘরে ঐ বঁটি মাংস কাটার কাজে ব্যবহার হয়—এতে বঁটির কি দোষ? পরশমণি ছুঁয়ে দিলে উভয়ই সোনা হতে পারে। অতএব, হে প্রভু, তুমি আমার দোষ দেখো না!’ 

সঙ্গীতের এই হৃদয় মন্থনকারী অপূর্ব মর্মার্থ স্বামীজীকে আকুল করে তুলল। তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ নারী মাত্রই জগন্মাতার প্রকাশ দর্শন করতেন, এমনকি পতিতা ও কুচরিত্রা রমণীর মধ্যেও তিনি জগজ্জননীকেই দর্শন করেছিলেন। স্বামীজীর এক সত্য উপলব্ধি হল—‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—এই হল অদ্বৈত অনুভূতির চরম লক্ষ্য। এক ব্রহ্ম বিরাজিত সর্বত্র—ভেদবুদ্ধি কল্পনা মাত্র। অতএব তিনি সঙ্গীতের আসরে উপস্থিত হলেন। গান সমাপ্ত হলে তিনি ঐ বাঈজীকে ‘মা’ সম্বোধন করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন, 

‘মা, আমি অপরাধ করেছি, আপনাকে ঘৃণা করে উঠে যাচ্ছিলাম। আপনার গানে আমার চৈতন্য হল।’ 

পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন, 

‘গানা সমাপ্ত হুয়া, স্বামীজী গদ্গদ হো গয়ে। উনকে নেত্র সে অশ্রুধারা বহ্ চলী। স্বামীজী কে মুঁহ্ সে তৎকাল নিকল পঢ়া—ওহ, ইস পতিতা স্ত্রী নে এক ভক্ত কা পদ গাকর ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—কে তত্ত্ব কো হৃদয়ঙ্গম করা দিয়া হ্যায়। ... উসকে বাদ উস গায়িকা কো স্বামীজী নে ‘জ্ঞানদায়িনী মা’ কহকর সম্বোধন কিয়া, বেশ্যা কা হৃদয় সে নিকলা ভাবগর্ভিত আশীর্বাদ ‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল’।  

‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের বিবরণ অনুসারে, পরে এই ঘটনার উল্লেখ করে স্বামীজী বলেছিলেন, 

‘গানটি শুনে আমার মনে হল, এই কি আমার সন্ন্যাস? আমি সন্ন্যাসী, অথচ আমার ও এই নারীর মধ্যে আমার ভেদজ্ঞান রয়ে গেছে, সে ঘটনাতে আমার চোখ খুলে গেল। সর্ব বস্তু সেই এক সত্তার অভিব্যক্তি জেনে আমার আর কাউকে নিন্দা করার জো ছিল না।’

ঘটনাটি সামান্যই, কিন্তু রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা ও ভারতীয় সনাতন ধর্মে সন্ন্যাসীর উচ্চ আদর্শ বুঝবার পক্ষে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বামীজী পেলেন সকল নারীতে মাতৃদর্শনের বাস্তব পাঠ। আর ময়নাবাঈ কী পেলেন? তিনি স্বামীজীর মধ্যে পেলেন তাঁর ‘নন্দলালা’-কে। সেদিনই গান সমাপ্ত হলে স্বামীজী যখন তাঁকে ‘মা’ সম্বোধন করেছিলেন, ময়নার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত আশীর্বাণী ঝরে পড়ে—‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল!’ (ঐ, পৃষ্ঠা-৬০)। স্বামীজীর অন্তরের শ্রদ্ধাসঞ্জাত সেই ‘মা’ ডাক নারীর চিরন্তন মাতৃত্ববোধের মর্মমূল স্পর্শ করেছিল, আর সেই মায়ের আশীর্বাদ যে কতদূর সত্য হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বামীজী লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন ও থাকবেন যুগ যুগ ধরে। আর নন্দলালার সঙ্গে বেঁচে থাকবেন তাঁর যশোদামাঈ। ময়নার জীবনের পরবর্তী পর্ব খুব লোকই জানে। পরশমণির ছোঁয়ায় লোহা সোনা হয়ে যায়। আর ময়না ছিলেন ভক্তিমতী এক সুরসাধিকা। তাই অতি অনায়াসে তাঁর জীবনে প্রবেশ করেছিল বিবেকানন্দ নামক সেই উজ্জ্বল-ভাস্করের জ্যোতিকিরণ। যে গবাক্ষ-পথে এল সেই কোটি-ভানু-কিরণ, কৃপা-দাক্ষিণ্যের দক্ষিণাপবনবাহী সেই বাতায়নটি উন্মোচন করেছিলেন অবশ্যই খেতরি-রাজ অজিত সিংহজী।

আমরা চলে যাই ময়নাবাঈ-এর জীবনের ফ্ল্যাশ-ব্যাকে। জয়পুরের মেয়ে সরমা কাংক্ষানিয়া ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে ভাগ্যের ফেরে পৌঁছে যায় চাঁদপোল বাজারে কেরামতি বাঈজীর কাছে। বাঈজী তাকে সস্নেহে লালন-পালন করে নাচ-গানে তালিম দিতে থাকেন। যৌবনে সঙ্গীতে ও নৃত্যে অসামান্যা পারদর্শিনী সরমা ‘ময়নাবাঈ’ নামে হয়ে ওঠেন বাঈজী সমাজে ‘আনমোল-হীরা’। কোনও রাজাই এমন গুণী শিল্পীর কদর করতে পারবেন জেনেই কেরামতিবাঈ তাকে পাঠালেন যোধপুর রাজদরবারে। ময়নাবাঈ যোধপুর রাজপ্রাসাদে ঠাঁই পেলেন। যোধপুর রাজ-পরিবারের গুরু ছিলেন আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী। এই সংবাদ পেয়ে রাজগুরু দয়ানন্দজী ময়নাবাঈ-এর যোধপুরে অবস্থান না-মঞ্জুর করে দিলেন। যোধপুররাজ এমন গুণী শিল্পীকে হারাতে চাননি, কিন্তু রাজগুরুর নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধাও দেখাতে পারেননি। তাই পাশের রাজ্যের প্রিয় বন্ধু খেতরির রাজা অজিত সিংহজীকে অনুরোধ করেন ময়নাবাঈ-এর দায়িত্ব নিতে। অজিত সিংহ ছিলেন দক্ষ বীণাবাদক ও প্রকৃত সঙ্গীত-রসজ্ঞ। তিনি ময়নাবাঈ-এর প্রতিভাকে সম্মান জানালেন এবং রাজ্যে নবাগতা এই শিল্পীর বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। খেতরি রাজ্যে শুরু হল ময়নাবাঈ-এর নতুন জীবন—রাজার খাস গায়িকা রূপে উৎসবে অনুষ্ঠানে বিশেষ পালাপার্বণে তার ডাক পড়ে রাজদরবারে, সঙ্গীতলহরী পরিবেশন দ্বারা রাজা, রাজ-অতিথি ও অমাত্যবর্গের মনোরঞ্জনের ফরমায়েস হয়। অন্যান্য সময়ে শহরের নির্দিষ্ট বাসগৃহে ফরমায়েসী সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। দিনগুলো এমনি করেই কাটছিল। গজল-ঠুমরী রেওয়াজের সুরে মুখরিত, আতর-গুলাব সুবাসিত ময়নাবাঈ-এর বাড়ি খেতরি রাজ্যের জোয়ান-মদ্দ সকলেরই পরিচিত।

কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে ময়নার জীবনের বাঁক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রচনা করছিলেন। ময়নার গান শুনে, বেদান্তের ‘প্র্যাকটিকাল’ পাঠ হৃদয়ঙ্গম করে সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষির চোখ ভরে এল জলে, তিনি ময়নাকে ডাকলেন ‘মা’ বলে—সন্ন্যাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত সে সম্বোধন কেবল কথার কথা নয়, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত সত্য, তা যেন ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ আসার মতোই ময়নার অন্তরের সুপ্ত মাতৃত্বের রুদ্ধ দুয়ারে হানলো আঘাত! তার মনোরাজ্যে জলপ্রপাতের অঝোর ধারার মতো আরম্ভ হল বিপুল আন্দোলন।



এরপর দ্বিতীয়বার স্বামীজীর খেতরিতে আগমন বিশেষ উপলক্ষে। তখন বিশ্ব-ধর্মমহাসম্মেলনে যোগদান করতে স্বামীজীর পাশ্চাত্য যাত্রার আর খুব বেশী দিন বাকি নেই। কিন্তু যাত্রার আগে একবার তাঁকে খেতরিতে পদার্পণ করতেই হবে—শিষ্য, পরম হিতৈষী, অনুরাগী সুহৃদ রাজা অজিত সিংহ-এর এই অনুরোধ তিনি কি করে ফেলবেন? স্বামীজীর আশীর্বাদে অপুত্রক রাজা ও রানীর পুত্রসন্তান লাভের দীর্ঘকালের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, ছেলে জয়সিংহ-এর জন্মোৎসবে যোগদান করে স্বামীজী শিশুপুত্রকে আশীর্বাদ করবেন—খেতরি রাজের একান্ত বাসনা। সেই উপলক্ষ্যে অল্পসময়ের জন্য স্বামীজীকে খেতরিতে ধরে এনেছেন অজিত সিংহ-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মুন্সি জগমোহন। সেইবার ১৯ দিন খেতরিতে ছিলেন স্বামীজী—২১ এপ্রিল থেকে ১০ই মে, ১৮৯৩। সেই জন্মোৎসব উপলক্ষে সুসজ্জিত পান্নাতালাব সরোবরে একটি সুশোভিত নৌকার উপরে নিমন্ত্রিত রাজন্যবর্গসহ উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মহারাজা এবং ভজন পরিবেশনকারী নর্তকীদের দল। সেখানেই জগমোহনলাল স্বামীজীকে নিয়ে রাজসকাশে উপস্থিত হলেন, রাত্রি দশটা পর্যন্ত নৌকায় অবস্থান করে মহারাজা ও স্বামীজী পান্নাতালাব ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। সেদিনও স্বামীজী প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন ময়নাবাঈ-এর সুরেলা কণ্ঠের গীতসুধা। সব কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার পরে স্বামীজী জয়পুর হয়ে বোম্বাই রওনা হলেন।

ময়নাবাঈ-এর কণ্ঠে গীত সুরদাস রচিত একটি ভজন স্বামীজীর খুবই প্রিয় ছিল, ‘দয়ানিধে তেরি গতি লখি ন পরে/ধর্ম অধর্ম, অধর্ম ধর্ম করি,/অকরণ করণ করৈ’। এই গানটি ও ময়নাবাই-এর কণ্ঠে তাঁর প্রথম শ্রুত ভজনটি, ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত না ধরো’, যেটি তাঁর সকল নারীতে মাতৃদর্শনের পাঠ সম্পূর্ণ করেছিল—দুটিই তিনি নিজের নোটবই-এ টুকে রাখেন ও পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিব্রজনকালে অনুরুদ্ধ হয়ে গেয়ে শোনাতেন। ‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’ নিবন্ধে স্বামী বিদেহাত্মানন্দ লিখেছেন, ‘স্বামী অখণ্ডানন্দজী বলেন, স্বামীজী যখন জুনাগড়ে ছিলেন, তখন ঝান্ডুভটজী স্বামীজীর কণ্ঠে ‘দয়ানিধে তোরি গতি...’ ভজনটি শুনে কেঁদেছিলেন। জামনগরে শংকর শেঠ প্রতিদিন ভজন শোনার জন্য মূলজী নামে জনৈক ব্রাহ্মণ গায়ককে বহাল রেখেছিলেন। মূলজী স্বামীজীর স্নেহধন্য এবং স্বামীজীর কাছ থেকে বহু ভজন রপ্ত করেছিলেন। কাথিওয়াড় ভ্রমণকালে অখণ্ডানন্দজী এক সম্পন্ন গ্রামে হাজির হলে তিনি মূলজীর কণ্ঠে ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’, ‘দয়ানিধে তোরি গতি’ এবং ‘শশধর তিলক ভাল গঙ্গা জটাপর’ গান তিনটি শুনেছিলেন। বলা বাহুল্য এই গানগুলি স্বামীজীর কাছ থেকেই মূলজীর শেখা। ১৮৯৩ সালে মাদ্রাজে মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে স্বামীজী ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’ ভজনটি গেয়েছিলেন। ডঃ এম সি নাজুন্ডা রাও তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘সাগরতটে চাঁদিনী রাতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল থেকে এক অপরূপ জ্যোতি বিকীর্ণ হতো। সেই সময় তিনি হৃদয়স্পর্শী ভজন গাইতেন। সেই ভজনগুলির মধ্যে ‘দয়ানিধে তেরী গতি লখি ন পড়ো’ বিশেষ স্মরণীয়।’    



১৮৯৭ সাল, ডিসেম্বর মাসে স্বামীজী খেতরি এলেন তৃতীয় বার। সেবার মহারাজাও ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ও তাঁর গুরু বিবেকানন্দও পাশ্চাত্যবিজয় সম্পন্ন করে স্বদেশে ফিরেছেন। খেতরিবাসী মহারাজাসহ রাজগুরু স্বামীজীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পান্নাতালাব সংলগ্ন ময়দানে ১২ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। স্বামীজী ও অন্যান্য কেউ কেউ সেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপরে রাজনর্তকীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ময়নাবাঈ। স্বামীজী আগাগোড়া রাজাজীর সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।  

ময়না স্বামীজীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের আবেদন জানালো রাজাজীর কাছে। স্বামীজীর সম্মতি পেয়ে ময়না এল, দর্শন ও প্রণামান্তর প্রকাশ করল তার অন্তরের আকুল প্রশ্ন—‘স্বামীজী, মেরে লালা, আমাদের কি মুক্তি হবে না?’ এর ঠিক কয়েক দশক আগে ‘চৈতন্যলীলা’ পালা দর্শনে চৈতন্যের সাজে বিনোদিনী-কে দেখে যখন আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—‘আসল-নকল একাকার দেখলাম!’ এই একই আকুল প্রশ্ন ধ্বনিত হয়েছিল নটী বিনোদিনীর কণ্ঠে। পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ নটী বিনোদিনীকে দিয়েছিলেন উদ্ধারের মন্ত্র—‘বল্ মা, গুরু হরি হরি গুরু!’ স্বামীজী ময়নার সংশয় দূর করে উত্তর দিলেন, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে সকলের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কেবল তাঁর স্মরণ-মনন কর!’ ময়না আরও জানতে চায়—‘মনের সংশয় অশান্তি কিভাবে দূর হবে লালা?’ স্বামীজী নিদান দিলেন, ‘তীর্থভ্রমণ কর এবং সাধ্যমত অনাথদের সেবা কর। তাহলেই অফুরন্ত আনন্দ ও শান্তির সন্ধান পাবে।’

স্বামীজীর আশ্বাস পেয়ে ঘুচে গেল ময়নার মনের সংশয়ের আঁধার-মেঘ। তীর্থভ্রমণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তাঁর মন। মহারাজা অজিত সিংহ তাকে অনুমতি দিলেন, পাথেয়ও জোগালেন। ময়নাবাঈ তার বান্ধবী ভামরিবাঈকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তীর্থদর্শনে। গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে তাঁরা পৌঁছালেন নৈনিতাল। সেখানেই তখন অবস্থান করছিলেন ময়নার জীবন-দেবতা। এক মন্দিরে সে সংবাদ তাঁরা পেলেন। অনেক সন্ধান করে অবশেষে স্বামীজীর সাক্ষাৎ মিলল। সিস্টার নিবেদিতা তাঁর The Master As I Saw Him গ্রন্থে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন— 

‘আমরা নৈনি সরোবরের উপর অবস্থিত একটি মন্দিরে দুই বাঈজীকে পূজায় রত দেখিলাম। পূজান্তে তাহারা আমাদের নিকট আসিল এবং আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় তাহাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিলাম। স্বামীজী তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে অস্বীকার করায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মনোমধ্যে একটা আন্দোলন চলিয়াছিল, কিন্তু স্বামীজী গ্রাহ্য করেন নাই।’ 

ভামরিবাঈ জানিয়েছেন, তাঁরা তীর্থদর্শনকালে স্বামীজীকে দর্শন ও প্রণাম করেছিলেন এবং স্বামীজী তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন। তীর্থ পর্যটন সেরে ময়নাবাঈ ও ভামরিবাঈ আবার গতানুগতিক জীবনস্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন।

এরপর তাদের জীবনে পরপর ঘটে গেল দুটি হৃদয়বিদারী দুর্ঘটনা। ১৯০১ সালে একটি দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত হলেন তাদের পরম শুভাকাংক্ষী অভিভাবক রাজা অজিত সিংহজী। পরের বছর আরাধ্য দেবতা স্বামীজীও পরমধামে যাত্রা করলেন। শোক-বিহ্বল ময়নাবাঈ কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন খেতরি ছেড়ে পা বাড়ালেন অনির্দিষ্টের পথে। খেতরির প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা গেছে যে তাঁরা ময়নাবাঈকে বৃন্দাবনে ভিখারিনীর বেশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। সেখানে তিনি ভজন ও কীর্তন গেয়ে ভিক্ষা করতেন, ভিক্ষালব্ধ অর্থে কয়েকটি অনাথ বালককে পালন করতেন। স্বামীজীকে জীবনের ধ্রুবতারা করে তিনি তাঁর নির্দেশেই পথ চলছিলেন। ঐ অনাথ বালকরা ময়নাকে ডাকত ‘দেবী মা!’ ময়নার জীবন মাতৃত্বের সুধায় ভরে উঠেছিল। বালকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে খেতরি থেকে তিনি ভামরিকেও নিজের কাছে আনিয়ে নিয়েছিলেন। দুই সখী মিলে বহু পরিশ্রমে সেই অনাথ-আশ্রমটি চালাতে থাকেন। এর অনেক পরে বৃদ্ধাবস্থায় ময়না অসুস্থ হয়ে পড়লে ময়নার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ভামরি তাঁকে খেতরির পুরনো আস্তানায় রেখে আসেন। 

স্বামীজীর সঙ্গে যখন ময়নার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তখন সে ২১ বছরের পূর্ণ যুবতী। খেতরি রাজের বদান্যতায় খেতরি সবজিমাণ্ডির পাশে কানুরিয়া হাভেলি-তে বাঈজীদের বসবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। ঐ এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা যায়—‘এই বাঈজী কুটিরটি কোন অজানা যাদুস্পর্শে পালটে গিয়েছিল, সেখানে মুজরোর ঘুঙ্গুর-ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে বেজে উঠেছিল শংখঘণ্টা। সন্ধ্যায় আতরগন্ধের বদলে ছড়িয়ে পড়েছিল ধূপের গন্ধ। সুরেলা চটুল সঙ্গীত হারিয়ে গিয়েছিল ভক্তিরসাশ্রিত কৃষ্ণ-আরাধনার ভজনে। শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রীমা-স্বামীজীর পট স্থাপন করে তাঁদের সাধনভজনেই শেষের দিনগুলো যাপন করেছিলেন বৃদ্ধা সাধিকা ময়না।

১৯৬২ সালে ৯২ বছর বয়সে স্বামীজীকে, তাঁর ‘নন্দলালা’-কে স্মরণ করতে করতে ময়নাবাঈ থেকে যশোদামাঈ-এ উত্তীর্ণা এই সাধিকা রামকৃষ্ণলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ কথা—‘আমার কোন ভয় নেই, আমার কোন আকাংক্ষা নেই, আমার কোন দুঃখ নেই—স্বামীজী যে মেরা নন্দলালা।’ শাস্ত্রবাণীর চিরন্তন সত্য মূর্ত হয়েছিল তাঁর জীবনে—‘অভী’-তে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন তিনি, নির্বাসনা হয়েছিলেন, তিনি দুঃখের তিমির-রাত্রি পেরিয়ে অনন্ত আনন্দলোকের ভূমিতে বসতি গড়েছিলেন—কারণ অবতীর্ণ ঈশ্বর স্বামী বিবেকানন্দকে তিনি পুত্র জ্ঞান করেছিলেন।

এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে একটি জীবন ‘বিবেকানন্দ সূর্য’-এর কিরণে স্নাত হয়ে মানবজীবনের পরম সার্থকতা লাভ করেছিল।

 

সুমনা সাহা

তথ্যসূত্র—

  • Swami Vivekananda: A forgotten Chapter of His Life—Beni Shankar Sharma; Sharman Publishers, 1963
  • ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’, স্বামী গম্ভীরানন্দ, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠা-৩৩৯-৪০); উদ্বোধন কার্যালয়, মে ১৯৮৪।
  • উদ্বোধন পত্রিকা, আশ্বিন-১৪২০, নবম সংখ্যা (সেপ্টেম্বর-২০১৩); ‘স্বামীজী-সান্নিধ্যে রাজপুতানার তিন কন্যা’—তড়িৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • ‘বিবেক জ্যোতি’ পত্রিকা; নিবন্ধ—‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’—স্বামী বিদেহাত্মানন্দ; জুলাই-সংখ্যা, ২০০৬।
  • রাজস্থান মে স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা, মিলাওয়াড়া সংস্কৃতি প্রকাশন, নিউ দিল্লী,    (প্রথম প্রকাশ-১৯৮৯)


Thursday, September 2, 2021

রাজ্য ভাগের রাজনীতি ও অন্যান্য

 লিখেছেন

শু ভ জি ৎ   পা ত্র


ভারতবর্ষে রাজ্য ভাগ কিংবা নতুন রাজ্যের সৃষ্টি মোটেই কোনো অভিনব বিষয় নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই ১৮৯৫ সালে বিহার রাজ্যের ওড়িয়াভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল। ওড়িয়া জাতীয়তাবাদী নেতা মধুসূদন দাসের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন সফলতা অর্জন করে ১৯৩৬ সালে পৃথক ওড়িশা রাজ্য গঠনের মধ্যে দিয়ে। তারপর ভারতের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত তৎকালীন মাদ্রাজ রাজ্যের তেলুগুভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল এবং সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৫৩ সালে তেলুগুভাষীদের নিজস্ব রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে তামিলভাষীদের জন্য তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হয়। 

এই রাজ্যগুলি গঠনের পেছনে কাজ করেছে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি,সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ করবার আকাঙ্ক্ষা। তাই ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের এই ন্যায্য দাবি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালে,সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপরেও এই আইনকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন নতুন রাজ্য গড়ে উঠেছে।  ২০০০ সালে বিহারের একটি অংশ আলাদা ভাবে ঝাড়খণ্ড রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। একই বছর উত্তরপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয় উত্তরাখণ্ড রাজ্য। ২০১৪ সালের ২ জুন তেলুগুভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলা নিয়ে গড়ে ওঠে তেলেঙ্গানা রাজ্য। এই নতুন রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই।

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠেছে। অতি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের সাংসদ জন বার্লা উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করবার দাবি জানিয়েছেন,সেই দাবিকে সমর্থন করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়,বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ঝাড়গ্রাম,বিষ্ণুপুর,দুই মেদিনীপুর সহ জঙ্গলমহলকে পৃথক রাজ্য করার দাবি জানিয়েছেন। তবে এই দাবিগুলি কি জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন?নাকি নেহাত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!বলাই বাহুল্য,সমগ্র উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে দিয়ে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের দাবি নয়। আসলে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিটা দার্জিলিং জেলার গোর্খা জনগোষ্ঠীর মানুষদের।  ১৮১৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালের রাজার একটি চুক্তি হয়,যা সুগাউলি চুক্তি নামে খ্যাত। 

সেই চুক্তি অনুযায়ী নেপালের অধিকারে থাকা হিমাচল প্রদেশ,সিকিম ও দার্জিলিং ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। সেই সময় কিন্তু দার্জিলিং জেলায় মাত্র চারটি লেপচা পরিবার ছিল,কোনো গোর্খা পরিবারের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৩৫ এর কাছাকাছি সময় ইংরেজরা সেখানে চা-বাগান গড়ে তোলে এবং সেই সূত্রে শ্রমিক হিসেবে নেপালের গোর্খা নামক জেলার বাসিন্দারা দার্জিলিং এ আসতে থাকে। এই দার্জিলিংও ১৭৬৭ সালে মাল্লা রাজাদের অধিকারে ছিল। ভারতভুক্তির পূর্বে চিরকালই যে দার্জিলিং নেপালের অধিকারে ছিল,একথাও ইতিহাসসম্মত নয়।  স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে,১৯৫০ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে নেপাল সরকারের একটি অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি ভারতের হাতে চলে যাওয়া অংশগুলিকে নেপালে ফিরিয়ে এনে 'গ্রেটার নেপাল' গড়ে তোলার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। গড়ে ওঠে ইউনিফায়েড ন্যাশনাল ফ্রন্ট।

(সম্পাদকীয় সংযোজন - এই বিষয়ে ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওটিও নিচে দেওয়া হল (মোবাইল মোডে না দেখা গেলে, প্রদত্ত লিংক অথবা পেজের শেষে 'ওয়েব ভার্সন'-এ ক্লিক করুন।) 

লিংকঃ- শুভজিৎ পাত্রের ইউটিউব ভিডিওর লিংক, ক্লিক করুন।



এই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গ্রেটার নেপালের যে ম্যাপ প্রকাশ করা হয় তার সঙ্গে দার্জিলিঙের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের প্রস্তুত করা মানচিত্রের অদ্ভুত মিল রয়েছে। অর্থাৎ পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যগঠন এদের চূড়ান্ত দাবি নয়,ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেপালের অন্তর্ভুক্ত হওয়াই এদের গোপন পরিকল্পনা। তাই এদের পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিকে আমল দিলে বড়ো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও কোচবিহার জেলায় মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে গ্রেটার কোচবিহার বা কামতাপুরী আন্দোলন। তাদেরও দাবি পৃথক কামতাপুর রাজ্য গঠন। কিন্তু কতখানি যৌক্তিক এই দাবি?ইতিহাস তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়,অতীতে এই কোচবিহার জেলাটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে,এবং এই চুক্তির মধ্যে দিয়েই কোচবিহার ইংরেজদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ভারত স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের তৎকালীন রাজা কোচবিহারকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। এবং তার পর থেকেই কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলাতে পরিণত হয়। এখানে কামতাপুরী ভাষা ও জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হয়েছে ১৯৬৯ ও ২০০৮ সালে। 

কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কামতাপুরী কোনো ভিন্ন ভাষা নয়,বাংলা ভাষার রংপুরী উপভাষার উন্নত এক বুলি। তাছাড়া বর্তমানে ভূভারতে কামরূপ রাজ্যের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ফলত পৃথক ভাষা ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে পৃথক রাজ্যের দাবি এখানে তেমন পোক্ত নয়। ১৯০৫ সালে ইংরেজরা আঞ্চলিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গ করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই অপচেষ্টার পেছনে সক্রিয় ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল বাংলাকে দুর্বল করে দেওয়া। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের সৌভ্রাতৃত্বের জন্য রাখিবন্ধন উৎসব পালন করেন,বাংলার প্রতিটি ঘরে পালিত হয় অরন্ধন। 

এই আন্দোলনের ফলে ভাঙা বাংলা সংযুক্ত হয় ১৯১১সালে। কিন্তু সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃবিচ্ছেদ ঘটে ১৯৪৭ সালে। এই বিভক্তি যে বাংলার অর্থনৈতিক,সামাজিক প্রগতিকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল তা বাঙালি মাত্রেরই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। তাই রাজ্য ভাগ উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। বরং অতি ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে,রাজ্য সরকারের স্বল্প বাৎসরিক রাজস্বের কারণে নিজস্ব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। ফলে সেই রাজ্যগুলির অতিরিক্ত কেন্দ্র-নির্ভরতা বেড়ে যাবে। যা আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের পক্ষেও ক্ষতিকর। তাই সুষম উন্নয়ন যাতে রাজ্যের সর্বত্র পৌঁছতে পারে সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।


শুভজিৎ পাত্র



Monday, August 30, 2021

ভ্যাকসিন এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’, অতএব সম্বল ‘রাখে হরি মারে কে’

 লিখেছেন 

অ নি ন্দ্য   ভ ট্টা চা র্য


আমেরিকার পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর প্রায় ফাটা রেকর্ড বাজানোর মতো নিত্য আওড়ে গেছেন যে কোভিড১৯ আসলে একটি ‘চীনা ভাইরাস’। অর্থাৎ, চীন থেকেই এর উৎপত্তি, এবং যেহেতু চীনাদের খাবার-দাবারের কোনও মা-বাপ নেই, অতএব, এমনতর ‘নিকৃষ্ট’ মানবজাতির দেহেই এইসব অলুক্ষণে ভাইরাস বাসা বাঁধতে পারে। সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ যে, আসলে কোভিড১৯ ভাইরাসটি চীনের উহান পরীক্ষাগারে তৈরি। বলাই বাহুল্য, ‘শ্বেতাঙ্গ’ জাতির স্বঘোষিত অকলুষতা ও অন্যান্য জাতির প্রতি তাদের এক শ্রেণি মানুষের যে বহমান ঘৃণা- তাকে চাগিয়ে দিতেই এইসব কু-রটনা। তার সঙ্গে ছিল কোভিড মোকাবিলায় ইউরোপ সহ আমেরিকার সার্বিক ব্যর্থতা ও দিশাহীনতা এবং চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-প্রযুক্তিগত দ্বৈরথে তাদের পিছিয়ে পড়া হেতু ঈর্ষাকাতরতাও। 

এ হেন চাপানউতোরের মধ্যেই সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে কোভিড১৯ ভাইরাসের উৎস সন্ধানে আমেরিকার উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি’র রিপোর্ট। কমিটির সমস্ত সদস্যদের মতৈক্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে যে কোভিড কোনওভাবেই কোনও জৈবাস্ত্র নয়। এই ভাইরাস জেনেটিকালি ইনজিনিয়ার্ড নয় বলেও এই কমিটি মনে করেছে। কমিটি’র  অভিমত, কোনও প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে অথবা এও হতে পারে যে উহান গবেষণাগারে সার্স-কোভ২’এর সংক্রমণে এই ভাইরাসের উদ্ভব ও ছড়িয়ে পড়া। 

নানা মুনির নানা মত ও বিতর্কে কোভিড১৯ নিয়ে বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসক, রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে সাধারণ নাগরিক সকলেই যারপরনাই চিন্তিত ও বিপুল পরিমাণে বিভ্রান্ত। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস এইভাবে মানব প্রজাতির গোটা কুলকে এমন পরাভূত করে রাখতে পারে, বিজ্ঞানদর্পী মানুষের সম্ভবত সে ধারণার আঁচটুকু পর্যন্ত ছিল না। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল আকচাআকচি। সাধারণ মানুষ পড়েছেন মহাবিপদে। এক দল বলছেন, আপনি যদি ভ্যাকসিন নেন, তাহলে আপনি মহামূর্খ; আরেক দলের মত, ভ্যাকসিন না নিয়ে আপনি শুধু মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন না, হীনতারও স্বাক্ষর রাখছেন, কারণ, আপনার ভ্যাকসিন না নেওয়ার ফলে আপনার চারপাশের মানুষজন বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। ‘শ্যাম রাখি না কুল’- এই আতান্তরের মধ্যে ডেনমার্ক সরকার কোভিড-সংক্রান্ত সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ওদিকে আমেরিকায় যথেষ্ট ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও নতুন করে আবারও দ্রুত হারে কোভিড সংক্রমণ ছড়ানোয় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, যারা ভ্যাকসিন নেননি তাঁরাই আক্রান্ত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন তাহলে ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ গড়ে ওঠার যে গল্পটা ছিল তার কী হল! 

যারা ভ্যাকসিনের প্রবল পক্ষপাতী তাঁরা এতদিন ইজরায়েলকে দেখিয়ে বলে আসছিলেন যে সে দেশ ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল আর তাই সেখানে নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ নেই। এই বছর এপ্রিল মাস নাগাদ তথ্য দিয়ে দাবি করা হচ্ছিল যে ইজরায়েলে দৈনন্দিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে। অথচ কী আশ্চর্য! ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। ২৮ অগস্ট’এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েলে নতুন করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গড়ে দৈনন্দিন আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫০০’এরও বেশি। তাহলে, হচ্ছে টা কী? 

তবে এও বাস্তব, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ হিসেব যে সময়টাকে আমাদের দেশে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই সময়টায় সরকারি হিসেবেই অন্তত ২ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা নাকি ১০-১২ লক্ষের কাছাকাছি। হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নেই, স্থানাভাবে মৃত মানুষের দেহ দাহ বা কবরস্থ করার উপায় নেই, গঙ্গা বা নদীতে শয়ে শয়ে লাশ ভাসছে- এই কঠোর বাস্তবের ছবি তো আমরা দেখেছি। এত মৃত্যু কেন? হতে পারে, এত বিশাল সংখ্যক মানুষ এক সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছেন যে ন্যূনতম চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবের জন্যই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়াটাও তো চরম আশঙ্কার দিক। বিশেষ করে আমাদের মতো একটি জনবহুল দেশে তা আরও বেশি বিপদের। সেটুকুকে কি রোধ করার কোনও উপায় আমাদের হাতে ছিল না? উত্তর ভারতের কুম্ভমেলায় যে বিশাল লোকসমাগম অথবা পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে সভা-সমাবেশে মানুষের ঢল- এর জন্যই কি কোভিডের সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ছড়ায়নি? অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তো কোভিডের প্রকোপ বেশ কম ছিল। অথচ, অসম নির্বাচনের পর পরই দেখা গেল যে সে রাজ্যে ব্যাপক ভাবে কোভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তা কি নিতান্তই কাকতালীয়? 

তাই, অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও লকডাউনের যে নিদান দেওয়া হয় তা কি ভুল, শুধু ভুল? একদিকে বলব, ফেব্রুয়ারি ২০২০’তে আহমেদাবাদে মোদির ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত থেকেই কোভিড এ দেশে মহামারির আকার নিয়েছে এবং দ্বিতীয় তরঙ্গেও তা আবার ফিরে আসার কারণ কুম্ভমেলা ও রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনের জমায়েত, আবার অন্যদিকে বলব, মাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে, সামাজিক দূরত্ব বিধি বা লকডাউন আসলে ডিজিটাল সংস্থার মুনাফাকে ত্বরান্বিত করার ষড়যন্ত্র- হরেদরে ঠিক কী বলতে চাইছি, জানি তো? তবে এও বাস্তব, লকডাউনের ফলে গরিব মানুষের রুটি-রুজির এক অভাবনীয় সমস্যা তৈরি হয় বা হয়েছে। এ সম্পর্কে এক বড় সংখ্যক অর্থনীতিবিদেরা পরিষ্কার নিদান দিয়েছেন যে প্রত্যেক অভাবী মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে, দরকার পড়লে নোট ছাপিয়েও। সেও এক পথ বটে। 

কিন্তু আমরা যারা নিতান্তই ছাপোষা সাধারণ জন- আমরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করব? এখানেই বিভ্রান্তির বিস্তার। এ বিষয়ে ডাঃ অরুণ সিং’এর একটি ভাষণ বেশ মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন, ভাইরাস আমাদের পূর্বপুরুষ, তারা আমাদের ধরবে না, তা হবার নয়। কিন্তু তারা ধরলেও, আমরা কিছুটা ভুগে-টুগে হলেও শেষমেশ বেঁচে থাকব- এই দিকটা হয়তো নিশ্চিত করা যায়। আর তার উপায় হল, আমাদের শরীরে যে কো-মর্বিডিটি আছে সেগুলোর সুধার করাটাই আসল নিদান। অর্থাৎ, আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ অথবা হার্টের কোনও ব্যারাম কিংবা কিডনির অসুখ থাকে, আপনি সেই সব যাতনা থেকে বরং সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। কোভিড যদি আপনাকে ধরেও, তা আপনার বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু কো-মর্বিডিটি থাকলে আপনার প্রাণ সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। দ্বিতীয়ত, বাইরে বেরলে মাস্ক পরে নেওয়াটা এমনিতেও ভাল বলেই মনে হয়। কারণ, বাতাসে এমনিতেই যা দূষণ তাতে একটা মাস্ক হয়তো আমাদের সকলকে সাহায্যই করবে। জাপানে তো মানুষজন কোভিডের বহু আগে থেকেই রাস্তাঘাটে মাস্ক পরে ঘোরেন। তৃতীয়ত, বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে হাত-পা-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়াটাও তো ভাল কাজ। এ অভ্যাসও বহুকালের। পুরনোকালে গ্রামের বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ এলে উঠোনে রাখা ঘটি থেকে জল নিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে তবে ঘরে প্রবেশ করতেন। 

তবে, তৎসত্ত্বেও মানুষ কোভিডে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কো-মর্বিডিটির কারণে এই অসুস্থতার প্রকোপ বাড়তেও পারে। তাই ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিহার্য। এখানেই আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। প্রবল শ্বাসকষ্টের সময় সামান্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে কত মানুষ যে মারা যান তার ইয়ত্তা নেই। রক্তের অভাবেও বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাই সবটা মিলিয়ে আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থাও মহামারির জন্য অনেকটাই দায়ী। আর সবচেয়ে বড় দায়ী অনাহার ও অপুষ্টি। 

কোভিড১৯ তার ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করবে, এ স্বাভাবিক। তৃতীয় তরঙ্গ আসা নিয়ে আমাদের আরও এক প্রস্থ বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ থাকবে, তাও স্বাভাবিক। আমরা প্রায়-সকলে ভ্যাকসিন নেওয়া সত্ত্বেও দেখব যে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কখনও কমছে অথবা বাড়ছে। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, কোভিডের ভ্যাকসিনগুলো নাকি ‘Emergency Use Authorisation’এ ছাড়পত্র পেয়েছে মাত্র। অর্থাৎ, খুব জরুরি ভিত্তিতেই এরা ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু চেষ্টা চলছে এর সর্বজনীন ব্যবহারের। রাষ্ট্রগুলি সরাসরি বাধ্য করতে পারে না, কিন্তু ঘুরিয়ে এমন সব নিয়ম করছে যে আপনি ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য। যেমন, ভ্যাকসিন না থাকলে আপনি অমুক দেশে বা অঞ্চলে প্রবেশাধিকার পাবেন না, ট্রেনে উঠতে পারবেন না, বিমানে যাতায়াত করতে পারবেন না- এমনবিধ নানা কিছু। 

সবটা মিলিয়ে, দেখাই যাচ্ছে, ভ্যাকসিনের অবস্থা এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’। খেয়েও পস্তাবেন, না খেয়েও। অতএব সম্বল: ‘রাখে হরি মারে কে’।


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


চলে গেলেন চলমান আরণ্যক - বুদ্ধদেব গুহ

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


এই পৃথিবীর জঙ্গলমহলে ছিল তাঁর অনায়াস আনাগোনা। দিনের আলোকঝারিতে অরণ্য প্রকৃতিকে যেমন চষে ফিরেছেন তিনি, তেমনই আঁধার রাতের অববাহিকাতে চরাচর ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। দেশ কাল তুচ্ছ করে তাঁর মনের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আদিম নিসর্গ। এহেন আরণ্যক লেখক বুদ্ধদেব গুহ, ওরফে লালাদা পাড়ি দিলেন অজানার দেশে। আজ মেঘলা আকাশের বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাঁর বিদায়ে জন্য প্রকৃতির যোগ্য সঙ্গত। সেই তিনি যিনি একই হাতে প্রকৃতি ও রোমান্সকে অনাবিল ভঙ্গিমায় সমন্বিত করেছেন। 

আধুনিক মধ্যবিত্তের অন্তরের খবর যেমন দিয়েছেন তেমন ভাবেই জঙ্গলের বিভিন্ন রূপের অনুপম চিত্র এঁকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। পেশায় ছিলেন একজন অগ্রগণ্য চার্টার্ড একাউন্টেট এছাড়াও ছিলেন দক্ষ সংগীতজ্ঞ, অরণ্য প্রেমিক, শিকারি এবং বাংলা সাহিত্যের সফল লেখক। তাঁর জন্মদিন ২৯ জুন,১৯৩৬। রংপুর জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন ও সেখান থেকে কলকাতায় এসে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কলকাতার রবীন্দ্রসংগীত শেখার খ্যাতনামা স্কুল "দক্ষিণী"তে ভর্তি হন। এই দক্ষিণীতেই লেখকের আলাপ হয় পরবর্তীকালে তাঁর জীবনসঙ্গিনী ঋতু গুহ'র সঙ্গে। তাঁদের সেই প্রেম কাহিনী নিয়ে লেখা লেখকের "খেলা যখন" উপন্যাস হয়ে ওঠে বেস্ট সেলার। ষাটের দশকের গোড়ায় প্রকাশিত হয় লেখকের প্রথম গল্প সংকলন,"জঙ্গলমহল"। লেখকের জঙ্গলে প্রবেশ তাঁর বাবার হাত ধরে।

দশ বছর বয়স থেকে তিনি শিকার শুরু করেন কাজের সূত্রে ঘুরে ফিরেছেন সারা দুনিয়া কিন্তু অরণ্য প্রেম তাঁর পিছু ছাড়ে নি।ভ্রমণের ও অরণ্য দর্শনের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। বাংলা সাহিত্যে অরণ্যের পটভূমিতে তাঁর যত গল্প উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তেমনটির আর দ্বিতীয় কোনও নজির নেই।ভারতবর্ষ ও বিদেশের অরণ্য প্রকৃতি যেমন লেখকের লেখার পটভূমি হিসেবে বারবার এসেছে, তেমনই অরণ্যও হয়ে উঠেছে উপন্যাসের চরিত্র।ব্যক্তিজীবন নিয়ে এত লেখাও বা কে লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে? ছোটদের জন্য তিনি নিয়ে আসেন ১৯৭৩ সালে "ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে"। সেই প্রথম শুরু হল অরণ্য সংরক্ষণ নিয়ে ভাবনা, হ্যাঁ  ছোটদের জন্যই। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে অরণ্যপ্রকৃতির  সঙ্গে সঙ্গে সম্পুর্ন নাগরিক চেতনার আলোকে আলোকিত চরিত্ররা এসেছে। 

কিছু চরিত্র আবার অরণ্য প্রান্তরে পৌঁছে প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। এইভাবেই চরিত্রের ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তিনি নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে বসাতে পেরেছেন অনায়াসেই। বুদ্ধদেব গুহর সফল উপন্যাসের স্রেফ নাম উল্লেখ করতে গেলেই আর এ লেখা শেষ হবেনা। তবু যে পাঁচটি উপন্যাসের নাম না নিলেই নয় সেগুলির মধ্যে থাকবে "মাধুকরী", "হলুদ বসন্ত","কোজাগর", "কোয়েলের কাছে" ও "একটু উষ্ণতার জন্য"। "মাধুকরী"- অনেকে বলেন বুদ্ধদেবের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।এটি গতিশীল, বর্নময় ও বিশাল।এই উপন্যাস শুধু পৃথু ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প নয়, জঙ্গলমহলের শিকড় খোঁজার কিছু মানুষের কাহিনিও বটে। বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী এই বইটির ভাষা, কাহিনী, জীবন দর্শন, জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মধ্যে লুকানো বিতৃষ্ণা, সবই যেন এক নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে। তাই "মাধুকরী" যেন জীবনের ভাষ্যের এক নতুন নাম।তাঁর বেশিরভাগ গল্প, উপন্যাসে এক স্বপ্নিল বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করে - যার মধ্যে রোমান্টিক এক আবেদন সহজেই অনুভব করা যায়। তাঁর রচনা চিনিয়ে দেয় এক নিত্য পর্যটকের স্বভাবকে, ভ্রমনকারীর সৌন্দর্যের চোখকে এবং পথ দর্শনকে। ঋজুদা, ঋভু - এরা দুজনেই লেখক নিজেই। 

"হলুদ বসন্ত"-এর ঋজুও তিনিই।তাঁর আরণ্যক গল্প, উপন্যাসে তিনি যে নাগরিক চরিত্রগুলিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে অরণ্যে নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের নাগরিক সত্তা ছেড়ে অরণ্যের সাথে মিশে গেছেন অনাবিল সারল্যে, কিংবা হতে চেয়েছেন আদিম। তাই তাঁর চরিত্র যেমন গাছের প্রেমে পড়ে, তেমনই প্রেমে পড়ে ওই অরণ্যের এক নারীর। গল্প, উপন্যাসে বাইরে তিনি অসংখ্য লেখা রেখে গেলেন আমাদের জন্য, এমনকি গোয়েন্দা কাহিনীও। তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন, কোদালকে কোদাল বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। সেই সুবাদে একটি বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর একদল লেখক কিভাবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রবেশকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, সেই কাহিনী আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন তিনি। এমনকি তিনি এ কথাও লিখতে দ্বিধা করেননি যে ওই বিশেষ পত্রিকা নিজেদের কিছু মধ্যমানের সাহিত্যিককে দিয়ে দিনের পর দিন লিখিয়েছেন, পাঠকদের জোর করে গিলিয়েছেন, কিন্তু সত্যি যাঁদের লেখায় সাহিত্য মূল্য আছে তাঁরা থেকে গেছেন ব্রাত্য। সেই হিসাবে বুদ্ধদেব বলতেন ওই পত্রিকা গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছেন। ওই পত্রিকা গোষ্ঠীর একাউন্টস দেখতেন বুদ্ধদেব, এবং সেই সুবাদেই তিনি নাকি লেখার সুযোগ পান, এমন অপবাদও প্রকাশ্যে আনা হয়। 

একটা সময় ছিল যখন বাংলা সাহিত্যের উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু বলা হত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব গুহ'কে। বইমেলায় যখনই গেছেন তখন মহিলাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতেন দুজনেই। তবে কম বয়সীদের ভিড়টা থাকত বুদ্ধদেবের দিকে। এমন একটা মানুষকে তো সমসাময়িকরা একটু হিংসা করবেনই। নইলে আর হিংসে জিনিসটা আছে কেন? আসলে কী ছিল না তাঁর? বাড়ির সবাই রবীন্দ্রসংগীত করেন বলে নিজে ধরলেন টপ্পা। নিধুবাবুর টপ্পা গেয়ে একটা সময়ে জমিয়ে দিয়েছেন কলকাতা ও মফস্বলের বহু আসর।

ছবি আঁকতেন এমন যে একাডেমির প্রদর্শনীতে ভিড় জমাতেন চিত্র সমালোচকরা। নিজের পেশায় ছিলেন চূড়ান্ত সফল। সেলিব্রেটি কাপল বলতে কলকাতায় ছিলেন বুদ্ধদেব ও ঋতু গুহ। সাহিত্য পুরস্কার অনেক পেয়েছেন, কিন্তু সেরাটি ছিল ধাবায় খেতে বসে যে ছেলেটি তন্দুরি রুটি দিয়ে গেল, সে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিল,"স্যার, আমি আপনার মাধুকরী, কোজাগর পড়েছি।"এই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন বুদ্ধদেব, বলেছেন তাঁর পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আমরাও আজ সেই ছেলেটির মত প্রণাম করে বলছি আজ থেকে আমরাও বুধ্বং শরনং। তিনি আমাদের জীবনের জলতরঙ্গ এক অপরূপ সুরে বেঁধে দিয়ে গেছেন, স্রেফ তাঁর লেখা দিয়ে। যেখানে ফিরে যাওয়া যায় বারবার আর প্রতিবারই যেন মনে হয় নতুন এই জীবন।

শোভনলাল চক্রবর্তী

Wednesday, August 18, 2021

খিদের অতিমারিকে চিনতে পারিনি, কোভিড অতিমারিকে চিনব কী উপায়ে?

 লিখেছেন 

বি ষা ণ   ব সু

সূত্রঃ ইন্টারনেট

একেবারে উল্টো গল্প দিয়ে শুরু করি। ধরুন, একটি অল্পবয়সী মেয়ে স্নান করতে গিয়ে লক্ষ করল, তার স্তনে একখানা ডেলা। মেয়েটি দিনমজুরি করে খায়। একদিন কাজে না গেলেই মুশকিল। আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আউটডোর ওই দিনের বেলাতেই খোলা। কাজেই দেখাচ্ছি দেখাব করতে করতেই কিছুদিন দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ডেলা-টি সাইজে বেশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার দেখেই বললেন, বায়োপ্সি করতে হবে, কিন্তু সে তো এখানে হবে না। মহকুমা হাসপাতাল অব্দি ছুটতে হবে। সেও আবার কাজ কামাইয়ের ধাক্কা, যাতায়াতের খরচাও আছে। মেয়েটি কী করবে, ভেবেই পায় না। এদিকে কমপ্ল্যান খাওয়া বাচ্চার মতো ডেলা-টি দেখতে দেখতে বেড়ে চলেছে। অতএব, একটু দেরিতে হলেও, মেয়েটি সদর হাসপাতালে গেল, বায়োপ্সিও হল। দিনসাতেক বাদে রিপোর্ট - আরও একদিন কাজ কামাই, আরও একদফা যাতায়াত - জানা গেল, ক্যান্সার। ডাক্তার জানালেন, এখুনি অপারেশন করতে হবে। দুই কি তিন সপ্তাহের মাথায় অপারেশনের তারিখ দেওয়া হল, তার আগে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা। এদিকে সেই পরীক্ষানিরীক্ষা করতেও বিস্তর দৌড়াদৌড়ি - সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সাতে হলেও একেক পরীক্ষার একেক তারিখ, অনেকবার যাতায়াত, কাজ কামাই। মেয়েটি পেরে ওঠে না। অপারেশন করানো নিয়েও ভয় তার। অতএব, স্থানীয় এক টোটকা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় সে। তিনি বলেন, ওঃ, ওইসব অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার তো, ওদের কাজই ভয় দেখানো৷ কিচ্ছু ব্যাপার নয়, তিন কি চার হপ্তা ওষুধ খেলেই অসুখ-বিসুখ কোথায় হাওয়া হয়ে যাবে। দিনমজুরির কাজ কামাইয়ের দরকার নেই - শুধু আমার পরামর্শ মেনে চললেই হবে। 

এর পরের কাহিনী অনুমান করার জন্যে কোনও বাড়তি নম্বর নেই। মাসকয়েক বাদে যখন সে আরও একবার সেই হাসপাতালে যাবে, তখন তার স্তন থেকে গলা রস, পুঁজ, দুর্গন্ধ - ডাক্তারবাবু জানান, অপারেশন করার স্টেজ পার হয়ে গেছে। আপাতত ওষুধপত্র ড্রেসিং ইত্যাদি। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় ডাক্তারবাবুর গলার সুর বা শরীরী ভাষা দেখে বাকিটুকু অনুমান করতে অসুবিধে হয় না মেয়েটির পরিবারের। মেয়েটির পরিণতিও আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। 

তাহলে মেয়েটির এই পরিণতির কারণ কী? 

  • ক্যান্সারের মতো অসুখ যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে, সেই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে মেয়েটির ব্যর্থতা? ক'দিন মজুরি হারানোর ভয়ে সে অপারেশন করাতে দেরি করল, কিন্তু বুঝল না অসুখ ভয়াবহ আকার নিলে মজুরি ব্যাপারটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে?
  • সেই স্থানীয় টোটকা "চিকিৎসক", যিনি ক্যান্সারের বিপদকে লঘু করে দেখিয়ে মেয়েটিকে আপাত-স্বস্তি জুগিয়েছিলেন? যিনি ওরকম করে আশ্বস্ত না করলে, মেয়েটি হয়ত যে করেই হোক অপারেশন করাতে দৌড়াত - দায় কি তাঁর কিছু কম??
  • স্বাস্থ্যব্যবস্থার দায়ও কি কম? বাড়ির কাছে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার ন্যূনতম বন্দোবস্তটুকু থাকলে কি মেয়েটি চিকিৎসায় এমন করে অবহেলা করতে পারত? অ্যাক্সেস টু হেলথকেয়ার - যার বাংলা করা যেতে পারে, সকলের নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা। আমরা নাগাল শব্দটিকে আর্থিক সামর্থ্যের সাথে এক করে ভাবতেই অভ্যস্ত - কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্ব অর্থে নাগাল শব্দটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ন্যূনতম পরীক্ষানিরীক্ষা বা চিকিৎসার জন্যে যদি লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়, তাহলে বিনেপয়সায় পেলেও চিকিৎসা করানোটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। যে ওষুধ পাঁচশ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়, তা বিনেপয়সায় মিললে খুবই ভালো কথা - কিন্তু সেই ওষুধ পেতে পরিবারের রোজগেরে মানুষের যদি একটি আস্ত কর্মদিবস নষ্ট হয়, এবং রাহাখরচের পরিমাণও কম কিছু নয়, তাহলে সেই বিনেপয়সায় পাওয়ার ভালত্বটি মাঠে মারা যায়।
  • রাষ্ট্রের দায়িত্বই বা কম কী? দিনমজুরি খেটে যাঁরা উপার্জন করেন, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে যাঁদের একটি দিন কাজ হারানোর অর্থ উনুন না জ্বলা - হাসপাতালে দিনদশেক ভর্তি থাকার অর্থ সপরিবার উপবাস - তাঁদের জন্য স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বাদেও থাকবে না ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা?
  • আর এতশত উচ্চমার্গের আলোচনা বা অমুকের 'পরে দোষের দায় ঠেলার মুহূর্তে নিজেদের দায়িত্বটাও ভুলে গেলেও চলবে কেন!! আমরা, অর্থাৎ দেশের "সচেতন" নাগরিক। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পেরোলো - প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কই, একটাও নির্বাচনের কথা শুনেছেন, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যচিকিৎসার অধিকার প্রধান বা অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে? অনেক বাচ্চার মধ্যে যে বাচ্চা কাঁদে কম, সেই বাচ্চার ভাগে মায়ের দুধ কমই জোটে - স্বাস্থ্যক্ষেত্রের হালও তেমনই। কর্পোরেট হাসপাতালের বিল, বিভিন্ন দুর্নীতি বা ডাক্তারকে গালমন্দ করার ব্যাপারে আমরা যতখানি আগ্রহী, সরকারের কাছে সবার স্বাস্থ্য-চিকিৎসার দাবি তোলার ব্যাপারে আমরা ততখানিই বিস্মরণ-প্রবণ। সুতরাং, আমাদের বরাতে এইই জুটবে৷ আজ এই মেয়েটি দরিদ্র বলে তার এমন পরিণতি - চিকিৎসার খরচ যেভাবে আকাশ ছুঁতে চলেছে, এখুনি সরব না হলে আমাদের সকলের এমন পরিণতিও খুব দূরে নয়।

এসবের মধ্যে অসুখের প্রসঙ্গ আর আলাদা করে আনলাম না। ক্যান্সার ভয়ানক অসুখ। সময়ে চিকিৎসা না করা গেলে পরিণতি ভয়ঙ্কর তো বটেই - এমনকি, সময়ে চিকিৎসা করা গেলেও একশ শতাংশ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কিন্তু এই দ্বিতীয় অংশটুকুর অনিশ্চয়তাকে সামনে তুলে প্রথম অংশের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ-নির্ণয় ও জলদি চিকিৎসা, বাঁচার পথ এটিই। মেডিকেল সায়েন্স কোনও গাণিতিক বিজ্ঞান নয় - দুইয়ে দুইয়ে চার ক্ষেত্রবিশেষে হয় না - তবু একথা অনস্বীকার্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেকদূর অগ্রগতির শেষে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিসেবটা মেলে। কাজেই, অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়েই বলা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় অসুখের চিকিৎসা করা গেলে অসুখ সারার সম্ভাবনা অনেক অনেএএএক বেশি। 



এই গল্পটিকে রূপক হিসেবে ধরে নিয়ে যদি ক্যান্সারের জায়গায় কোভিড বসিয়ে পড়া হয়, চিত্রটা কেমন হবে?

 হ্যাঁ, মারণক্ষমতায় তুলনীয় না হলেও, কোভিডের সংক্রমণক্ষমতার কারণেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি - চট করে একসাথে অনেককে কাবু করে ফেলার ক্ষমতাও বেশি - কাজেই আক্রান্তের খুবই কম শতাংশের মৃত্যু হলেও মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষত, নড়বড়ে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিয়ে একসাথে অনেক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সামলানো মুশকিল - সেক্ষেত্রে মৃত্যুহার এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা, উভয়ই বাড়ার সম্ভাবনা। 

তড়িঘড়ি অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করা গেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায় - অবশ্য একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা শুরু করার পরেও মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্যে নামিয়ে আনা মুশকিল। কিন্তু এই দ্বিতীয় কথাটিকে বেদবাক্য ধরে প্রথমটির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখা যায় না।

যাঁরা কোভিডকে গুরুত্বহীন বলছেন, কার্যক্ষেত্রে  তাঁরা বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করছেন। খুবই আশ্চর্যের কথা, পশ্চিমে এসব কথা বলছেন ক্রিশ্চান রক্ষণশীলরা এবং অতি-দক্ষিণপন্থীরা - আর এদেশে অতিবামেদের একাংশ। কোভিড যদি গুরুত্বহীনই হবে, তাহলে তো এব্যাপারে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফাঁকফোকড়গুলো নিয়েও আলাদা করে সোচ্চার হওয়ার মানে হয় না। ঠিকই, কোভিডে যতজন মারা গেলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি শিশু এদেশে মারা যায় অপুষ্টিতে, পেটখারাপে - প্রতি বছরই। কিন্তু সেভাবে ভাবলে, আমফান বা বন্যায় যা মৃত্যু, তার চেয়ে বেশি মানুষ প্রতিবছর মারা যান পথদুর্ঘটনায় - তাহলে কি আমফান বা বন্যার প্রাণহানিকে গুরুত্বহীন ভাবব? 

টিকা নিয়েও একই কথা। আংশিক কার্যকরী টিকাও যদি জনসংখ্যার অধিকাংশকে তাড়াতাড়ি দেওয়া যায়, তা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে দারুণ কার্যকরী হতে পারবে। কিন্তু টিকার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই অকারণ প্রশ্ন তুললে সবাইকে তড়িঘড়ি টিকা দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রশ্নটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। 

অতিমারী মোকাবিলার নামে বেপরোয়া লকডাউন চললে অজস্র মানুষ কর্মহীন হবেন - হয়েছেনও। ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত ছাড়া অনাহার বেড়েছে। লকডাউনের শুরুর দিকেই অক্সফ্যাম-এর রিপোর্ট ছিল, বিশ্বের সর্বাধিক কড়া লকডাউন চালুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ছিল প্রথম সারিতে - কিন্তু লকডাউন চলাকালীন সামাজিক সুরক্ষাপ্রকল্পে ব্যয়ের হিসেবে আমরা ছিলাম একেবারে তলানিতে৷ এই দুইয়ের মিশেলের প্রতিফল যেমন হওয়ার, তেমনই হয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেননি বাকি অন্যান্য গুরুতর অসুখের রোগীরা - ক্যান্সার-আক্রান্তরা কেমোথেরাপি রেডিওথেরাপি নিতে আসতে পারেননি, কিডনির অসুখে ভোগা মানুষেরা ডায়ালিসিস করাতে পারেননি। লাগাতার ইশকুল বন্ধের ঠেলায় আস্ত একটি প্রজন্ম স্কুলছুট হয়ে পড়েছে - যাদের মধ্যে কতজন আবার ইশকুলে ফিরবে, বলা মুশকিল। 

আর অতিমারী বা মৃত্যুমিছিল চললে, লকডাউনও চলবে - অন্তত লকডাউনের সপক্ষে যুক্তিগুলো ভ্যালিড থাকবে। দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ... ঢেউয়ের পর ঢেউ আসতে থাকবে… যেহেতু আমরা কখনোই স্বাস্থ্যপরিকাঠামোকে মজবুত করার দাবি তুলিনি, সে কাজে এখনও সরকার মনোযোগী হবে না - নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে লকডাউনই সহজতম পথ। সহজতম, কেননা লকডাউনের শেষে সমাজের ধনীতম অংশের সম্পদ বেড়েছে বলেই খবর - ভুগছেন মূলত যাঁরা, তাঁরা আর্থিক উদারীকরণের বাজারে আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন, সরকারেরও তাঁদের কথা না ভাবলেও চলে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম লেখাপড়া করে প্রাইভেট ইশকুলে, আমরা চিকিৎসা করাই প্রাইভেট হাসপাতালে - পুরোনো সিনেমা দেখতে না বসলে গরীব কেমন দেখতে হয়, ভুলেই গিয়েছি। 

অতএব, এইই প্রাপ্য ছিল। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কোভিডের আগে থেকেই, অনেক বছর ধরে, বিশ্বের একটা বড় অংশ জুড়ে জারি আছে খিদের অতিমারী, এদেশে তো বটেই - সে অতিমারী বীভৎসতা এবং প্রসার, দুভাবেই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। সেটিকে যদি সঠিকভাবে চিনতে শিখতাম, তার সুরাহার ব্যাপারে যদি একটুখানি আগ্রহী হতাম - তাহলে সবাই মিলে কোভিড অতিমারী মোকাবিলার সেরা পথ কী, সে নিয়ে এত বেশি শব্দ খরচ করতে হত না।


বিষাণ বসু


Sunday, August 15, 2021

বাইশে শ্রাবনঃ একটি কলঙ্কিত স্মৃতির দিনও কি নয়?

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source: Internet

বাঙালি পাঁজির ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী। এই স্বভাব তাদের অনেকদিনের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের(৭ মে ১৮৬১ - ৭ আগস্ট ১৯৪১) জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালিত হয় বাংলা তারিখ মতে যথাক্রমে পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ। এই  দিন দুটি বেশির ভাগ বছরেই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে পড়ে দুটি আলাদা দিনে, ফলে বাঙালি এই একটি দিনের মজা নেয় উপর্যপরি দুই দিন ধরে। এবারের বাইশে শ্রাবনেও তার অন্যথা হয় নি। নানা মাধ্যমে বাঙালি তার রবীন্দ্রপ্রেম উগরে দিয়েছে। এ হল সেই আত্মঘাতী বাঙালি, যে তার নিজের অবিমিশ্রকারিতায় বাইশে শ্রাবণ তেরোশো আটচল্লিশ বঙ্গাব্দকে করে রেখেছে একটি কলঙ্কিত দিন। সেই দিন কবির মৃত্যুর কিছুক্ষনের মধ্যে "রবীন্দ্রনাথ কি জয়" চিৎকারে মত্ত উশৃঙ্খল জনতার ভিড় জোড়াসাঁকোর লোহার গেট ভেঙে পৌঁছে গেছিল দোতলার বারান্দায়, কবির শেষ শয্যার অনতিদূরে। 

কবির মৃতদেহ স্নান করানোর নিভৃত মুহূর্তটি হয়েছিল কালিমালিপ্ত। কবিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনের মধ্যে টানাপোড়েন অনেক দিন ধরেই চালু ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতির এই 'জিনিয়াস' যে আসলে তাঁদের 'নিজস্বজন' এটা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল দু'পক্ষই। কবির শেষ বয়সে এই দ্বন্দ্ব তিক্ত আকার ধারণ করে এবং মৃত্যুলগ্নে এসে তা রীতিমত লড়াইয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে ঝুঁকে ছিলেন শান্তিনিকেতনের দিকে। নিকটজনদের কাছে তিনি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে তাঁর শেষকৃত্য যেন শান্তিনিকেতনেই সম্পন্ন হয়। আশ্রমেই ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তিনি মারা গেলেন কলকাতায়। তাঁর মৃত্যুর পর কবির দেহ শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। কারণ একদল লোক বেছে বেছে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অপমান করে জোড়াসাঁকো বাড়ির ভেতরে ঢুকে। তারপর, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে শুরু হয়ে যায় কবির শেষ যাত্রা। সেই শেষ যাত্রা অমর হয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস বা সত্যজিৎ রায়ের তোলা ডকুমেন্টারিতে(নিচে দেওয়া হল), এছাড়াও অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন যে একদল স্মারক লুব্ধ ভক্ত কবির মৃতদেহ আক্রমণ করে এবং মৃতদেহ থেকে চুল দাড়ি উপড়ে নিতে শুরু করে। 



শবের পাশে বসে থাকা নন্দলাল বসু শেষকালে পাখার বাঁট দিয়ে তাদের নিরস্ত্র করেন। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ সেই চুল দাড়ি পাঠিয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। এন্ড্রুজের বাড়িতে সেই স্মারক বহু মানুষ দেখেছেন। সেই স্মারক কিভাবে সংগৃহীত হয়েছিল বা কে সংগ্রহ করেছিল, তার উত্তর আজও মেলে নি। শবযাত্রা যত এগিয়ে চলে ততই প্রকট হয়ে ওঠে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। প্রিয় কবিকে দূরদূরান্ত থেকে অনুরাগীরা দেখতে আসছিলেন, তার আগেই অস্বাভাবিক দ্রুততায় একদল অভিসন্ধিপরায়ান লোক পুরো প্রক্রিয়াটিকে কব্জা করে ঝড়ের গতিতে দেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে চলে যায়। বহু ভক্ত সেই শোকমিছিলের অবিশ্বাস্য বেগের কাছে পরাস্ত হন, তাঁদের ফুলের মালা হাতেই রয়ে যায়। শ্মশানের ছবিটি ছিল আরও ভয়াবহ। 

এমন একজন অসামান্য ব্যক্তির দেহ কীভাবে সম্মানজনকভাবে সৎকার করতে হয়, শ্মশান বা কলকাতা করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার জন্য প্রস্তুতি রাখেননি। একটা বেড়া পর্যন্ত ছিল না মৃতদেহের সুরক্ষার জন্য। চিতার আগুন সম্পূর্ণ নেভার আগেই অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য পাগল হয়ে ওঠে একদল মানুষ। ভিড়ের চাপে রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি ! শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। কবির ইচ্ছা ছিল তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী, কিন্তু সেই ইচ্ছার মর্যাদা রাখা হয়নি।যার লেখনীর জোরে বাঙালির জাতিসত্ত্বা আজও বেঁচে আছে, সেই গুরুদেবের শেষযাত্রাকে কলঙ্কিত করেছিল হুজুগে বাঙালি। আজও রবীন্দ্র পুজোর অনেকটাই হুজুগ।  নইলে দুদিন ধরে বাইশে শ্রাবণ উদযাপন করা বাঙালি নিশ্চয় টের পেত যে এবার ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০ বছর উদযাপন। তাঁর 'রবিকা'রও ১৬০। মাঝখানের যোগসূত্র ৭ আগস্ট। অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। লেখা ছবি আর মুক্তির বৈপরীত্যে অক্ষয়, অবিনশ্বর হয়ে থাকে ঠাকুর বাড়ির দুই বিপরীত মেরুর জিনিয়াস। লক্ষণীয় যে জীবনের শেষ লগ্নে দুজনেই মুক্তি খোঁজেন নতুন কোনও শিল্পরূপে। অবনীন্দ্রনাথ ছবি জগৎ ছেড়ে পাগলামির কারুশিল্পে পেয়ে যান মুক্তির স্বাদ।সে সব লেখালেখি নিয়ে মত্ত থাকেন দিনরাত। আর লেখালেখির জগৎ ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ হাতে তুলে নেন রং তুলি, নিজস্ব মুক্তিতে বিভোর হয়ে শুরু করেন চিত্রশিল্পের চর্চা। রবীন্দ্রনাথের ছবির বর্ণনায় অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরনের মত একটা ব্যাপার হয়েছে। সেই একই বিস্ফোরণ ঘটে অবনীন্দ্রনাথের পুঁথি যাত্রার লেখায়। প্রায় দু'হাজার ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ! হ্যাঁ, ১৯২৮ থেকে শুরু করে ১৯৪১-এর মধ্যে। একদা যে মন ডুবে ছিল সুরে আর কথায়, সেই মন  ডুব দিয়েছিল রেখার ভিড়ে। ছবি এঁকে তিনি খ্যাতিলাভ করতে চাননি। ছবি ছিল তাঁর "এক জাতের নেশা", যেখানে ছিল "মাতলামি করবার অবিমিশ্রিত স্বাধীনতা"। 

ছবির দৌলতে খুলে গিয়েছিল রবীন্দ্র প্রতিভার এক অন্য ভুবন। অন্যদিকে ছবির অবনীন্দ্রনাথ মুক্তি খুঁজে নিলেন শব্দকল্পের লেখাজোকার বিশেষ এক ধরণে।সেই ভুবন বা নতুন পথের সন্ধান থেকে বিরত থেকেছে বাঙালি। তার চাই সবই চেনা চেনা। চেনা দুঃখ, চেনা সুখ। আমরা ভুলে যাই যে বাইশে শ্রাবণ আসলে সবাইকে নিয়ে হুল্লোড় করে উদযাপন করার দিন নয়। সেদিন আমাদের সাজিয়ে তোলার দিন। আমাদের দুঃখ, আমাদের শোককে। যেমনটা লিখেছেন আমাদের এই সময়ের এক অগ্রগণ্য কবি,"আমাদের শোক শুধু সেজে ওঠে বাইশে শ্রাবনে"। সেই শোক কী আমাদের সাজানো শোক? মিথ্যা শোক? এই প্রশ্ন আমাদের ভাবায় কি? এই হুল্লোড়ের মধ্যে প্রশ্নটি উঠলে ভালো হয়। যীশুখ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিনে শান্তি প্রার্থনা করেন খ্রিষ্টানরা। বাইশে শ্রাবণ যে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের চরম অবমাননা করলেন, সেই দিনের জন্য তাঁরা যদি অনুতপ্ত হন, তবে কেন বাইশে শ্রাবন হতে পারে না নীরব প্রার্থনার দিন?


শোভনলাল চক্রবর্তী